তোমরা যারা নিয়মিত ক্রিকেট খেলা দেখো কিংবা ক্রিকেট সম্পর্কে খোঁজখবর রাখো, তারা নিশ্চয়ই জানো যে ক্রিকেট খেলার মূল আকর্ষণ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিদেশীয় সিরিজ আর বিশ্বকাপ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই বা তিন দেশ যখন মুখোমুখি হয়, সেই খেলাগুলো দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকেন দর্শকেরা। আইপিএল বা বিগ ব্যাশের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোও বেশ জনপ্রিয়। তবে এই লিগগুলো সারা বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয় না। টুর্নামেন্টগুলোও হয় এক বা দুই মাসব্যাপী। ক্রিকেটে মূলত, সারা বছর আন্তর্জাতিক খেলাই বেশি আয়োজিত হয়। আর ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ বেশ কম হওয়ায় বেশির ভাগ দেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাই ফর্ম এবং পারফরম্যান্স বিচারে তাঁদের ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো সময় বিশ্বকাপ খেলতে পারেন।
কিন্তু ফুটবলের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফুটবলে বিশ্বকাপ বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্টগুলো ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলাগুলোর তেমন গুরুত্ব নেই বললেই চলে। সারা বছর ধরে চলে বিভিন্ন দেশের ফুটবল লিগ। মূলত এই লিগগুলোকে ঘিরেই থাকে ফুটবলের মূল আকর্ষণ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ফুটবল লিগগুলোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই লিগগুলোয় নিজেদের প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ফুটবলাররা পান বিশ্বসেরার তকমা। যেহেতু ফুটবলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ম্যাচ খুব কম হয়, তাই ফুটবলারদের নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে ভালো খেলেই নিজের জাত চেনাতে হয়।
তবে যতই বলা হোক লিগ কিংবা ক্লাব শিরোপার কথা, ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ বিশ্বকাপই। সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বকাপ অনন্য, বিশ্বকাপের মর্যাদা সবচেয়ে উঁচুতে। ফলে নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করা সব ফুটবলারেরই স্বপ্ন। ফুটবল খেলুড়ে দেশ ২০০টির বেশি। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলতে পারে মাত্র ৩২টি দেশ। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয় না অনেক ফুটবলারেরই। এর মধ্যে এমন অনেক ফুটবলার আছেন, যাঁরা ক্লাব পর্যায়ে নিজের দলের হয়ে জিতেছেন সব ট্রফি, করেছেন শত শত গোল। কিন্তু ক্লাব পর্যায়ে অমরত্ব পেলেও নিজের দেশের হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারেননি তাঁরা। ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার আসর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ না করেই শেষ করতে হয়েছে তাঁদের ক্যারিয়ার। তোমাদের বলছি এমন ১০ জন জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের কথা, যাঁরা ক্লাবে দারুণ সফল হলেও কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি।
জর্জ উইয়াহ (লাইবেরিয়া)
তর্ক সাপেক্ষে আফ্রিকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার বলা হয়ে থাকে জর্জ উইয়াহকে। লাইবেরিয়ার এই ফুটবলার খেলেছেন পিএসজি, এসি মিলান ও চেলসির মতো ক্লাবে। যার মধ্যে পিএসজি ও এসি মিলানের হয়ে জিতেছেন লিগ শিরোপা। তিনবার আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হওয়া উইয়াহর দেশ লাইবেরিয়া কখনো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব উতরাতে না পারায় বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তাঁর। কিংবদন্তি এই ফুটবলার এখন দেশটির রাষ্ট্রপতি।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (আর্জেন্টিনা)
আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ফুটবল কিংবদন্তি পেলে। আর্জেন্টিনায় জন্ম নিলেও স্টেফানো আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলেছেন কলম্বিয়া ও স্পেনের হয়েও। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আলো ছড়ানো স্টেফানো ২৮২ ম্যাচে করেছেন ২১৬ গোল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করলেও কখনো বিশ্বকাপ খেলা হয়নি স্টেফানোর। ১৯৫৪ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেললেও আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে জায়গা হয়নি স্টেফানোর। কারণ, এর কিছুদিন আগেই তিনি খেলেছেন কলম্বিয়ার হয়ে। তার কিছুদিন পর স্পেনের নাগরিকত্ব পেয়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন স্পেনের হয়ে, কিন্তু ১৯৫৮ বিশ্বকাপের মূল পর্বে স্পেন জায়গা করে নিতে না পারায় সেবারও বিশ্বকাপ খেলা হয়নি স্টেফানোর। ১৯৬২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায়। কিন্তু চোট থাকায় বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। ফলে ক্লাব পর্যায়ে সর্বোচ্চ সফলতা পাওয়া সত্ত্বেও কখনো বিশ্বকাপ খেলা হয়নি কিংবদন্তি ফুটবলার আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর।
জর্জ বেস্ট (উত্তর আয়ারল্যান্ড)
জর্জ বেস্টকে বলা হয়ে থাকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছেন বেস্ট, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৬১ ম্যাচে করেছেন ১৩৭ গোল। নিজের সোনালি সময়ে তাঁর দেশ কখনো বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায়নি। যখন নর্দান আয়ারল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়, তত দিনে জর্জ বেস্টের বয়স ৩৬, খেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগই পাননি বেস্ট। আর কোনো দিন বিশ্বকাপও খেলা হয়নি তাঁর।
ডানকান এডওয়ার্ডস (ইংল্যান্ড)
ডানকান এডওয়ার্ডস ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম দুর্ভাগ্যজনক খেলোয়াড়দের একজন। ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তৎকালীন সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান ফুটবলার ডানকান। ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড থেকে ফেরার পথে বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। দুই সপ্তাহ হাসপাতালে লড়াই করে মাত্র ২২ বছর বয়সেই মারা যান ডানকান। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ২০ গোল করা এই ফুটবলার কখনো অংশ নিতে পারেননি বিশ্বকাপে।
রায়ান গিগস (ওয়েলস)
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সর্বজয়ী দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রায়ান গিগস। ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সফল এই খেলোয়াড় ইংলিশ ক্লাবটির হয়ে জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা। ১৩টি প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন গিগস। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিজের ক্যারিয়ারে তাঁর দেশ কখনো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করতে পারেনি। ক্লাবে সফল হয়েও বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন কখনো পূরণ হয়নি এই মিডফিল্ডারের।
এরিক ক্যান্টোনা (ফ্রান্স)
অসামান্য প্রতিভাধর ফুটবলার এরিক ক্যান্টোনা। প্রতিভা থাকলেও রগচটা স্বভাবের জন্য ফ্রান্সের জাতীয় দলে নিয়মিত হতে পারেননি কখনো। ইংলিশ ফুটবল ক্লাব লিডস ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দুর্দান্ত খেলা এরিক ক্যান্টোনা। ১৯৯০ সালে ফ্রান্স দলের তৎকালীন কোচ অঁরি মিশেলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে ফ্রান্সের জাতীয় দল থেকে নিষিদ্ধ হন ক্যান্টোনা। তবে মিশেল প্লাতিনি আর জেরার্ড হুলিয়ারের কোচিংকালে আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ক্রিস্টাল প্যালেসের মধ্যকার একটি ম্যাচে এক দর্শকের ওপর চড়াও হওয়ায় ফুটবল থেকে বড় একটা সময়ের জন্য নিষিদ্ধ হন ক্যান্টোনা, বাদ পড়েন জাতীয় দল থেকেও। এসব কারণে জাতীয় দলে কখনো থিতু হতে না পারায় বিশ্বকাপ কখনো খেলা হয়নি তাঁর।
আবেদি পেলে (ঘানা)
প্রকৃত নাম আবেদি আয়েউ হলেও দেখতে পেলের মতো হওয়ায় ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এই ফুটবলার পরিচিত পান ‘আবেদি পেলে’ নামে। ফ্রান্সের ক্লাব লিল ও মার্সেইয়ের হয়ে খেলা আবেদি ক্লাব পর্যায়ে দারুণ সফল। তিনবার জেতেন ফ্রেঞ্চ লিগ। একবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগও। ঘানার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ধরে নেওয়া হয় আবেদি আয়েউকে। অথচ তিনিই কোনো দিন বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেননি। আবেদির ক্যারিয়ারে কোনো দিন বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি ঘানা, এ কারণে বিশ্বকাপও খেলা হয়নি তাঁর। তবে নিজে খেলতে না পারলেও বর্তমানে তাঁর দুই সন্তান জর্ডান আয়েউ ও আন্দ্রে আয়েউ বিশ্বকাপ খেলছেন ঘানার হয়ে।
ইয়ান রাশ (ওয়েলস)
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সফল ক্লাব লিভারপুলের কিংবদন্তি ফুটবলার ইয়ান রাশ। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে লিভারপুলের হয়ে ৬৬০ ম্যাচ খেলে ইয়ান রাশ করেছেন ৩৪৬ গোল। পাশাপাশি ওয়েলসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি, নিজ দেশের হয়ে করেছেন ২৮টি গোল। কিন্তু ক্যারিয়ারের কোনো সময়ই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার হতে না পারেনি ওয়েলস। এ কারণে বিশ্বকাপ খেলা হয়নি ইয়ান রাশের।
লাসলো কুবালা (চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও স্পেন)
খেলোয়াড়ি জীবনে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও স্পেনের জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন লাসলো কুবালা। জনপ্রিয়তা পান বার্সেলোনার হয়ে খেলার সময়। বার্সেলোনার হয়ে স্প্যানিশ লা লিগা জেতেন চারবার। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য সে মৌসুমের ব্যালন ডি’অরের র৵াঙ্কিংয়ে অর্জন করেন পঞ্চম স্থান। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, সব কটি দেশই তাঁর সময়ে অংশ নিয়েছে বিশ্বকাপে। কিন্তু প্রতিবারই দুর্ভাগ্যজনকভাবে চোটে পড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছেন কুবালা।
ভ্যালেন্টিনো মাজোলা (ইতালি)
ইতালির ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার বলা হয়ে থাকে ভ্যালেন্টিনো মাজোলাকে। ইতালিয়ান ক্লাব ভেনেজিয়ার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা মাজোলা আলো ছড়ান আরেক ইতালিয়ান ক্লাব তুরিনোর হয়ে। ক্লাবটির হয়ে মাজোলা মোট পাঁচবার জেতেন ইতালিয়ান লিগ সিরি ‘আ’। পাশাপাশি হন ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে সিরি ‘আ’র সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ খেলা হয়নি মাজোলার। জানোই তো, শুরু থেকেই চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বন্ধ ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন। ফলে এই দুই বিশ্বকাপ খেলা হয়নি মাজোলার। পরবর্তী বিশ্বকাপটি হয়তো খেলতে পারতেন মাজোলা। কিন্তু এর আগেই মাত্র ৩০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই ফুটবলার। ১৯৫০ বিশ্বকাপের ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে মর্মান্তিক এক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় মাজোলার।