ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যর্থতার কারণ কী

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গেলে যেতে হবে অনেক গভীরে। অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার দশা। উইন্ডিজদের আজকের অবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় ক্রিকেট বোর্ডের। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনদের দাম এখনো আকাশছোঁয়া। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে তাঁরা যেন অমাবস্যার চাঁদ। এরপর থেকে নিয়মিতই সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়া খেলছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যার ফলে আজকের এ অবস্থা। মোটাদাগে বলতে গেলে উইন্ডিজের এই ব্যর্থতার পেছনে দায়ী খেলোয়াড়, বোর্ড থেকে শুরু করে সমর্থক সবাই।

বেতন-বিতর্ক

২০১২ সাল থেকেই নিয়মিত বিরতিতেই সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়া মাঠে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এর পেছনে রয়েছে বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মধ্যে বেতন নিয়ে দ্বন্দ্ব। ২০১২ বিশ্বকাপ জয়ের বোনাস সমানভাবে ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড। যার জের ধরে বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। সেদিনই বলেছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড পচে যাচ্ছে। দ্রুত এর সমাধান না হলে ঘোর অন্ধকার আসতে চলেছে আমাদের ক্রিকেটে। ৯ বছর পর অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে ক্লাইভ লয়েডের কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমস্যা কাটেনি একবিন্দু। বরং বেড়েছে।

কিছুদিন পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় চুক্তি থেকে বের করে দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের। ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভোরা ২০১০ সাল থেকেই চুক্তির বাইরে। শুধু বড় টুর্নামেন্টের সময়েই ডাক পড়ে তাঁদের। টুর্নামেন্ট শেষে আইসিসি থেকে প্রাপ্ত অর্থও দিতে ব্যর্থ হয় বোর্ড। বরং খেলোয়াড়দের প্রাপ্ত অর্থ নিজেরাই আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত ছিল তারা। খেলোয়াড়দের কাছে তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা মানে চ্যারিটি করা। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কজনই-বা আসতে চান?

জাতীয়তাবাদ

ওয়েস্ট ইন্ডিজ আলাদা কোনো স্বাধীন দেশ নয়। বরং দ্বীপগুলো নিয়ে গঠিত একটি ক্রিকেট বোর্ড। যে কারণে দেশের জন্য খেলার প্রশ্নে অনেকেই থাকেন উদাসীন। নিজের পুরোটা দিয়ে খেলার পরও যখন টাকাপয়সা নিয়ে গড়িমসি করে বোর্ড, তখন খেলার যেটুকু ইচ্ছে থাকে সেটাও মরে যায়। দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে যদি চোটে পড়েন, তাহলে তো আর কথাই নেই। যেখানে নিজেদের প্রাপ্য বেতন পাওয়াই দুষ্কর, সেখানে চোটের পর তার খরচ পাওয়ার আশা করাও বিলাসিতা। যে কারণেই কি না কাইরন পোলার্ড, ড্যারেন ব্রাভো, সুনীল নারাইনদের কালেভদ্রে দেখা যেত ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে। আর সেটাও আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে। কারণ, আইসিসির টুর্নামেন্টই একমাত্র জায়গা যেখানে টাকাপয়সার কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা বিদ্যমান।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারের পরই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের দৌড় থেকে অনেকটা ছিটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আধিপত্য

জাতীয় দলে যখন নিয়মিত বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন খেলোয়াড়েরা, তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুহাত মেলে। যেখানে টাকাপয়সার ছড়াছড়ি, চোটে পড়লেও ক্ষতি নেই। বেশির ভাগ সময়েই ফ্র্যাঞ্চাইজিই নিচ্ছে চিকিৎসার ভার। সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ঘোরার সুযোগ। ভ্রমণপাগল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের জন্য এর থেকে বড় সুযোগ কীই-বা হতে পারে? দিনে দিনে তাই জাতীয় দল ছেড়ে টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগ দিচ্ছেন খেলোয়াড়েরা। কারণ, জাতীয় দলে অবস্থান যা-ই হোক না কেন, দিন শেষে হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান চাইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়ই ভরসা। তাই তো বিশ্বে উইন্ডিজের খেলোয়াড়দের নাম হয়েছে ‘টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা’।

নতুন নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আগমনে উইন্ডিজের খেলোয়াড়দের এখন রমরমা অবস্থা। যেখানেই নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হচ্ছে, সেখানেই ডাক পড়ছে তাদের। সব ফেলে সেখানেই ছুটছেন তাঁরা। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও আপন করে নিচ্ছে তাঁদের। সব মিলিয়ে জাতীয় দল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেই তাঁদের বেশি টান।

অতিরিক্ত টি-টোয়েন্টির প্রেম

খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত টি-টোয়েন্টি প্রেমই ক্ষতি করেছে দলের—মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে এতটাই ব্যস্ত আর মগ্ন থাকেন তাঁরা, একদিনের ক্রিকেট বা টেস্ট খেলার ধৈর্য অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে। অথচ ১০ বছর আগেও অবস্থাটা এমন ছিল না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ত্রাস হয়েও ক্রিস গেইল নাম কামিয়েছেন সব ফরম্যাটে। মারলন স্যামুয়েলস, কেমার রোচ ছিলেন সব ফরম্যাটের ভরসা। সেখানে হালের শিমরন হেটমায়ার কিংবা রভম্যান পাওয়েলরা বদলে যান ফরম্যাটের সঙ্গে সঙ্গে। আগের মতো খোলস বদলে মানিয়ে নিতে পারেন না ক্রিকেটের সঙ্গে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ কি হারিয়ে যাবে অতল গহিনে?

উইন্ডিজ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা চোখে পড়েছে স্কটল্যান্ড ম্যাচ শেষেই। লজ্জাজনক এক হারের পর এক ড্যারেন স্যামি বাদে কাউকে দেখেই মনে হয়নি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকালের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা। হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছেন নিকোলাস পুরান, শাই হোপরা। অনেকেই মনে করছেন উইন্ডিজ ক্রিকেট ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যদিও খেলোয়াড়েরা হয়তো ভাবছেন, কয়েক দিন পরেই শুরু হতে চলেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, সেখানে তো চড়া মূল্য পাবই। কিন্তু এই বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া যে তাদের দামের ওপরেও প্রভাব ফেলবে, তা এখনো কারও মাথায় আসছে না। এলে হয়তো লাখ লাখ সমর্থককে হতাশ করে হাসিমুখে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতেন না তাঁরা।

এর মধ্যেও ভরসা সেই একজনেই, ড্যারেন স্যামি। যাঁর হাত ধরে দ্বিতীয় স্বর্ণযুগে পা দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তাঁর হাতেই দল সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছে বোর্ড। কিছুদিন আগে এই দায়িত্বটা পেলে হয়তো দলকে আরেকটু ভালোভাবে সাজাতে পারতেন, হয়তো বাছাইপর্বের তরিটাও পার করতে পারতেন। এখন স্যামি তাকাবেন সামনের দিকে। দলের সেরা তারকা নয়, নজর থাকবে দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ খেলোয়াড়ের। দেখা যাক, তরুণ রক্তদের নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় স্বর্ণযুগ তৈরি করতে পারেন কি না ড্যারেন স্যামি। নাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারিয়ে যাবে অতল গহিনে?