লা লিগার যে দলটি ১২৫ বছর কোনো বিদেশি খেলোয়াড় কেনেনি
ফুটবল পছন্দ করেন কিন্তু লা লিগার নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বরং ফুটবল পছন্দ করেন না, কিন্তু এই লিগের নাম শুনেছেন, এমন মানুষ ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। মেসি, রোনালদো কিংবা নেইমারের কল্যাণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এই লিগ বেশ জনপ্রিয়। স্পেনের পেশাদার ফুটবল ক্লাবগুলো নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্টের নাম লা লিগা। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টের একটা দল অ্যাথলেটিক বিলবাও। ১২৫ ধরে বিদেশি খেলোয়াড় ছাড়াই খেলছে দলটি। কিন্তু কেন?
লা লিগার প্রতিটি দল শিরোপা জেতার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বিদেশি খেলোয়াড় কেনে। কোটি কোটি ইউরো খরচ করে বিশ্বের নানা দেশের খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ায় দলগুলো। ব্যতিক্রম শুধু বিলবাও। এর পেছনে কারণ আছে। অনেকটা রাগ করেই বিলবাও কোনো বিদেশি খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় না।
স্পেন ও ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চলের নাম বাস্ক। প্রায় ৩১ লাখ মানুষ বাস করেন এখানে। এই অঞ্চলে মূলত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও অভিবাসী শ্রমিকেরা বাস করতেন। ফুটবল ছিল তাঁদের বিনোদনের মাধ্যম। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বাস্কদের ফুটবলের সঙ্গে টাকাপয়সার কোনো সম্পর্ক ছিল না। শুধু আনন্দের জন্য নিজেরা দলে ভাগ হয়ে খেলত, যেমনটা তোমরা স্কুলে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলো। ধীরে ধীরে তাদের ইচ্ছা হলো একটা ফুটবল ক্লাব তৈরি করার। তারা বিলবাও ফুটবল ক্লাব নামে একটা ক্লাব চালু করল।
এ সময় বাস্ক অঞ্চলের অল্প কিছু শিক্ষার্থী পড়ালেখা করতেন। পড়ালেখা করতে অনেককেই যেতে হতো ইংল্যান্ডে। জুয়ান অ্যাস্টোরকিয়া তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর সঙ্গে তখন আরও পাঁচ ছাত্র ইংল্যান্ডে ছিলেন। তাঁরাই দেশে ফিরে ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নিলেন। ১৯০১ সালে এই ছাত্ররা একটা ফুটবল ক্লাব তৈরি করেন। নাম দিলেন অ্যাথলেটিক ক্লাব।
১৯০২ সালে রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসোর রাজ্যাভিষেক হয়। তা উদ্যাপন করতে বিলবাও ফুটবল ক্লাবের সভাপতিসহ আরও কিছু মানুষ একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করার কথা বলেন। রাজি হন রাজা। ১৯০২ সালে গঠিত হয় কোপা দেল রে টুর্নামেন্ট। সেখানে অংশগ্রহণের জন্য বিলবাও ফুটবল ক্লাব ও অ্যাথলেটিক ক্লাব এক হয়ে নাম দেয় ক্লাব বিজকায়া। দলটি ফাইনালে চলে যায়। ২-১ গোলে এফসি বার্সেলোনাকে হারিয়ে কোপা দেল রের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলে ক্লাব বিজকায়া।
কিন্তু দুই দল মিলে গঠিত ক্লাব বিজকায়ার ভবিষ্যৎ ভালো যায়নি। অল্প দিনেই দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। সাধারণ কর্মচারীদের গড়া বিলবাও ফুটবল ক্লাব ও শিক্ষার্থীদের গড়া ক্লাব অ্যাথলেটিক আলাদা হয়ে যায়। সবাই নিজের মতো দল গঠন করে আবার খেলা শুরু করে। দেশি খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বিদেশি খেলোয়াড়েরাও খেলতেন তখন।
ঝগড়ার প্রায় ৯ বছর পর ১৯১১ সালে কোপা দেল রেতে দুই দল মুখোমুখি হয়। চ্যাম্পিয়ন হয় বিলবাও। কিন্তু ক্লাব অ্যাথলেটিক অভিযোগ তোলে, বিলবাও অবৈধ বিদেশি খেলোয়াড় খেলিয়েছে। ফলে বিলবাওয়ের শিরোপা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। যদিও পরে তা বিলবাওকে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু টুর্নামেন্ট কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, ভবিষ্যতে এই টুর্নামেন্টে কোনো বিদেশি খেলোয়াড় খেলতে পারবেন না। শুধু স্প্যানিশ নাগরিকরাই এখানে খেলতে পারবেন। কমিটির এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনেও কারণ ছিল। ওই দশকে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ফলে বিদেশি খেলোয়াড়েরা নিজ দেশে চলে যেতে থাকেন। আর এই সুযোগে ওই সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি।
পরে কমিটি এই সিদ্ধান্ত উঠিয়ে নিলেও বিলবাও তখন থেকে আর কোনো দিন বিদেশি খেলোয়াড় কেনেনি। সেই বিলবাও ক্লাবটির বর্তমান নাম অ্যাথলেটিক বিলবাও। আর শিক্ষার্থীদের গড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবটি এখন আতলেতিকো মাদ্রিদ নামে খেলে। তবে অ্যাথলেটিক বিলবাও কিন্তু এখনো অ্যাথলেটিক ক্লাব নামে পরিচিত।
এবার বর্তমানে ফেরা যাক। বিলবাও এখনো আগের নিয়ম জারি রেখেছে। কোনো বিদেশি খেলোয়াড় এ দলে খেলতে পারেন না। শুধু যাঁরা বাস্ক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন কিংবা বেড়ে উঠেছেন, তাঁরাই ওই ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পান। তবে এখন এই নিয়ম কিছুটা সহজ করেছে দলটি। যদি কারও বাবা কিংবা মা ওই অঞ্চলে বড় হন, তাহলে তিনিও বিলবাওয়ের হয়ে খেলতে পারবেন।তোমরা যদি কেউ বর্তমান বিলবাও দলে ঢুঁ মারো, তাহলে দেখবে একজন বিদেশি খেলোয়াড় রয়েছে দলটিতে। ফরোয়ার্ড ইনাকি উইলিয়ামস। ঘানার খেলোয়াড়। তিনি দলে জায়গা পেয়েছেন তাঁর মায়ের কারণে। কারণ, তাঁর মা বাস্ক অঞ্চলে বড় হয়েছেন। এই ইনাকি উইলিয়ামস এবং নিকো উইলিয়ামস আপন দুই ভাই। চলতি ইউরোতে যারা নিকো উইলিয়ামসের খেলা দেখেছ, তারা নিশ্চই বুঝবে সে কত বড় মাপের খেলোয়াড়। সম্প্রতি বার্সেলোনা ও পিএসজি তাঁকে দলে পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু নিকো বিলবাওতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধন্ত নেন মূলত তাঁর ভাই ইনাকির জন্য। যাহোক উইলিয়ামসদের বাবা ঘানার নাগরিক। তাই দুই ভাই দুই দেশের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। ইনাকি বাবার দেশ ঘানার হয়ে আর নিকো মায়ের দেশ স্পেনের হয়ে।
এখন তোমাদের মাথায় একটা প্রশ্ন আসতে পারে। গোঁড়ামি করে বিদেশি খেলোয়াড় না কিনে বিলবাওয়ের কি কোনো লাভ হচ্ছে? সমীকরণ দেখলে বুঝতে পারবে। এখন পর্যন্ত স্প্যানিশ দলগুলোর মধ্যে তৃতীয় সেরা দল বিলবাও। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার পর বিলবাও সবচেয়ে বেশি শিরোপা জিতেছে। কোপা দেল রে লিগে বার্সেলোনার পর দ্বিতীয় সফলতম দল বিলবাও। বার্সেলোনা ৩১ বার বিজয়ী আর বিলবাও ২৪ বার। তবে দুটি দল ফাইনাল খেলেছে যথাক্রেম ৪২ ও ৪০ বার। ফলে শুধু দেশি খেলোয়াড় নিয়েও যে বিলবাও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি, তা বোঝাই যায়। বিপরীতে কোটি কোটি ইউরো খরচ করে দল গঠন করা আতলেতিকো মাদ্রিদ বিজয়ী হয়েছে ১০ বার। যদিও ১৯৮৪ সালের পর বিলবাও আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তবে ২০২১ সালে শেষবার সুপার কাপে চ্যাম্পিয়ন ও ২০২৩–২৪ সেশনে কোপা দেল রে জিতেছে দলটি। সেমিফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদকে হারিয়েছে ৪-০ গোলে।
শুধু দেশি খেলোয়াড় খেলানোর আরেকটি সুবিধা আছে। সেই সুবিধা অবশ্য পায় স্পেন এবং বিশ্বের অন্যান্য ক্লাব। শুধু বাস্ক অঞ্চলের খেলোয়াড় দলে নেওয়ার কারণে অনেক অল্প বয়সেই দলে জায়গা পান ভালো খেলোয়াড়েরা। যেমন নিকো উইলিয়ামস। অল্প বয়স থেকে তাঁকে তৈরি করেছে বিলবাও। এখন স্পেন জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন তিনি। ফলে জাতীয় দল এই সুবিধা ভোগ করছে। আবার নিকো যদি বার্সেলোনা কিংবা পিএসজিতে চলে যেতেন, তাহলে তারাও সুবিধা ভোগ করত। বিলবাওকে আবার নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে হতো। এখন নিকো কত দিন বিলবাওতে থাকেন, তা দেখার বিষয়।
বিলবাওয়ের হয়ে খেলে পরে বিখ্যাত হয়েছেন—এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন আরিৎজ আদুরিজ, জুলেন লোপেজ, দানি রুইজ, রাফায়েল আরানজাদি, তেলমো জারা, ইকার মুনিয়াইন, মার্কেল সুসায়েতার মতো খেলোয়াড়েরা। বিলবাও যত দিন এই নিয়ম বজায় রাখবে, তত সমৃদ্ধ হবে স্পেনের জাতীয় দল। বাড়বে বিশ্বমানের খেলোয়াড়!
সূত্র: ওয়ান ফুটবল ডটকম, টপ স্কোর ডটকম, স্পর্টস্টার ডটকম, ফুটমব ডটকম