গত বছরের উয়েফা নেশনস লিগ জিতেছিল স্পেন। ০-০ গোলে ড্র হওয়ার পর পেনাল্টি শুটআউটে গিয়ে শেষ হাসি হেসেছিল লা রোহারা। ফাইনালে তারা কাদের হারিয়েছিল মনে আছে? ক্রোয়েশিয়া। সেবার ফাইনালে ওঠার আগে স্পেন কিন্তু হারিয়েছিল ইতালিকেও। এখন এ বছরের ইউরোর গ্রুপ বির দিকে তাকানো যাক। আলবেনিয়া, স্পেন তো রয়েছেই। তাদের সঙ্গে বাকি দুটি দেশ হচ্ছে ক্রোয়েশিয়া আর ইতালি। একে তো গ্রুপ বি-কে বলা হচ্ছে, এবারের গ্রুপ অব ডেথ। ভাগ্য এবার সুযোগ করে দিয়েছে প্রতিশোধের। ক্রোয়েশিয়া আর ইতালি উভয়েই স্পেনকে হারিয়ে দিলেই লা ফুয়েন্তের বাহিনী একঝটকাতে এবার গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ হয়ে যাবে।
কিন্তু এবারের স্পেন কি সে রকম দুর্বল দল? অথবা ইতালি বা ক্রোয়েশিয়ার সেই সক্ষমতা কি আসলেই রয়েছে? কী হতে পারে এই গ্রুপ অব ডেথের ভাগ্য? চলো, চারটা দলের একাদশ, ইউরোতে তাদের ইতিহাস, পরিসংখ্যান আর বর্তমান ফর্ম বিবেচনা করে খতিয়ে দেখা যাক।
দলের খেলোয়াড়দের দিকে যদি তাকাই তাহলে উনাই সিমোনের সঙ্গে গোলবারে থাকবেন আর্সেনালের হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো ডেভিড রায়া। রক্ষণে আছেন অভিজ্ঞ নাচো এবং দানি কারভাহাল। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখানো কারভাহাল এবার দারুণ একটা মৌসুম কাটিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে।
স্পেনের সেই ঐতিহাসিক দলের বিদায়ের পর বর্তমান দল একেবারেই নতুন এবং তারুণ্যে ভরপুর। যদিও এই দলের ভিতটা গত বিশ্বকাপে গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কোচ লুইস এনরিকেই। কিন্তু সেবার সাফল্যের দেখা পাননি তিনি। বিশ্বকাপ শেষে এনরিকেও সরে দাঁড়ান স্পেনের কোচের আসন থেকে। তাঁর জায়গায় আসা লুইস দে লা ফুয়েন্তে যে দল গড়েছেন, সেটাও বলতে গেলে ওই এনরিকের দলই। তারুণ্যের ছোঁয়াই এই দলের মূলমন্ত্র।
মরোক্কোর সঙ্গে টাইব্রেকারে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার পর স্পেন এ পর্যন্ত হেরেছে মাত্র দুটি ম্যাচ। তবে সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউরো বাছাইপর্বে সর্বশেষ ৬ ম্যাচের সব কটিতেই জিতেছে তারা। ৬ ম্যাচে স্পেন মোট গোল করেছে ২২টি। সম্প্রতি হওয়া দুটি প্রীতি ম্যাচেও ১০ গোলও দিয়েছে তারা। আর লা রোহাদের এমন গোলযাত্রা কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে চলেনি। আক্রমণভাগ থেকে মিডফিল্ডার বর্তমান দলে অনেকেই দলকে গোল এনে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। তাই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে আটকে স্পেনকে গোলবঞ্চিত রাখার কৌশল হয়তো খুব একটা কাজে দেবে না।
দলের খেলোয়াড়দের দিকে যদি তাকাই তাহলে উনাই সিমোনের সঙ্গে গোলবারে থাকবেন আর্সেনালের হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো ডেভিড রায়া। রক্ষণে আছেন অভিজ্ঞ নাচো এবং দানি কারভাহাল। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখানো কারভাহাল এবার দারুণ একটা মৌসুম কাটিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। বায়ার লেভারকুসেনকে লিগ জেতানোর পেছনে অন্যতম বড় অবদান রাখা গ্রিমালদোও আছেন ফুলব্যাকে। রক্ষণের প্রধান ভূমিকায় থাকবেন সৌদি প্রো লিগে পাড়ি জমানো লাপোরত আর রিয়াল সোসিয়াদাদের রবিন লে নরমান্দ অথবা অ্যাথলেটিকো বিলবাওয়ের দানিয়েল ভিভিয়ান। মাঝমাঠে বার্সেলোনার পেদ্রির সঙ্গে জুটি বাঁধবেন ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি। এ ছাড়া নাম্বার সিক্স অথবা এইটের ভূমিকায় খেলার যোগ্যতা রাখেন মেরিনো, জুবিমেন্দি, বায়েনা আর রুইজ। আক্রমণে স্ট্রাইকার হিসেবে মোরাতার দুই পাশে থাকবেন নিকো উইলিয়ামস আর লামিন ইয়ামাল। তাদের সঙ্গী হিসেবে ওয়ারসাবালদের পাশাপাশি নাম্বার টেনের ভূমিকায় দানি অলমো তো রয়েছেনই। তাই স্পেনের আকাশে তারার কমতি নেই। কিন্তু সমস্যা হতে পারে এই তারুণ্যের আধিক্যে। বড় দলের সামনে যে সমস্যা গত বিশ্বকাপে তাদের ভুগিয়েছিল। তবে পুরো দল একটি নির্দিষ্ট ছন্দে খেলতে পারলে, স্পেন এই ইউরোতে লম্বা একটা পথ পাড়ি দিতে পারবে বলেই মনে করছেন ফুটবলবোদ্ধারা। যদিও তারা কত দূর যাবে, এবার সেটা প্রমাণিত হয়ে যাবে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে প্রথম ম্যাচেই।
স্পেনের জয়যাত্রা প্রথমেই যারা থামিয়ে দিতে পারে, তাদের নাম ক্রোয়েশিয়া। সর্বশেষ দুই বিশ্বকাপের একটিতে তারা খেলেছে ফাইনাল আর অন্যটিতে পৌঁছেছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ার পর খুব বেশি ম্যাচ হারেনি দলটি। ইউরো নেশনস লিগে স্পেনের কাছে হারের পর ইউরোর বাছাইপর্বে হেরেছিল তুরস্ক আর ওয়েলসের সঙ্গে। ইউরোর আগে শেষ পাঁচটি প্রীতি ম্যাচেও টানা জয়ের পাশাপাশি সম্প্রতি পর্তুগালকেও হারিয়েছে তারা।
ইতালির লড়াইটা বেশ পুরোনো। ২০২০-এর ইউরোতে ইতালিই টাইব্রেকারে স্পেনকে হারিয়ে দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ইউরোর ঘটনাও একই। সেবার স্পেন হেরেছিল ২-০ গোলের ব্যবধানে। আবার ২০১২ সালের ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে টানা দুটি ইউরো জিতেছিল স্পেন। ২০০৮ সালের ইউরোতেও মুখোমুখি দেখা হয়েছিল তাদের।
পেরিসিচ, মদ্রিচ, কোভাচিচ, রাকিটিচ, ব্রোজোভিচ, মানজুকিচদের নিয়ে ক্রোয়াটদের যে প্রজন্ম শুরু হয়েছিল, সেই প্রজন্ম এখন প্রায় শেষের দিকে। ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন অনেকেই, মদ্রিচও হয়তো জাতীয় দলের হয়ে অবসর নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে। তাই শেষবারের মতো চমক দেখানোর সুযোগ এখন তাঁদের কাছে। কোচ দালিচও এই দলের সঙ্গে রয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। বর্তমান দলটাও আসলে তাঁর হাতেই গড়া। তাই এবারও ক্রোয়াটরা বিশেষ কোনো চমক দেখালে অবাক হবে না ফুটবল-বিশ্ব।
ক্রোয়াটদের দলের গোলবার সামলাবেন গত বিশ্বকাপের টাইব্রেকারের নায়ক লিভাকোভিচ। রক্ষণে সদ্য প্রিমিয়ার লিগ জেতা ভারদিওল, ভিদা, জুরানোভিচ এবং সুতালোর পাশাপাশি বিশেষভাবে চোখ রাখা উচিত স্টানিসিচের প্রতি। বায়ার্ন মিউনিখের এই ফুলব্যাক এবার ধারে দুর্দান্ত একটি মৌসুম কাটিয়েছেন বায়ার লেভারকুসেনের হয়ে। মধ্যমাঠে কোভাসিচ, মদ্রিচ, ব্রজোভিচের সঙ্গে থাকছেন মারিও পাসালিচ। আক্রমণে তাদের দীর্ঘদিনের সৈনিক ইভান পেরেসিচ থাকছেন এবারও। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষবেলায় এসে এসিএল ইনজুরির পর পেরিসিচ পুরো ইউরোতে কতটা ফিট থাকবেন, সেটা ভাবাচ্ছে কোচ দালিচকে। ক্রামারিচ ছাড়া আক্রমণভাগে গোল করার মতো খেলোয়াড়ের অপর্যাপ্ততা রয়েছে দলে। তাই এই ক্রোয়াটদের দলে এবার আক্রমণভাগটাই বেশি দুর্বল।
গ্রুপ অব ডেথের তৃতীয় দেশ গত বিশ্বকাপেও মূল পর্বে জায়গা নিতে না-পারা ইতালি। হয়তো এবার তাদের ফেবারিটদের মধ্যে জায়গা দিতে চাইবেন না অনেকেই, তবে মনে রাখা জরুরি ইতালি কিন্তু বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন। গত নেশনস লিগে ইতালি হেরেছিল স্পেনের কাছে। ইউরো বাছাইপর্বেও ইংল্যান্ডের কাছে দুবার হারার পর পয়েন্ট হারিয়েছে ইউক্রেন আর নর্থ মেসিডোনিয়ার সঙ্গে। ইউক্রেনের সঙ্গে যৌথভাবে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে তারা বাছাইপর্ব উতরে গেছে একমাত্র ভাগ্যের জোরে। নয়তো আর একটু হলেই সরাসরি মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়ার বদলে খেলতে হতো প্লে-অফ। তবে ইউরোর আগে শেষ পাঁচ প্রীতি ম্যাচে সব কটিতেই জিতেছে ইতালি। তাই বলা যায়, মূল পর্ব শুরুর আগে দলের এই ফর্ম কিছুটা হলেও আশা জাগাবে ইতালীয় সমর্থকদের মধ্যে।
নাপোলিকে ২২-২৩ মৌসুলে ইতালিয়ান লিগ জেতানো কোচ লুসিয়ানো স্পালোত্তির আন্তর্জাতিক কোচ হিসেবে এটাই প্রথম বড় টুর্নামেন্ট। তবে স্পালোত্তি যে দলটা নিয়ে মূল আসরে যাচ্ছেন, সেটাও নেহাত মন্দ না। গোলবারে থাকবেন পিএসজির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোনারুমা। রক্ষণে ইন্টারের বাসতোনি, ডি মারকোদের পাশাপাশি এবার একাদশে চমক হিসেবে শুরু করতে পারেন তোরিনোর ফুলব্যাক বেল্লানোভা। মধ্যমাঠে আছেন বারেল্লা আর জরজিনহো। ইন্টারের হয়ে সদ্য লিগ জেতা ফ্রাত্তেসিও থাকতে পারেন তাদের সঙ্গে। গত ইউরোতে দুর্দান্ত খেলা ফেদ্রিকো কিসেয়ার প্রতি এবারও তাকিয়ে থাকবে ইতালিয়ান সমর্থকেরা।
তবে দলের সবচেয়ে দুর্বল দিক একজন নাম্বার নাইনের অভাব। রাস্পাদোরি, রেতেগুই এবং স্কামাক্কা আছেন বটে, কিন্তু তাদের কেউই ফর্মের বিবেচনায় ধারাবাহিক নন। রেতেগুই ধারাবাহিকভাবে একসময় গোল করলেও সম্প্রতি ফর্ম হারিয়েছেন। তা ছাড়া স্কামাক্কা আতালান্তার হয়ে বেশ ভালো একটা মৌসুম কাটালেও প্রায় সময়ই জাতীয় দলের হয়ে তাঁর পারফরম্যান্স ফিকে হয়ে যায়। তাই একজন নাম্বার নাইন না থাকার জন্য ইউরোর মঞ্চে কোচ স্পালোত্তিকে কিছুটা হলেও ভাবাবে।
স্পেন, ইতালি আর ক্রোয়েশিয়ার মতো হেভিওয়েট দেশের সামনে আলবেনিয়ার নাম অনেকটা ঢাকাই পড়ে যায়। তবে আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নামা আলবেনিয়াকে ছোট করে দেখারও কিছু নেই। ইউরোর বাছাইপর্বে তারা হারিয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ডের মতো দলকে। সম্প্রতি প্রীতি ম্যাচেও লিখস্টাইনার এবং আজারবাইজানকে হারিয়েছে। গোলবারের নিচে এমপোলির গোলরক্ষক বেরিশা তাদের অন্যতম আস্থার নাম। দলের বেশ কয়েকজন ডিফেন্ডার খেলেন ইতালিয়ান প্রথম লিগে। তাদের অভিজ্ঞতা বড় মঞ্চে বেশ কাজে দেবে। মাঝমাঠে রয়েছেন ইন্টারের আসলানি। আর প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন চেলসির ব্রোহা।
এবার হেড টু হেডে এই চার দলের পরিসংখ্যানটা একনজর দেখে নেওয়া যাক। বিশ্বকাপের মঞ্চে বরাবর দুর্দান্ত খেললেও ইউরোতে ক্রোয়েশিয়ার পারফরম্যান্সে কিছুটা হলেও বাকি সবার থেকে পিছিয়ে। স্পেনের বিপক্ষে তারা ইউরোতে জিতেছে মাত্র একবার। আর নিজেদের ছয়বারের দেখায় তারা মোট হেরেছে চারবার। অন্যদিকে বিশ্বকাপ আর ইউরো মিলিয়ে ইতালির বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার জয় মাত্র ১টিতে। আর আলবেনিয়ার সঙ্গে এই প্রথমবার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া।
এদিকে ইউরোতে স্পেন আর ইতালির লড়াইটা বেশ পুরোনো। ২০২০-এর ইউরোতে ইতালিই টাইব্রেকারে স্পেনকে হারিয়ে দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ইউরোর ঘটনাও একই। সেবার স্পেন হেরেছিল ২-০ গোলের ব্যবধানে। আবার ২০১২ সালের ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে টানা দুটি ইউরো জিতেছিল স্পেন। ২০০৮ সালের ইউরোতেও মুখোমুখি দেখা হয়েছিল তাদের। নকআউট পর্বে সেবার টাইব্রেকারে ইতালিকে হারিয়েছিল স্পেন। তাই বোঝাই যাচ্ছে, বহু পুরোনো এই প্রতিপক্ষের লড়াইটা বেশ হাড্ডাহাড্ডি হতে যাচ্ছে। এদিকে আলবেনিয়ার সঙ্গে স্পেন কখনো হারেনি। যদিও ইউরোর মঞ্চে এই প্রথমবার দেখা হচ্ছে তাদের। একই কথা ইতালির জন্যও প্রযোজ্য। মোট চারবার মুখোমুখি লড়াইয়ের একবারও ইতালিকে হারাতে পারেনি আলবেনিয়া।
গ্রুপ বি এর ম্যাচগুলো:
রাউন্ড এক:
স্পেন বনাম ক্রোয়েশিয়া — ১৫ জুন (রাত ১০টা)
ইতালি বনাম আলবেনিয়া —১৬ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড দুই:
ক্রোয়েশিয়া বনাম আলবেনিয়া —১৯ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
স্পেন বনাম ইতালি — ২১ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড তিন:
ক্রোয়েশিয়া বনাম ইতালি —২৫ জুন (রাত ১টা)
আলবেনিয়া বনাম স্পেন —২৫ জুন (রাত ১টা)