এখনকার যুগের গোলকিপাররা যে গোলপোস্ট ছেড়ে এসে খেলার ‘বিল্ড আপ’-এ অংশ নেন, গোলকিপার হয়েও আক্রমণের সূচনা করেন, আগেকার দিনের ফুটবল কিন্তু এমনটা ছিল না। ষাটের দশক পর্যন্ত গোলকিপার তো বটেই, ডিফেন্ডারদেরও কাজ ছিল কেবল বিপক্ষের আক্রমণ আটকানো। ডিফেন্ডার হয়েও সেই ধারণার পরিবর্তন শুরু করেছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ৭ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেছেন এই জার্মান কিংবদন্তি।
বেকেনবাওয়ারের জন্ম জার্মানির মিউনিখ শহরে, ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিউনিখ তখন ধ্বংসস্তূপ। বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। ছেলে বড় হলে সংসারের হাল ধরবে—এমনই স্বপ্ন ছিল তাঁর। খেলাধুলায় ক্যারিয়ার গড়ুক তা চাননি তিনি। তারপরও ফুটবলকেই বেছে নিলেন বেকেনবাওয়ার। মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৯০৬ মিউনিখ ক্লাবের যুবদলে খেলার সুযোগ পান তিনি। এই ক্লাবের হয়েই খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেকেনবাওয়ার। বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক দুরবস্থা। আর্থিক সংকটে ক্লাব যখন দেউলিয়া প্রায়, তখন শহরের অন্য ক্লাব ১৮৬০ মিউনিখের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কর্তৃপক্ষ। দুই ক্লাব একত্রিত হওয়ার আগে আয়োজন করা হলো দুই ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১৪ দলের মধ্যকার এক প্রীতি ম্যাচের। সেখানে ১৮৬০ মিউনিখের এক খেলোয়াড় চড় মেরে বসেন বেকেনবাওয়ারকে। রাগ করে বেকেনবাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর খেলবেন না এই ক্লাবে। যোগ দেবেন শহরের আরেক ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। ১৮৬০ মিউনিখ তখনো জানত না, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কে হারাতে চলেছে তারা।
তখনো জার্মান ফুটবলের জায়ান্ট হয়ে ওঠেনি বায়ার্ন মিউনিখ। ১৯৬৩ সালে জার্মানির বিভিন্ন আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে শুরু হয় বুন্দেসলিগা। শর্ত ছিল, এক শহর থেকে দুই দল বুন্দেসলিগায় জায়গা পাবে না। তাই মিউনিখ থেকে জায়গা পায় তখনকার চ্যাম্পিয়ন ১৮৬০ মিউনিখ। তবে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি বেকেনবাওয়ারকে। পরের মৌসুমেই বুন্দেসলিগায় জায়গা করে নেয় তাঁর দল বায়ার্ন মিউনিখ। আর বুন্দেসলিগার প্রথম মৌসুমেই লিগে তৃতীয় হওয়ার পাশাপাশি ক্লাবটি জিতে নেয় জার্মান কাপ। এই দলের ভিত্তি মূলত তিনজন। ‘বোম্বার’ নামে খ্যাত স্ট্রাইকার জার্ড মুলার, গোলপোস্টে সেপ মায়ার এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। প্রতিপক্ষের ত্রাস ছিলেন এই তিনজন। ১৯৬৬ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে জার্মানির বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা করে নেন তিনি। ইংল্যান্ডের সাথে ফাইনাল হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় সেবার।
১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে প্রথম বুন্দেসলিগা জেতে বায়ার্ন মিউনিখ। তখন থেকেই ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে ডাকতে শুরু করেন ‘ডার কাইজার’ অর্থাৎ সম্রাট। তবে এই ডাকনাম তাঁকে কেন দেওয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, শালকে স্ট্রাইকার রাইনহার্ড লিবুডাকে এল ম্যাচে নিজের ছায়ায় রেখে দেওয়ার জন্য এমন নাম পেয়েছিলেন বেকেনবাওয়ার। লিবুডাকে বলা হতো ওয়েস্টফালিয়ার রাজা, রাজার ওপর যে আধিপত্য দেখায় তাঁকে তো সম্রাটই বলতে হবে, তাই না! অনেকে ভাবেন ডিফেন্সে সম্রাটের মতো উপস্থিতির কারণেই এই নাম পেয়েছিলেন তিনি। আবার অনেকের মতেই স্রেফ বাভারিয়ান রাজা দ্বিতীয় লুডউইগের সঙ্গে চেহারায় মিল থাকার কারণে এই নামে ডাকা হতো বেকেনবাওয়ারকে। তবে কারণ যা-ই হোক, ফুটবল মাঠে তাঁর অর্জন কিন্তু সম্রাটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলেন স্ট্রাইকার, ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন মিডফিল্ডার। তারপর দলের মূল ডিফেন্ডার চোট পাওয়ায় প্রয়োজনে হয়ে গেলেন ডিফেন্ডার। তিন পজিশনেই যে তিনি খেলতে পারেন, তার প্রমাণ ছিল খেলার ধরনেই। বলা যায়, নিজের জন্যই এক পজিশন আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, সে পজিশনের নাম ‘সুইপার’। আধুনিক যুগের অনেক গোলকিপারকে যে ‘সুইপার কিপার’ বলা হয়ে থাকে, সেই সুইপার পজিশনের স্রষ্টা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। বিপক্ষ স্ট্রাইকারকে করতেন কড়া মার্কিং। বল পেলে লম্বা পাসে নিজ দলের স্ট্রাইকারকে ধরার চেস্টা করতেন অথবা নিজেই এগোতেন বল নিয়ে। বেকেনবাওয়ারকে পাওয়া যেত পুরো মাঠেই। তার প্রমাণ? ডিফেন্ডার হয়েও ক্যারিয়ারে ১১২ গোল!
মূলত, প্রথাগত ফুটবলেই বিপ্লব এনেছিলেন বেকেনবাওয়ার। আরেক জার্মান ফুটবলার হেলমুট স্কোন বেকেনবাওয়ারকে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতের ফুটবলার’। ফুটবলও তাঁকে দিয়েছিল দুহাত ভরে। বেকেনবাওয়ার এখনো পর্যন্ত একমাত্র ডিফেন্ডার, যিনি জিতেছেন একের অধিক ব্যালন ডি’অর। দুবার রানার্সআপসহ সর্বমোট ব্যালন ডি’অর মনোনায়ন পেয়েছেন ১২ বার। পরপর তিন বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা একাদশে। শুধু ব্যক্তিগত অর্জনই নয়, দলগত অর্জনেও পিছিয়ে নেই তিনি কোনোমতেই। জার্মানির হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ, ইউরো, বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে জিতেছেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। ফুটবল ইতিহাসে বিশ্বকাপ, মহাদেশীয় ট্রফি, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ব্যালন ডি’অর জিতেছেন—এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র ৯ জন, তার মধ্যে একজন এই বেকেনবাওয়ার।
তবে একটি জায়গায় কিন্তু এই ৯ জনের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে তিনি। এই ৯ জনের মধ্যে খেলোয়াড়ের পাশাপাশি কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছেন একমাত্র বেকেনবাওয়ারই। কোচ এবং খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা বাকি দুজনের মধ্যে একজন মারিও জাগালো না ফেরার দেশে চলে গেলেন জানুয়ারির ৫ তারিখ। তার ৪৮ ঘণ্টা না পেরোতেই তাঁকে অনুসরণ করলেন জার্মান ফুটবলের সম্রাট।