ইব্রাহিমোভিচের উত্তরসুরি কে এই ইসাক

স্টেডিয়ামের প্রতিটি প্রান্ত থেকে যখন চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ওয়েম্বলির দেওয়ালে, ডাগ আউট থেকে যখন সাদা-কালো স্রোত তেড়ে আসছিল তাঁর দিকে, অ্যালেকজেন্দার ইসাকের কি একবারও দেজা ভ্যু হয়েছিল? হওয়ার কথা। এমন উল্লাস তো ইসাক আগেই দেখেছেন, একেবারে রাজসাক্ষী হয়ে। দেশটা ভিন্ন, রংটা ভিন্ন। ভিন্ন নয় শুধু উল্লাস, ভিন্ন নয় শুধু প্রাপ্তির আনন্দ। বহু বছরের সাধনা শেষে ‘অবশেষে আমি তাহাকে পাইলাম’ বলে যে আনন্দ, দেশ, জাতি, ভাষাভেদে তা সর্বদাই অভিন্ন। সুইডিশ তরুণের কাছে সেই উচ্ছ্বাস বড্ড পরিচিত।

গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সুইডেন নামটা শুনলেই একটা নাম চোখের সামনে ভাসতো– জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। ফুটবলের ফেরিওয়ালা ছিলেন তিনি। এমন কোনো লিগ নেই খেলেননি, এমন কোনো শিরোপা নেই জেতেননি। যেখানে গিয়েছেন, শিরোপার বাম্পার ফলন হয়েছে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে। তাবত দুনিয়ার হেভিওয়েট ক্লাবে ছিল তাঁর পদচারণা। তিনি যখন জাতীয় দলকে বিদায় বললেন, তখনই সুইডেনে পদচারণা ঘটল নতুন এক তারকার। তার মতোই দেহের গড়ন, লম্বায়ও কাছাকাছি। জ্লাতান সুইডেনের ভার ছেড়ে দিয়েছেন ইসাকের হাতে। ইসাকও জ্লাতান হননি, নিজেকে গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে।

ইসাক নিজেকে গড়ে তুলেছেন জ্লাতানের ছাঁচে
ছবি: এক্স

ইসাকের অভিষেক হয়েছিল সুইডিশ ক্লাব এআইকের জার্সিতে। সেখান থেকে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। রিয়াল, বার্সা, ইউনাইটেডের অফার ফিরিয়ে যোগ দিয়েছিলেন জার্মান হলুদ দেওয়ালে। ভেবেছিলেন এখান থেকেই হয়তো ডানা মেলবেন আকাশে। তার আশেপাশের সবাই তো ডানা মেলেছে এই হলুদ-কালো পতাকাতলে, তিনি কেন পারবেন না? কিন্তু বুরুশিয়া ইসাকের জীবনে হয়ে এসেছিল এক দুঃস্বপ্ন। তার সঙ্গে দলে ছিলেন উসমান ডেমবেলে, জ্যাডোন সানচো, অবামেয়াংরা। তাদের ভিড়ে ঠিক জ্বলে উঠতে পারেননি তিনি। সানচো, ডেমবেলে যখন আলো ছড়িয়েছেন বরুশিয়ার জার্সিতে, ঠিক তার নিচেই পাদপ্রদীপের আলোর আড়ালে বড় হয়েছেন ইসাক। বরুশিয়ায় ছিলেন দুই মৌসুম, এর মধ্যে এক বছর কাটিয়েছেন ধারে। হলুদ জার্সিতে ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়েছে মাত্র ৫টি।

আরও পড়ুন
দুই দলের কেউই রাজি ছিল না দর্শকদের ছাড়া ম্যাচ খেলতে। তাই পাক্কা ৩৪১ দিন পর মাঠে গড়াল ফাইনাল। কিন্তু ততদিনেও মাথার ওপর থেকে বাধা সরেনি, মাঠে উপস্থিত ছিল না কোনো দর্শক।
শিরোপা জিতলেও ইসাক বরাবরই ছিলেন উপেক্ষিত
ছবি: এক্স

তাই তো প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র ঝাঁপিয়ে পরলেন ভিন্ন নৌকায়। গন্তব্য স্পেন, রিয়াল সোদিয়াদাদ। স্পেনের বিশাল ফুটবল ইতিহাসে সোসিয়াদাদের নামটা শোনা যায় কালেভদ্রে। মিড টেবিলে তাদের আনাগোনা বেশি, কয়েকবার জায়গা করে নিতে হয়েছে সেকেন্ড ডিভিশনেও। কালেভদ্রে সুযোগ হয় ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যে পারি দেওয়ার। সেই আশির দশকে সুনাম ছিল তাদের। এরপর থেকে ট্রফি কেবিনেটে শুধু ধুলোই জমেছে, মাঝে একটা সেকেন্ড ডিভিশনের শিরোপা; প্রমোশনে শিরোপা দিয়ে কি আর মন ভরে? বড় শিরোপার খোঁজে পেরিয়ে গিয়েছে ৩৩ বছর। নীল-সাদা শিবিরে আশীর্বাদ হয়ে এলেন ২০ বছর বয়সী ইসাক। অভিষেক হলো গোল দিয়ে, বাস্ক ডার্বি থেকে শুরু করে কোপা দেল রেতে রিয়াল মাদ্রিদ; ইসাক যেন সোসিয়েদাদে এসেছেন নিজের রাজত্ব বুঝে নিতে। তার পারফরম্যান্সের দরুণ ৩১ বছর পর কোপা দেল রে ফাইনালে নিজেদের খুঁজে পেল সোসিয়েদাদ।

অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। সেমি ফাইনালের পর পরই পত্রপাঠে বন্ধ হয়ে গেল বিশ্ব। করোনার আঘাতে জর্জরিত বিশ্বে না ছিল বাইরে যাওয়ার অনুমতি, না ছিল খেলাধুলার সুযোগ। অদ্ভুত এক বন্দি দশায় পরল সোসিয়েদাদের সমর্থকেরা। মনের মাঝে চাপা ভয় ঢুকে গেল, ৩৩ বছর পর শিরোপার এত কাছাকাছি, ছুঁয়ে দেখা কি আর হবে না?

৩৩ বছর পর শিরোপার খোঁজ মিলল ইসাকের হাত ধরে
ছবি: এক্স

দুই দলের কেউই রাজি ছিল না দর্শকদের ছাড়া ম্যাচ খেলতে। তাই পাক্কা ৩৪১ দিন পর মাঠে গড়াল ফাইনাল। কিন্তু ততদিনেও মাথার ওপর থেকে বাধা সরেনি, মাঠে উপস্থিত ছিল না কোনো দর্শক। দর্শকবিহীন এক ফাইনালে বিলবাওকে হেসেখেলে হারিয়ে দিল সোসিয়াদাদ। খালি মাঠে মিকেল মোরেনোর গোলটাই যথেষ্ট ছিল বিলবাওকে আটকে দিতে। ফাইনালটা মনমতো না গেলেও ইসাক ছিলেন সকলের মনে। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় আর সর্বোচ্চ গোলদাতা, দুটো ট্রফিই ছিল তাঁর দখলে। বাস্ক অঞ্চলের ‘চুরি-উর্দিন’রা ৩৩ বছর পর শিরোপার আনন্দে মাতলেন ইসাকের হাত ধরে। ইসাক মৌসুম শেষ করেছিলেন দলকে ষষ্ঠ অবস্থানে রেখে। সোসিয়েদাদের ইউরোপা নিশ্চিত করে চললেন ইউরোপ ‘এক্সপ্লোর’ করতে।

আরও পড়ুন
এডি হাউ জানতেন, ঠিক তুরুপের তাসেই ভরসা করেছেন তিনি। অশ্রুসিক্ত সে ফাইনাল হারতে হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে। কিন্তু এডি হাউ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন, ইসাককে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে।

নিউক্যাসল ইউনাইটেডের হাতে তখন কাঁচা টাকা। মাত্রই সৌদি মালিকানার অধীনে এসেছে তারা। হাতিঘোড়া কেনার এখনই তো উপযুক্ত সময়। কিন্তু নিউক্যাসল দল গড়েছিল নিজেদের প্রয়োজন বুঝে। যে কারণে টাকার বস্তা নিয়ে সোসিয়েদাদে হাজির হয়েছিল ম্যাগপাইরা, লক্ষ্য ইসাককে ছিনিয়ে নেওয়া। সোসিয়েদাদও আপত্তি করেনি, ৬৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে নিউক্যাসলে যোগ দিলেন ইসাক। সুইডিশ তারকা ম্যাগপাইদের ভরসার পাত্র হয়ে উঠলেন দ্রুতই। দলবদলের সব রেকর্ড ভাঙা ইসাক অভিষেকেই গোল করে জানান দিলেন, তিনি এসেছেন নিউক্যাসলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে। কিন্তু দুই ম্যাচ যেতে না যেতেই হানা দিলো চোট, সাইডলাইনে চলে গেলেন লম্বা সময়ের জন্য। কিন্তু কোচ এডি হাউ তার উপর থেকে আস্থা হারাননি এক মুহূর্তের জন্য। চোট থেকে ফিরেই সরাসরি দলে, অতঃপর চমকের সূচনা। তার ১০ গোলের উপর ভর করেই ২২ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরে নিউক্যাসল। তার বানিয়ে দেওয়া গোলে ২৪ বছর পর কোনো ইংলিশ টুর্নামেন্টের ফাইনাল নিশ্চিত করে ম্যাগপাইরা।

সমর্থকদের সকল ভরসা যেন ইসাকেই
ছবি: এক্স

এডি হাউ জানতেন, ঠিক তুরুপের তাসেই ভরসা করেছেন তিনি। অশ্রুসিক্ত সে ফাইনাল হারতে হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে। কিন্তু এডি হাউ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন, ইসাককে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। পরের মৌসুমে ইসাকের পা থেকে এল ২৫ গোল। দলগত অর্জন খুব একটা বলার মতো ছিল না, কিন্তু ইসাককে নিয়ে যে ভীতিজাগানিয়া আক্রমণভাগ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তাতে হাউ সফল ছিলেন শতভাগ। এরপরই স্বপ্নের মতো হাজির হলো ২৪-২৫ মৌসুম। দূর্দান্ত ফর্ম বললেও যেন কম বলা হয়ে যাবে। ২৫ ম্যাচে ১৯ গোল, প্রিমিয়ার লিগের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। এক ম্যাচ কম খেলে আছে ষষ্ঠ অবস্থানে, ইউরোপে খেলার স্বপ্ন চোখে মুখে স্পষ্ট। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছে কারাবাও কাপ। দুই বছর আগে যে ফাইনাল থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছিল ম্যাগপাইদের। সেই ফাইনালে আবারও তারা। এবার প্রতিপক্ষ পুরোনো প্রতিপক্ষের চিরশত্রু, লিভারপুল। এই মৌসুমের ফর্ম দিয়ে বিবেচনা করলে লিভারপুলের থেকে কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল না আর একটাও। লিগে মাত্র একটা হার, দূর্দান্ত ফর্মে বাকি খেলোয়াড়েরা। সব মিলিয়ে অল রেডসদের হারানোর স্বপ্ন দেখাটাও ছিল যেন ভুল।

আরও পড়ুন
শেষ মুহুর্তে ফেদেরিকো কিয়েসার গোলটা শুধু আক্ষেপ মিটিয়েছে অল রেডসদের। ইসাকের শিরোপাযাত্রা ম্লান করতে পারেনি বিন্দুমাত্র। ৭০ বছপ্র পর আবারও নিউক্যাসলজুড়ে উল্লাস বয়েছে, ইসাকের হাত ধরে।

এর মধ্যে শাপেবর হয়ে এল পিএসজির বিপক্ষে লিভারপুলের হার। এমন এক হার বিশাল ধাক্কা দিল তাদের মনোবলে। উল্টোপিঠে ভয়ও ছিল, যদি তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে প্রতিশোধটা নিউক্যাসলের উপর চাপিয়ে দেয় তারা? সকল ভয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন ইসাক। আগের ফাইনালে ৪৫ মিনিট খেলেও কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। এবার আর সেটা হতে দিচ্ছেন না। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে ম্যাগপাইদের এগিয়ে নেন ড্যান বার্ন। আর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন অ্যালেকজেন্দার ইসাক। গোল করেই শুধু থেমে ছিলেন না, উদযাপনটাও ছিল দেখার মতো। আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, দেখো দেখো, এই লিভারপুল নাকী অপরাজেয়। নিউক্যাসলের ট্রফি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সেই গোলের পরই।

তাচ্ছ্বিল্যের হাসি ইসাকের ঠোঁটে
ছবি: এক্স

এরপর আর ম্যাচে ফেরা হয়নি তাদের। শেষ মুহুর্তে ফেদেরিকো কিয়েসার গোলটা শুধু আক্ষেপ মিটিয়েছে অল রেডসদের। ইসাকের শিরোপাযাত্রা ম্লান করতে পারেনি বিন্দুমাত্র। ৭০ বছপ্র পর আবারও নিউক্যাসলজুড়ে উল্লাস বয়েছে, ইসাকের হাত ধরে। সাদা-কালো পদযাত্রায় সামিল হয়েছেন তিনিও। নিউক্যাসল সমর্থকরা ভুল মানুষকে মুকুট পরায়নি, ভুল মানুষে বিশ্বাস করেনি তার প্রমাণ ইসাক দিয়েছেন বারংবার। তাই তো বারবার ঘুরে ফিরে সুইডিশ প্রিন্সের নামই উঠে আসে দৃশ্যপটে। সোসিয়েদাদ থেকে নিউক্যাসল, সুইডিশ প্রিন্স গনমানুষের নেতা হয়েছেন। বহুবছর ধরে আটকে থাকা স্বপ্ন পূরণ করেছেন। উল্লাসে মেতেছে স্বপ্ন।

ক্যারিয়ার শেষে ইসাক বড় কেউ হতে পারবেন কী না জানা নেই। কিন্তু সোসিয়েদাদ থেকে নিউক্যাসল; বছরের পর বছর শিরোপার অপেক্ষায় থাকা সমর্থকদের কাছে ইসাক হয়ে থাকবেন এক ধ্রুবতারা, আজীবন।

আরও পড়ুন