‘৫৫ মিলিয়নের ফ্লপ’ থেকে ‘বিশ্বসেরা’

কানাঘুষা, গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তেমন পাত্তা দেয়নি কেউ। ম্যানসিটির কোচ গার্দিওলা নিজের প্রিয়পাত্রদের ব্যাপারে বেশ অনড়। সময়ের বেড়াজালে তিনি তাঁদের বাঁধেন না, সহজে হাতছাড়া করেন না প্রিয়পাত্রদের তিনি। কেভিন ডি ব্রুইনাকে নিয়ে বাতাসে উড়ে বেড়ানো গুঞ্জন তাই গুঞ্জন হয়েই ছিল, খুব একটা ধোপে টেকেনি। হুট করে টুইটারে একটা ফটোকার্ড, আর ক্যাপশনে ‘প্রিয় ম্যানচেস্টার’ লেখা অশ্রুসিক্ত করেছিল অনেকের চোখ। বিদায়ী চিঠির শুরুটাও করেছেন সেভাবেই, দেখেই হয়তো বুঝে গিয়েছেন সামনে কী আসতে চলেছে। ১০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করার এর চেয়ে ভালো উপায় হয়তো জানা ছিল না তাঁর।

ডি ব্রুইনা যখন সিটিতে যোগ দেন, তার বয়স মোটে ২৩। ক্যারিয়ারের মধ্যবয়সে পা না দেওয়া খেলোয়াড়কে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল ব্রিটিশ মিডিয়া। অবশ্য তাদের দোষ খুব একটা দেওয়াও যায় না তাতে। খোদ ‘স্পেশাল ওয়ান’ তাঁকে ফ্লপ বলেছেন, মিডিয়া তো তাতে রং লাগাবেই। ২০১২ সালে গেঙ্ক ছেড়ে চেলসিতে যোগ দেন ডি ব্রুইনা। ২১ বছর বয়সী বেলজিয়ান ব্লুজদের সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি। কড়া শিক্ষক জোসে মরিনিওর অধীনে ছিলেন নিষ্প্রভ। সে কারণেই কিনা এক মৌসুমের মাথায় তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জার্মানির ভলসবুর্গে, ধারে খেলতে।

ধারের পারফরম্যান্স মনে ধরেছিল মরিনওর, কিন্তু লন্ডনে আসতে না আসতেই সব পাল্টে গেল। লন্ডনের বৈরী আবহাওয়ায় নিজেকে কোনোভাবেই মানাতে পারছিলেন না। ফলাফল? ছয় মাসের মধ্যে পত্রপাঠ বিদায়, একেবারে চিরাচরিত মরিনিও কায়দায়। ‘ও তো বাচ্চামানুষ, ও অপেক্ষা করতে পারছে না। অপেক্ষা করলে ওর জন্য সুযোগ আসত।’

মরিনিওর অধীনে নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন ডি ব্রুইনা। ছবি: এক্স

রিজেক্টেড হওয়ার ঘটনা তাঁর জীবনে প্রথম নয়। ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি। ফুটবল আর পড়াশোনা—এতেই বন্দী তাঁর জীবন। কিন্তু চুপচাপ ডি ব্রুইনা যখন চমক দেখানো শুরু করলেন মাঠে, চমকে গেল সবাই।

আরও পড়ুন

মরিনওর কাছে যে সুযোগ পাননি, ভলসবুর্গে পেয়েছিলেন তার সবটা। প্রিমিয়ার লিগে যেখানে বল কন্ট্রোল করতেই রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা হতো, সেখানে গোল-অ্যাসিস্টে ভরপুর পারফরম্যান্স বুন্দেসলিগায়। তাঁকে দলে ভেড়াতে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে ম্যানচেস্টার সিটি। শেষ পর্যন্ত ৫৫ মিলিয়ন পাউন্ডে তাঁকে দলে ভেড়ায় সিটিজেনরা। আর ইংলিশ মিডিয়ার শিরোনাম হয়, ‘৬০ মিলিয়ন ডলারের চেলসি রিজেক্ট এখন সিটিতে’। প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলবদল। তা–ও এমন একজনের জন্য, যিনি ১৮ মাস আগে ইংল্যান্ড ছেড়েছেন ফ্লপ হয়ে। তাঁকে নিয়ে আশঙ্কা জাগা ভুল কিছু নয়।

ভলসবুর্গের রাজপুত্র হয়ে উঠেছিলেন ১৮ মাসেই। ছবি: এক্স

ডি ব্রুইনা সব শঙ্কা উড়িয়ে দিলেন প্রথম মৌসুমেই। ডেভিড সিলভার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলেন মাঝমাঠের দায়িত্ব। প্রথম মৌসুমে দলকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে। মৌসুম ঘুরতে না ঘুরতে দলের দায়িত্ব নিলেন পেপ গার্দিওলা। বদলে ফেলতে চাইলেন দলের খোলনলচে। খেলোয়াড় অদল-বদল করলেন, একে-ওকে নিয়ে চলল বিভিন্ন নিরীক্ষা। সব মিলিয়ে রীতিমতো যেন এক হযবরল অবস্থা। দুই মৌসুমের মাথায় গার্দিওলা যখন দলটাকে একটু গুছিয়ে আনলেন, দলের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল ডি ব্রুইনার পায়ে। গত আট বছরে সে দায়িত্বে বিন্দুমাত্র হেলাফেলা করেননি তিনি।

আরও পড়ুন

বার্সা-বায়ার্নের অভিজ্ঞতা নিয়ে সিটিতে ভিড়েছিলেন গার্দিওলা। সিটি ব্যতিক্রম ছিল অন্য কারণে। বার্সা-বায়ার্নে যেভাবে রেডিমেড তরুণ খেলোয়াড় পেয়েছেন, সিটিতে সেটা সম্ভব নয়। তবে সিটিতে পেয়েছিলেন অগুনতি টাকা। নতুন খেলোয়াড়ের আনাগোনা তাই সিটিতে ছিল সব সময়ই। গোলকিপার থেকে স্ট্রাইকার, প্রতি মৌসুমে নিত্যনতুন খেলোয়াড় যোগ দিয়েছেন সিটিতে। ব্রাভো থেকে শুরু করে নলিতো, কেলভিন ফিলিপস; অনেক খেলোয়াড়ের সমাহার ছিল সিটিতে। নিজের পারফেক্ট কম্বিনেশনের জন্য যাঁকে চেয়েছেন, তাঁকেই কিনেছেন। মাঠের একটা পজিশনেই হাত দেওয়ার সাহস করেননি তিনি। কারণ, জায়গাটা আলো করে ছিলেন একজন কেভিন ডি ব্রুইনা।

গার্দিওলার পরশপাথর ছিলেন স্বর্ণকেশী ব্রুইনা। ছবি: এক্স

গত ১০ বছরে ডি ব্রুইনাকে ঠিক যেভাবে খেলাতে চেয়েছেন গার্দিওলা, ঠিক সেভাবেই তাঁকে ব্যবহার করেছেন। যখন অ্যাসিস্টের প্রয়োজন হয়েছে, অ্যাসিস্টের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। যখন গোলের দরকার হয়েছে, দূরপাল্লার শটে মুগ্ধ করেছেন বিশ্বকে। সংখ্যার বিচারে তাঁর আশপাশে নেই কেউ। শুধু প্রিমিয়ার লিগেই ১১৮ অ্যাসিস্ট, ভেঙেছেন এক মৌসুমে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের রেকর্ড। গোলের দিক দিয়েও টেক্কা দিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের রথী-মহারথীদের। ১০ মৌসুমে ৭০ গোল, প্রিমিয়ার লিগ মিডফিল্ডারদের তুলনায় সংখ্যাটা বেশ নগণ্য। আর ট্রফি? সে আলোচনায় না যাওয়াই ভালো। ৬টি প্রিমিয়ার লিগ, ২টি এফএ কাপ, ৫টি লিগ কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, সুপার কাপ থেকে কমিউনিটি শিল্ড; এমন কোনো শিরোপা নেই, যাতে ডি ব্রুইনার ছোঁয়া লাগেনি।

ডি ব্রুইনা বরাবরই ছিলেন তাঁর আলাদা নিজস্ব জগতে। গার্দিওলা আজীবনই দলে চেয়েছেন ভরসা করার মতো কাউকে। যাঁর ওপর দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার হয়ে থাকা যাবে বাকিটা সময়। বার্সেলোনায় মেসি, বায়ার্নে শোয়েনস্টাইগার আর সিটিতে এসে ডি ব্রুইনা। যুগে যুগে গার্দিওলার প্রাণভোমরা হয়ে ছিলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডাররা। তিন দলে তিনজনকে রেডিমেড পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ হয়ে আসেনি কেউ। প্রত্যেককে গার্দিওলা নিজের ছাঁচে গড়ে নিয়েছেন। তুলে নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বসেরার তালিকায়। প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন দুই বছর। ২০২২ সালে ব্যালন ডি’অরের রেসে হয়েছেন তৃতীয়।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মাটি থেকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন। ছবি: এক্স

প্রিমিয়ার লিগে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন শুধু পায়ের কারুকাজে, নতুন করে তাঁর খোঁজ পাওয়া অসম্ভবই বটে। গত দুই মৌসুমে চোটের কারণে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। গার্দিওলার বাজে ফর্মের সূচনাও হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই। তবু যখন যখন মাঠে নেমেছেন, হাসি ফুটেছে গার্দিওলার মুখে। ডি ব্রুইনার এই বিদায়, গার্দিওলার চোখ অশ্রু সিক্ত করে দিতে বাধ্য। বিদায়বেলায় তাই তো কুর্ণিশ পান রাইভালের কাছ থেকেও। আহ্বান জানান নতুন গল্প লেখার।

আরও পড়ুন