ফুটবল কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়। মুহূর্তে মুহূর্তে অনিশ্চয়তা, নান্দনিকতা কিংবা আবেগ—কোনোটারই কমতি নেই ফুটবলে। কখনো আনন্দের চরম শিখরে তুলে দেয় খেলোয়াড়–সমর্থকদের, কখনোবা ছুড়ে ফেলে হতাশায়। শুরু থেকেই ফুটবলের রূপ এ রকমই। তবে এত কিছুর মধ্যেও এই চর্মগোলককে নিজের মতো করে আপন করে নিতে পেরেছিলেন একজন—পেলে।
পেলের জন্য রোমান্টিকতা একটু অন্য রকম। তিনি জন্মেছেন বহু দশক আগে। ফুটবলের জনপ্রিয়তা তখনো সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি বিশ্বজুড়ে, বরং তখনকার তারকারা ছিলেন রূপকথার গল্পের মতো। রূপকথার গল্পে যেমন লেখা থাকে, রাজ্যের বীর সন্তানেরা ফিরেছেন বীরের বেশে, বিশাল দৈত্য-দানব বধ করে, অনেকটা সে রকম। পেলে খেলেছেন এমন এক যুগে, সেই যুগে ফুটবল না হতো সরাসরি সম্প্রচারিত, না রাখা যেত পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব। তাই তাঁকে নিয়ে রোমান্টিকতার অভাব নেই।
অতি রোমান্টিকতা ডেকে আনে অবিশ্বাস। পেলে এমন যুগেই খেলেছেন, যখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খবর পৌঁছাতেই সময় লেগে যেত এক সপ্তাহ। দূরদূরান্তের মানুষের জন্য চাক্ষুষ প্রমাণের সুযোগ ছিল না। এর ফলে ফুটবল যে এগিয়েছে, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে জীবনে; মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, এ আর এমন কী? ইউরোপীয় ফুটবলে কখনো পা না রাখা পেলে ব্রাজিলিয়ান লিগের বাঘ-ভাল্লুক যতই মারুন না কেন, দিন শেষে তিনি তো একজন রক্তমাংসের মানুষই।
এমনটা অবশ্য ভেবেছিলেন ১৯৭০-এর বিশ্বকাপে পেলেকে মার্ক করার দায়িত্বে থাকা টার্সিসিও বার্গনিচও, ‘ফাইনালের আগে মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম, পেলে আমাদের মতোই রক্তমাংসের এক মানুষ, কিন্তু না। পেলে কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ হতেই পারে না।’ আসলেই তো, পেলে ছিলেন রূপকথার গল্প থেকে নেমে আসা এক রাজা।
১৫ বছর বয়সে গায়ে চড়িয়েছেন সান্তোসের জার্সি, ১৭ বছর বয়সে নেমেছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। হাঁটুতে চোট নিয়েও একা হাতে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। নকআউট স্টেজে হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা, সর্বকনিষ্ঠ হ্যাটট্রিক, এমনকি ফাইনালের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতাও তিনি। ১৯৫৮-এর বিশ্বকাপের অর্জন দিয়েই শ্রেষ্ঠত্বের শৃঙ্গাসনে বসে পড়া সম্ভব। কিন্তু পেলে অমন লোক নন, বরং তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে নিয়েছেন।
বিশ্বজয়ী পেলের নাম যখন সবার মুখে মুখে, তখন নিজের নাম নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন তিনি। পেলে পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়, বরং বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামে তাঁর নাম হয়েছিল এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। কিন্তু ছোটবেলায় গোলরক্ষক ‘বিলে’র নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে ভুলে ‘পেলে’ বলে ফেলেন। সেই থেকে শুরু হয় উত্ত্যক্ত করা। এরপর গায়ের সঙ্গে নামটা জড়িয়ে গেছে, শত চাওয়াতেও আর ঝেড়ে ফেলতে পারেননি।
বরং পেলে হয়ে যান বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত নাম, যাঁকে পাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যায় বিশ্বের হেভিওয়েট ইউরোপিয়ান দলগুলো। কিন্তু বেঁকে বসে ব্রাজিল, ‘পেলেকে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না’ এই শর্তে তাঁকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে ব্রাজিল সরকার। ইউরোপের লোভনীয় প্রস্তাব সরিয়ে তাঁবু গাড়েন সান্তোসেই। তাই বলে থেমে থাকেননি, সান্তোসকে নিয়েই পাড়ি দিয়েছেন ইউরোপ, প্রমাণ রেখেছেন নিজের সক্ষমতার। বিশ্বমঞ্চে সান্তোসকে করেছেন চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু সেই ব্রাজিলিয়ান লিগের পেলেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল শুধু সেই সময়ের ব্রাজিলিয়ানদের, অন্যদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। ফুটবলের রাজাকে নিজের রাজ্যে রাজত্ব করতে দেখার সৌভাগ্য যে সবার হয় না।
পেলে ছিলেন সেই যুগের খেলোয়াড়, যে যুগে ছিল না লাল কার্ড, হলুদ কার্ডের ব্যবহার; পেছন থেকে করা ফাউল ছিল বৈধ; ছিল না অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থাও। কত সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার কেড়ে নিয়েছে একেকটি ভয়ানক ফাউল, তার ইয়ত্তা নেই। এত কিছুর মধ্যেও পেলে দমে যাননি। ১৯৫৯ কোপা আমেরিকায় ৬ ম্যাচে মোট ৯৮ বার ফাউলের শিকার হন পেলে। এর মধ্যে উরুগুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচেই হন ৪২ বার। সদ্য ১৮ পেরোনো পেলে সেবার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েও জিততে পারেননি কোপা আমেরিকা। মনঃকষ্টে আর কখনো কোপা আমেরিকা খেলেননি তিনি। ক্যারিয়ারে এই একটা দাগ রয়ে গেছে তাঁর আজীবন।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেই বিধ্বংসী পেলেকে আর বিশ্বমঞ্চে দেখা যায়নি বললেই চলে। ১৯৬২ আর ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ছিল পেলের কাছে বিভীষিকার মতো। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের টার্গেট হয়ে থাকতেন তিনি। দুটি বিশ্বকাপই পেলে মাঠ ছেড়েছেন চোট নিয়ে। কিন্তু সব দাগ মুছে দিয়েছিল ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ। ১৯৬৬-এর বিশ্বকাপের পর স্বৈরাচারী ব্রাজিলিয়ান সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আজীবনের জন্য ব্রাজিলের জার্সি তুলেই রেখেছিলেন। কিন্তু দলের বিপদে ১৯৬৯ সালে আবারও ডাক পড়ে পেলের। নতুন সরকারের সঙ্গে সঙ্গে মন ফেরে পেলের। আগের গ্লানি ভুলে পেলে ফেরেন মাঠে, মেক্সিকোতে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে ব্রাজিল।
তত দিনে বিদায় নিয়েছেন পেলের সতীর্থরা, নতুন কচিকাঁচাদের সঙ্গে পেলে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না, প্রশ্ন ওঠার আগেই বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিলেন পেলে। কার্ড আর ফাউলের নিয়মে কিছুটা কঠোরতা যেন প্রাণ ফিরিয়ে দিল পেলের পায়ে। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ৪ গোল আর ৪ অ্যাসিস্টে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তুলল ব্রাজিল। আর সেই সঙ্গে পাকাপাকিভাবে জুলেরিমে ট্রফি হয়ে গেল ব্রাজিলের, যার পুরো কৃতিত্ব পেলেকে দিয়ে দিলে ভুল হবে না।
২১ বছরের ক্যারিয়ারে পেলে কী অর্জন করেছেন, সে প্রশ্ন করা অবান্তর। বরং প্রশ্ন হতে পারে, কী অর্জন করেননি। বিশ্বকাপের মঞ্চে গোল করেছেন ১২টি, বানিয়ে দিয়েছেন ৮টি। বিশ্বকাপে খেলা ১৪ ম্যাচের মধ্যে ১২ ম্যাচেই ছিল তাঁর সরাসরি অবদান। আর বাকি দুই ম্যাচে? সেই ম্যাচে ইনজুরিতে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছেন, সান্তোসের মতো ক্লাবকে তুলে এনেছেন বিশ্বমঞ্চে। ফুটবল মাঠে গোলের সংখ্যা নিয়ে কম বিতর্ক নেই, কেউ বলেন ৭৭৫, কেউ বলেন ১২৮১; পেলে আজীবন মেনে গেছেন ১২৮৩। তবে হাজারো গোল, ট্রফি, শ্রেষ্ঠত্বের কাড়াকাড়ির মধ্যে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তটা এনে দিয়েছিল নাইজেরিয়ান গৃহযুদ্ধ।
১৯৬৯ সালের কথা। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে সান্তোস তখন নাইজেরিয়ায়। একই সময় দেশের অন্য প্রান্তে চলছে আফ্রিকার ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত গৃহযুদ্ধ। গৃহহীন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এরই মধ্যে নাইজেরিয়া জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলতে রাজি হয় সান্তোস। আর সেই ম্যাচ সরাসরি দেখার জন্য দুই পক্ষ থেকে আসে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। ৪৮ ঘণ্টার জন্য থেমে যায় নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী ও বিয়াফ্রান বাহিনী। যুদ্ধবিরতিতে মন ভরে উপভোগ করে ফুটবল সম্রাটের খেলা। সেদিনও ২ গোল করে হতাশ করেননি জনতাকে। ফ্রেন্ডলি ম্যাচের সেই দুই গোল না হয় না-ই যোগ হলো তাঁর ক্যারিয়ারে, তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বে বিন্দুমাত্র দাগ পড়বে না।
পেলে ছিলেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা এক চরিত্র; যাঁর আগমনে নগর থমকে যায়, থেমে যায় যুদ্ধ; যাঁর পেনাল্টি থামানো বল সযত্নে নিজের কাছে ৫০ বছর ধরে রেখে দেন গোলরক্ষক। ইতিহাসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যিনি জয় করেছেন, একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিনবার। পেলে হচ্ছেন রূপকথার গল্পের সেই রাজা, যিনি কথা দিয়েছেন এবং রেখেছেন। রেখেই ক্ষান্ত হননি, বরং এতটাই উঁচুতে নিয়েছেন যে তাঁকে ধরাছোঁয়ার মতো অবস্থায় নেই আর কেউ।
পেলের আগে ‘১০’ ছিল সাধারণ একটা সংখ্যা। পেলের পর ‘১০’ হয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো হয়তো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, কিন্তু পেলে রয়ে গেছেন, আজীবন থাকবেন। যত দিন পৃথিবীতে ’১’–এর পর ‘০’ বসিয়ে ‘১০’ হবে, তত দিন পেলে থাকবেন। যত দিন এই চর্মগোলক পৃথিবীতে টিকে থাকবে, পেলে থাকবেন ফুটবলের অবিসংবাদিত রাজা হয়ে।