‘সিন’ করলেন সিনার

পাঁচ বছর আগে এই ইউএস ওপেনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমি এসেছি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতে। আন্দ্রে আগাসির হাত থেকে যখন ইউএস ওপেনের শিরোপা বুঝে নিলেন ইয়ানিক সিনার, তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়।

ইয়ানিক সিনার বছর শুরু করেছিলেন গ্র্যান্ড স্লাম দিয়ে, শেষও করলেন গ্র্যান্ড স্লাম দিয়েই।এএফপি

দর্শকে ঠাসা গ্যালারি, মাঠজুড়ে শুধুই টেলর ফ্রিটজের স্তুতি। পপ তারকা টেলর সুইফট থেকে শুরু করে টেকনো কিং ইলন মাস্ক—আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে তারকার মিলনমেলা বসেছিল ইতিহাসের সাক্ষী হতে। পুরো দুই দশক পর ইউএস ওপেনের শিরোপার এতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন কোনো মার্কিন পুরুষ তারকা। আর এক ধাপ পেরোলেই শিরোপা। এমন ইতিহাস গড়ার দিনে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়?

ফ্রিটজ পারেননি। ইউএস ওপেনের ফাইনালে শিরোপা দূরে থাক, কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেননি তিনি। ইয়ানিক সিনার রাতটা নিজের করে নিলেন নিজের মতো করেই। সরাসরি সেটে হারিয়ে প্রথম ইতালিয়ান হিসেবে ইউএস ওপেনের শিরোপা উঁচিয়ে ধরলেন সিনার। সিনারের এমন জয় অবশ্য প্রতিক্ষীতই ছিল। বছরজুড়েই তিনি ছিলেন উড়ন্ত ফর্মে।

২০২৩ ছিল তাঁর উত্থানের বছর। উইম্বলডন সেমিফাইনাল আর এটিপি ফাইনালসে তাঁর বাধা ছিলেন একজনই—৩৬ বছর বয়সী নোভাক জোকোভিচ। নোভাক–বাধা পেরোতে পারলেই যে সিনার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন, সেটা অনুমিতই ছিল। বাধা পেরোনোর গল্প লিখতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের সেমিফাইনালেই দেখা হয় জোকোভিচের সঙ্গে। শেষ দুই দেখায় যে অস্ত্রে শান দিয়েছিলেন, তা প্রয়োগের জন্য সিনার বেছে নিয়েছিলেন জোকোভিচের প্রিয় কোর্ট। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মঞ্চে নোভাককে হারিয়ে শুরু হয় তাঁর জয়যাত্রা। ফাইনালে দানিল মেদভেদেভের বিপক্ষে ০-২ সেটে পিছিয়ে পড়লেও হারেননি, স্নায়ু ধরে রেখে বের করে এনেছেন ম্যাচ। জীবনের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম উঁচিয়ে ধরেছেন ফিরে আসার অনন্য এক গল্প লিখে। ২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের কোনো ম্যাচে হারের দেখা পেয়েছিলেন জোকোভিচ।

প্রথম ইতালিয়ান হিসেবে টেনিস র‍্যাংকিংয়ের চূড়ায় আসীন হয়েছেন সিনার
এএফপি

এর পর থেকে আর সিনারকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হার্ড কোর্ট সিজনে চলে তাঁর আধিপত্য, কিন্তু ক্লে সিজনের আগেই বাদ সাধে ইনজুরি। চোট থেকে উঠে এসেই খেলেন ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনাল। কার্লোস আলকারাজের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে মেনে নিতে হয় হার। কিন্তু তত দিনে আরেকটা জয় নিজের নামে লেখা হয়ে গেছে তাঁর। জোকোভিচের অনুপস্থিতি তাঁকে তুলে দিয়েছে টেনিস র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে! প্রথম ইতালিয়ান হিসেবে টেনিস র‍্যাংকিংয়ের চূড়ায় আসীন হয়েছেন সিনার।

আরও পড়ুন

বাকি মৌসুম সে ফর্মটাই টেনে নিয়ে গেছেন। উইম্বলডন কোয়ার্টার ফাইনালে চোটে পড়ার আগ পর্যন্ত এগিয়েই ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত মেদভেদেভের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় তাঁকে।

এরপরই দুঃসংবাদ নেমে আসে সিনারের ক্যারিয়ারে। ডোপিংয়ের অভিযোগ আসে তাঁর বিপক্ষে। নিষিদ্ধ ক্লোস্টেবল পাওয়া যায় শরীরে। পরে জানা যায়, হাতের ক্ষত শুকাতে একধরনের স্প্রে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। চিকিৎসকের ভুলে শাস্তি পেতে হয় সিনারকে, কাটা যায় ইন্ডিয়ান ওয়েলসের পয়েন্ট। সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করা হয় চিকিৎসককে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস কিংবদন্তি আন্দ্রে আগাসির কাছ থেকে ইউএস ওপেন শিরোপা বুঝে নিচ্ছেন ইতালির ইয়ানিক সিনার
এএফপি

সিনার যখন ইউএস ওপেনে পা রাখেন, তখন তাঁর নামের পাশে ডোপিং–কাণ্ডের শাস্তি। মানসিক একটা চাপ তো আছে, সেই সঙ্গে ফর্মের তুঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীরা। ইউএস ওপেনের মঞ্চে সিনারের প্রতিপক্ষ তখন খেলোয়াড়েরা নন, বরং তিনি নিজেই। নিজেকে জয় করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর নিজের বিপক্ষে লড়াইটা খুব ভালোভাবেই জিততে জানেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে হেরেছেন মাত্র একটি সেট, সেটাও আস্তে আস্তে রাইভাল হয়ে ওঠা দানিল মেদভেদেভের বিপক্ষে। এমনকি ফাইনালেও বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেননি ফ্রিটজ। ডোপ–কাণ্ড নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি সিনারের। সবই ‘সিন’ করেছেন সিনার, জবাবটা দিয়েছেন কোর্টে, সরাসরি সেটে জয় দিয়ে।

আরও পড়ুন

পাঁচ বছর আগে এই ইউএস ওপেনেই গ্র্যান্ড স্লাম অভিষেক হয়েছিল সিনারের। সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া সিনারের সাক্ষাৎকার নিতে আসেননি কেউ। এক সাংবাদিককে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে শুনিয়েছিলেন নিজের গল্প। শেষটা করেছিলেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দিয়ে। ‘আমি শুধু গ্র্যান্ড স্লাম খেলতে আসিনি, এসেছি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতে।’ ঠিক পাঁচ বছর পর সে দৃশ্যই তৈরি করলেন সিনার। একই মঞ্চে হাজারো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, হাতে ইউএস ওপেনের শিরোপা। আন্দ্রে আগাসির হাত থেকে যখন ইউএস ওপেনের শিরোপা বুঝে নিলেন ইয়ানিক সিনার, তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এ তো সবে শুরু, গল্প এখনো অনেকটা বাকি।

আরও পড়ুন