বিশ্বকাপে ছোট দলগুলো ভালো করল কেন
টি-২০ বিশ্বকাপের শুরুতে যখন সুপার এইট ফরম্যাট ঘোষণা করেছিল আইসিসি, তখন একটি ড্রাফট উপস্থাপন করেছিল সবার সামনে। বিশ্বকাপের ২০ দল থেকে সেরা ৮ দলকে বাছাই করে সুপার এইটের ফরম্যাট উপস্থাপন করেছিল সকলের সামনে। প্রতি গ্রুপ থেকে ফেবারিট দুই দলকে নিয়ে সাজানো হয়েছিল সেই সুপার এইটের ড্রাফট। আইসিসির সেই ড্রাফটে পানি ঢেলে দিয়েছে এবারের বিশ্বকাপ। আইসিসির ভাবনায় থাকা সেরা আট থেকে সুপার এইট নিশ্চিত করতে পেরেছে পাঁচটি দল। চমক দেখিয়ে ‘সুপার এইট’-এ উঠেছে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ! সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আফগানিস্তান।
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শুরুর আগে থেকেই চলছে চমক। ২০ দলের বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ জিম্বাবুয়ের। তাদেরকে উতরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছে উগান্ডা। ক্রিকেটের আবাসভূমি হয়ে ওঠা আরব আমিরাতকে সরিয়ে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে নেপাল। ২০ দলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব যে চমক দেখিয়েছে তাতে করে মূল মঞ্চে যে চমক থাকবে, তা আশা করেছিলেন অনেকেই। তবে ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে এসে ছোট দলগুলো না খেই হারিয়ে ফেলে, এমন ভয়ও ছিল। সকলে চমকে দিয়ে আন্ডারডগরাই এখন বিশ্বকাপের মূল আকর্ষণ।
প্রথম চমকটা এসেছিল আমেরিকার কাছ থেকেই। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে পুরো ‘গ্রুপ এ’র পয়েন্ট টেবিলে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তারা। যে হারের বৃত্ত থেকে আর বেরিয়েই আসতে পারেনি পাকিস্তান। দ্বিতীয় চমকটাও এসেছে ‘গ্রুপ এ’ থেকেই। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা কানাডা হারিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডকে। একদিনে পরপর দুই চমকের রেশ কাটতে না কাটতেই নিউজিল্যান্ডকে ৮৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে দেয় আফগানিস্তান। দুই দিনে তিন আপসেট দিয়ে রাতারাতি জমে ওঠে বিশ্বকাপ। বড়সড় অঘটন না ঘটলেও বড় দলগুলো বুকে নিয়মিতই কাঁপন ধরিয়েছে র্যাংকিংয়ের পিছিয়ে থাকা দলগুলো। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা নেপাল আর স্কটল্যান্ডের কথা আলাদা করে বলতেই হয়।
একটা সময় তো মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ডকে সরিয়ে সুপার এইটে জায়গা করে নেবে স্কটল্যান্ড। প্রতিটি ম্যাচে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স। বৃষ্টিবাধায় ম্যাচ পরিত্যক্ত না হলে হয়তো বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ডকেও আটকে দিতে পারত তারা। পুরো ম্যাচে লাগাম ধরে রেখেও স্কটিশরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ হেরেছে একেবারে শেষ ওভারে গিয়ে। ওমান আর নামিবিয়ার বিপক্ষে সান্ত্বনার জয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে স্কটল্যান্ডকে। নেপালের সে সৌভাগ্য হয়নি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ভালো অবস্থান থেকেও ম্যাচ জিততে পারেনি তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তো ম্যাচ হেরেছে ১ রানে। নার্ভ ধরে রাখতে না পেরে জেতা দুই ম্যাচ হারলেও নেপাল ছিল ধারাবাহিক। বাংলাদেশেরও সঙ্গে জেতার মতো অবস্থায় ছিল তারা।
বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলগুলোর এত ভালো পারফরম্যান্সের নেপথ্যে মূলত এই বিশ্বকাপের ফরম্যাট। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে ২০টি দল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এত দল নিয়ে আগে কখনো কোনো টুর্নামেন্ট হয়নি। স্বভাবতই অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দলগুলো তাই সুযোগও পেয়েছে বেশি। শুধু তাই নয়, ফরম্যাটটাও ছিল ছোট দলগুলোর পক্ষে। প্রতি গ্রুপে পাঁচটি দল, চারটি করে ম্যাচ। প্রতি গ্রুপেই তুলনামূলক শক্তিশালী দুটি দল। একটি আপসেট ঘটাতে পারলেই পরবর্তী রাউন্ডের টিকিট অনেকটা নিশ্চিত। আর বৃষ্টিবাধায় যদি খেলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তবে তো সোনায় সোহাগা। সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তান। পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকে চমকে দিয়ে সমীকরণে আগেই নিজেদের এগিয়ে রেখেছে তারা। অন্যদিকে বৃষ্টিবাধায় কপাল পুড়েছে স্কটল্যান্ডের। ইংল্যান্ড ম্যাচের ফলাফল বদলে দিতে পারত ‘গ্রুপ বি’র সমীকরণ।
এবারের ভেন্যুও বড় ভূমিকা রেখেছে খেলার রদবদলে। বিশ্বকাপের আগেই ছিল আইপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে ছিল রানের বন্যা। অনেকের মনের বদ্ধমূল ধারণাই হয়ে গিয়েছিল টি-টোয়েন্টি বোধ হয় শুধু ব্যাটসম্যানদেরই খেলা। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, বিশ্বকাপেও বোধ হয় একই ধারা চালু থাকবে। কিন্তু পাশার দান উল্টে গিয়েছে বিশ্বকাপের মঞ্চে। ব্যাটসম্যানদের নয়, জয়জয়কার চলছে বোলারদের।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হওয়া খেলাগুলোতে দেখা গিয়েছে বোলারদের জয়জয়কার। এর পেছনে ছিল ড্রপ-ইন পিচের কারসাজি। ড্রপ-ইন পিচ হলো এমন এক ধরনের ক্রিকেট পিচ, যা অন্য কোথাও তৈরি করে এনে মাঠে প্রতিস্থাপন করা হয়। এবারের বিশ্বকাপের ড্রপ-ইন পিচগুলো তৈরি করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকে জাহাজে করে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আমেরিকার মাঠে। বিশ্বকাপের কয়েক সপ্তাহ আগে এই ড্রপ-ইন পিচ ইন্সটল করাতে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যেতে পারেনি পিচগুলো। ফলে পিচের অদ্ভুত আচরণ ছিল পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই। উদ্ভট বাউন্স, বল লেটে আসা, হঠাৎ করেই বল নেমে যাওয়া; সবকিছুই ছিল ছিল পিচে। সবমিলিয়ে একটা সময় বোলিং স্বর্গ হয়ে উঠছিল পিচগুলো।
বড় বড় ব্যাটসম্যানরা ডাহা ফেল মেরেছেন বোলারদের সামনে। নিউইয়র্কে তো সর্বোচ্চ রানই হয়েছে ১৩৭! গ্রুপ পর্বে ২০০ পার হয়েছে মাত্র তিন ইনিংসে। টি-টোয়েন্টির জগতে এই পরিসংখ্যান বড্ড বেমানান। ওয়েস্ট ইন্ডিজেও বেশ কিছু মাঠে খেলা হয়েছে অনেকদিন পর। সাধারণত বড় দলগুলো বেশি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তুলনামূলক নতুন ভেনু হওয়ায় ছোট-বড় দুই দলের জন্যই কঠিন ছিল মানিয়ে নেওয়া।
আবার ব্যাটিং স্বর্গ না হওয়া শাপে-বর হয়েছে ছোট দলগুলোর জন্য। কম রানের মধ্যে যেমন বড় দলগুলোকে আটকে ফেলতে পেরেছে তারা, তেমনি সেই রান তাড়াও করে ফেলেছে দলগুলো। সব মিলিয়ে ব্যাটে বলে সমান ছিল এই বিশ্বকাপ, যা বড় দল ছোট দলের মধ্যে পার্থক্যটাও ঘুচিয়ে দিয়েছে অনেকাংশে।
যদিও সুপার এইট শুরু হতে না হতেই ফর্মে ফিরেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। শেষ কয়েকটি ম্যাচেই দেখা মিলেছে রানবন্যার। স্কটল্যান্ডের ১৮০ তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া করেছে ১৮৫। রান বন্যার সুপার এইটে সারপ্রাইজ প্যাকেজ ছিল আফগানিস্তান। কিন্তু সেই আফগানরাই চমকে দিয়েছে ক্রিকেটবিশ্বকে। গতবছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল আফগানদের। ম্যাক্সওয়েল নৈপূণ্যে সেই স্বপ্ন অধরা রয়ে গিয়েছিল। এবার সেই ভুল করেনি তারা। বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে ২১ রানে। শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়ে জায়গা করে নিয়েছে সেমিফাইনালে। কোনো জয় ছাড়া সুপার এইট শেষ করার কথা ছিল যাদের, তারাই অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশকে হারিয়ে এখন সেমিফাইনালে। কে জানত, নতুন মঞ্চে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আন্ডারডগদের জন্যই।