কিছু জয় রেকর্ড গড়ে। আর কিছু জয় ঘোচায় আক্ষেপ। কিছু জয় বয়ে আনে প্রশান্তি, আক্ষেপ আর রেকর্ড মিলেমিশে হয়ে যায় একাকার। রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২-০-তে সিরিজ জয় তেমনই এক অর্জন।একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ ঘুরপাক খেত জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বলয়ে। সেখান থেকে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তিকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল।
অবশ্য বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল পাকিস্তানকে দিয়েই। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে এক নামে চেনা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর। সেটাই ছিল শুরু আর শেষ। এর পর থেকে প্রায় ১৬ বছর একই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে টাইগাররা। যার শেষ হয়েছিল ২০১৫ সালে দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে। অথচ এই জয়টা আসতে পারত আরো আগে, পাকিস্তানের মাটিতেই।
যে গল্পটা বলছি তার সূচনা ২০০৩ সালে। সেবার পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট দুনিয়ায় বাংলাদেশ তখনো আনাড়ি। অন্যদিকে পাকিস্তানের লাইনআপে ইনজামাম–উল–হক, সাকলায়েন মুশতাকদের মতো তারকাদের আনাগোনা। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথম দুই ম্যাচেই শোচনীয় হার। শেষ টেস্ট মুলতানে।
মুলতানে প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ করেছিল ২৮১ রান। বল হাতে মোহাম্মদ রফিক আর খালেদ মাহমুদ সুজনের নৈপুণ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি পাকিস্তান। ১৭৫ রানেই শেষ হয় তাদের প্রথম ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে এসে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। কিন্তু হাল ধরেন অলক কাপালি আর রাজিন সালেহ। আস্তে আস্তে যখন ইনিংস গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁরা, তখনই আঘাত হানেন পেসার ইয়াসির আলী। ৯১ রানের মাথায় অলক কাপালির ব্যাট ছুঁয়ে বল চলে যায় উইকেটরক্ষক অধিনায়ক রশিদ লতিফের কাছে। প্রথম দেখায় মনে হচ্ছিল রশিদ লতিফ খুব সহজেই ডাইভ দিয়ে বল নিজের আয়ত্তে নিয়েছেন। পাকিস্তানি ফিল্ডারদের আনন্দ দেখে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রিপ্লে দেখাতেই দেখা মিলল অন্য এক দৃশ্য। লতিফ সে বল হাতে জমিয়েছিলেন বটে, কিন্তু রাখতে পারেননি। বরং সেই বল ফসকে পড়ে যায় মাটিতে। মাটি থেকে তুলে আম্পায়ারের কাছে আবেদন করেন লতিফ। আম্পায়ারও সাত-পাঁচ না ভেবে জানিয়ে দেন আউটের সিদ্ধান্ত।
অলক কাপালির আউটের পর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। ১৫৪ রানে অল আউট হয়ে পাকিস্তানের সামনে ছুড়ে দেয় ২৬১ রানের টার্গেট। দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ে একাই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যান ইনজামাম–উল–হক। এক পাশে যখন আসা–যাওয়ার মিছিল, তখন ইনজামাম খেলেন ১৩৮ রানের এক অসাধারণ ইনিংস। ১ উইকেট হাতে রেখে ম্যাচ আর সিরিজ দুটোই নিজের করে নেয় পাকিস্তান। অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনের কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ার দৃশ্য বাংলাদেশি সমর্থকদের কাঁদিয়েছে অনেক দিন।
পাকিস্তানে টেস্ট মানেই যেন রানের বন্যা। বৃষ্টির মাঝেও সাহস করে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অধিনায়ক শান্ত। সে সিদ্ধান্তের মান রেখেছিলেন বোলাররা। তবে দুর্দান্ত শুরুর পরও সৌদ শাকিল আর রিজওয়ান আহমেদের সেঞ্চুরিতে রান ঠেকেছিল ৪৪৮-এ।
এই টেস্ট নাড়িয়ে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকে। আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা অবনমিত হয়েছিলেন, পাকিস্তানি অধিনায়ককে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল পাঁচ ম্যাচের জন্য। অপরাধ স্বীকার করে পাকাপাকিভাবে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তবে এক হার বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পিছিয়ে দিয়েছিল অনেকটা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর থেকে বড় কোনো জয় ছিল না বাংলাদেশের খাতায়। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।
সেখানে মুলতান এসেছিল ত্রাতা হয়ে। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম জয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিল বাংলাদেশ। তিন বছর ধরে যেখানে একের পর এক হারের বৃত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ, সেখানে তীরে এসে তরি ডোবা? তাও আবার আম্পায়ারের গাফিলতির কারণে? বাংলাদেশের সেই হার এখনো মেনে নিতে কষ্ট হয় তৎকালীন ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সমর্থকদের। টেস্টে জয়ের দেখা পেতে আরও প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে। আর বিদেশের মাটিতে হারানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় সাত বছর! আর পাকিস্তানকে হারানোর স্বাদ পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১২ বছর! আর পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে হারানো? সেটি সম্ভব হয়নি ২১ বছরেও। যত দিন না শান্তর অধীনে দল পা রাখল পাকিস্তানে।
পাকিস্তানে যখন বাংলাদেশ দল পা রাখে, পুরো দেশ তখন অচলাবস্থায়। পুরোনো সরকারের পতন, নতুন সরকারের আগমন। প্রতিটি সেক্টরে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ক্রিকেট বোর্ডেও রদবদল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ দল জেতা দূরে থাক, নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারবে কি না, তা নিয়েই শঙ্কা ছিল। সেই সঙ্গে অনেক দিন ধরেই ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন ক্রিকেটাররা। অনুশীলনটাও ভালোভাবে হয়নি। ভিন্ন কন্ডিশনে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবেন তো? এ প্রশ্নটা ছিল সবার মাথাতেই। প্রথম টেস্ট শুরুর আগেই যখন এত প্রশ্ন, তখন বাংলাদেশে আঘাত হানল ভয়াবহ বন্যা আর পাকিস্তানে বৃষ্টি।
পাকিস্তানে টেস্ট মানেই যেন রানের বন্যা। বৃষ্টির মাঝেও সাহস করে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অধিনায়ক শান্ত। সে সিদ্ধান্তের মান রেখেছিলেন বোলাররা। তবে দুর্দান্ত শুরুর পরও সৌদ শাকিল আর রিজওয়ান আহমেদের সেঞ্চুরিতে রান ঠেকেছিল ৪৪৮-এ। বাংলাদেশকে আটকানোর জন্য মরিয়া পাকিস্তান রিজওয়ানকে ডাবল সেঞ্চুরিও করতে দেয়নি, অপরাজিত ১৭১ রানে থেকেই মাঠ ছাড়েন রিজওয়ান। উল্টো প্রতিরোধ গড়ে তুললেন বাংলাদেশি ব্যাটাররা, চতুর্থ দিনের শেষ সেশনে অলআউট হওয়ার আগে বাংলাদেশের লিড ১১৭ রান। তখনো জয়ের খুব একটা আশা ছিল না কারোর। সব সমীকরণ বদলে যায় পঞ্চম দিন সকালে। এক পাশ থেকে সাকিব আল হাসান, অন্য পাশে মেহেদি হাসান মিরাজ—দুই স্পিনারের দৌরাত্ম্যে দিশাহারা হয়ে পড়ল পাকিস্তানি ব্যাটিং লাইনআপ। দুই স্পিনারের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৪৬ রানে অলআউট পাকিস্তান, বাংলাদেশের সামনে টার্গেট মাত্র ৩০ রানের! ৬ ওভার ৩ বলেই উতরে গেল সেই টার্গেট। পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে টেস্টে হারানোর মতো সুখ ও স্মৃতি আর কিসে আছে? তখনো টাইগারদের অনেকটা পথ হাঁটা বাকি।
দ্বিতীয় টেস্টের জন্য যখন প্রস্তুতি চলছে, বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি তখন আরও ভয়াবহ। অন্যদিকে রাওয়ালপিন্ডিতে ভয়াবহ বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভেসে গেল প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন পাকিস্তানকে আটকে দেওয়া গেল মাত্র ২৭৪ রানে। বাংলাদেশের চোখেমুখে যখন পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করার স্বপ্ন, তখনই বাংলাদেশ ফিরল চিরাচরিত ফর্মে। ২৬ রানে ৬ উইকেটের পতন। লিড নেওয়া দূরে থাক, ফলোঅন এড়ানোই তখন স্বপ্ন। ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে তুলে আনলেন লিটন দাস আর মেহেদি মিরাজ। দুজনে মিলে গড়লেন ১৬৫ রানের বিশাল পার্টনারশিপ। দুজনে মিলে দলকে ফেরালেন ম্যাচে। মিরাজ ফিরে গেলেও হাসান মাহমুদকে নিয়ে লিটন পার করলেন সেঞ্চুরি। লিটন যখন রান তুলে যাচ্ছেন, তখন আরেক প্রান্তে তাঁর যোগ্য সঙ্গী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসান। বাংলাদেশ যখন অলআউট হয়, তখন পাকিস্তান থেকে মাত্র ১২ রান পিছিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান আটকে গেল বাংলাদেশি তিন পেসারের কাছে। ১০ উইকেটের ১০টিই তুলে নিয়েছিলেন তাসকিন, হাসান আর নাহিদ রানা মিলে। বাংলাদেশের সামনে টার্গেট দাঁড়াল ১৮৫ রানের। ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ আর পাকিস্তান নয়, বরং বৃষ্টি।
একটা সময় ছিল, যখন পঞ্চম দিন খেলতে নামলে বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করত বৃষ্টির। যাতে কোনোমতে টেস্ট ড্র করা যায়। পঞ্চম দিনে মাঠে নামার আগে মিলল পুরো উল্টো চিত্র, সমর্থকরা প্রাণপণ দোয়া করছেন, যাতে কোনোভাবে বৃষ্টি না নামে। পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে ধবলধোলাই করার সুবর্ণ সুযোগ আর কবে আসবে? বৃষ্টি আসেনি, বাংলাদেশও দমেনি। ৪ উইকেট হারিয়েই ১৮৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ফেলেছে বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসানের চার দিয়েই পাকিস্তানকে ধবলধোলাইয়ের ইতিহাস লিখল বাংলার টাইগাররা। ২১ বছর আগে পাকিস্তান থেকে যে আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল বাংলাদেশ, এবার সেই দেশেই সিরিজ উদ্যাপন, তা–ও ধবলধোলাইয়ের উদ্যাপন। মুলতানের দুঃখ ঘোচানোর বড় উপলক্ষ আর কীই–বা হতে পারে?
পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়টা এল এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের একাংশ ডুবে আছে পানির নিচে। একে তো নতুন সরকার, নতুন ক্রিকেট বোর্ড, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ বন্যা। সব মিলিয়ে দিশাহারা বাংলাদেশিদের কাছে এই জয় উদ্যাপন করাটাও যেন বিলাসিতা। মুলতানের আক্ষেপ ঘুচিয়ে রাওয়ালপিন্ডি জয় করার আনন্দ যেন একচিলতে হাসি হয়েই ধরা দিল বাংলাদেশিদের কাছে।