নবম আসরে এসে প্রথমবারের মতো লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপের বলয় থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্বকাপ। বিশ্বযুদ্ধের পর টানা দুবার ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বিশাল ঝড়-ঝঞ্ঝা পোহাতে হয়েছে ফিফাকে। যে কারণে নবম বিশ্বকাপের আয়োজকের তালিকায় সহজ সমাধান হিসেবে কোনো ইউরোপিয়ান দেশকে রাখেনি ফিফা। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ জিতে নেয় মেক্সিকো।
ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে প্রথম বিশ্বকাপ হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের রঙিন বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো টিভি পর্দায় রঙিন বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ মেলে ফুটবলপ্রেমীদের। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছিল হলুদ ও লাল কার্ড। ১৯৬২ ও ৬৬ বিশ্বকাপের বিভীষিকা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল ফুটবল বিশ্বকে। তাই বিশ্বকাপের নবম আসরেই শুরু হয় লাল ও হলুদ কার্ডের ব্যবহার।
বিশ্বকাপের ফরম্যাট ছিল আগের মতোই। ১৬ দল, গ্রুপ পর্ব, এরপর নক আউট স্টেজ। তবে সে বিশ্বকাপ যতটা না উত্তেজনার ছিল, তার থেকে বেশি উত্তেজনার ছিল সেবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। দুই বছরের বাছাইপর্বে অঘটনের শেষ ছিল না। স্পেন, হাঙ্গেরি, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, এমনকি আগের আসরে বাজিমাত করা পর্তুগাল; কেউই বাধা কাটাতে পারেনি বাছাইপর্বের। এমনকি বাছাইপর্বের ম্যাচকে ঘিরে লেগেছিল যুদ্ধও। হন্ডুরাসকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা এল সালভাদর রীতিমতো যুদ্ধে জড়িয়ে পরে বাছাইপর্বের ম্যাচ নিয়ে। ইতিহাসে সেই ১০০ ঘণ্টার যুদ্ধ ‘ফুটবলযুদ্ধ’ নামেই পরিচিত। অন্যদিকে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নেয় যথাক্রমে ইসরায়েল ও মরক্কো। নির্বাসন কাটিয়ে আবারও বিশ্বকাপে ফেরে আফ্রিকান দলগুলো।
বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নজর ছিল ব্রাজিল দলটার দিকে। বিশেষত পেলের ওপর। আগের দুই বিশ্বকাপে চোটের কারণে মাঝপথ থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ম্যাজিক আর দেখাতে পারেননি তিনি। অন্যদিকে ব্রাজিলও হাজির হয়েছিল তাদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে। ফলে ব্রাজিল আর পেলে—উভয়ই প্রস্তুত ছিল নিজেদের সেরাটা নিয়ে।
অন্যদিকে জুলে রিমে ট্রফির লড়াইয়ে ব্রাজিলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীও কম যায় না। ইতালি আর উরুগুয়েও হাজির হয়েছিল তাদের সর্বোচ্চটা নিয়ে। ইতালি হাজির হয়েছিল তাদের ইউরোজয়ী দল আর জিয়ান্সিতো ফাচেত্তি, জিয়ানি রিভেইরার মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে। অন্যদিকে উরুগুয়ের স্বর্ণযুগের খেলোয়াড়দের শেষ সুযোগ ছিল শিরোপা নিজেদের করে নেওয়ার। সব মিলিয়ে ১৯৭০ বিশ্বকাপ ছিল এক ত্রিমুখী লড়াই, জুলে রিমে ট্রফি নিজেদের করে নেওয়ার।
বিশ্বকাপের আগেই এতগুলো অঘটন সামাল দিতেই যেন বিশ্বকাপের আসরে কোনো অঘটনের দেখাই মেলেনি। অঘটনের স্টক বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বৈকি। ফেবারিট হিসেবেই সেমিতে জায়গা করে নেয় উরুগুয়ে, ব্রাজিল, ইতালি ও পশ্চিম জার্মানি। কোয়ার্টারে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আগের বিশ্বকাপের একটা মধুর প্রতিশোধও নিয়ে নেয় পশ্চিম জার্মানি।
প্রথম সেমিতে উরুগুয়ের মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। একদিকে ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল, অন্যদিকে উরুগুয়ের স্বর্ণযুগের বিশ্বজয়ের শেষ চেষ্টা। আর ১৯৫০ বিশ্বকাপের ‘মারাকানাজো’ তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রথম সেমিফাইনালে প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশছোঁয়া। ১৯ মিনিটে কুবিল্লার গোলে এগিয়ে যায় উরুগুয়ে। বাকি সময়টা ছিল ব্রাজিলের গল্পগাথা। ৪৪ মিনিটে ক্লডোয়াল্ডোর গোলে সমতায় ফেরে ব্রাজিল। ৭৬ মিনিটে জার্জিনহো আর ৮৯ মিনিটে রিভেলিনো; ৩-১ গোলে জিতে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে ব্রাজিল।
একদিকে যখন লাতিন আমেরিকান ডার্বি চলছে, অন্য সেমিফাইনালে ছিল ইতালি-জার্মানির ইউরোপিয়ান ডার্বি। বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে সেই ম্যাচের নাম। ৮ গোলের সেই ম্যাচ শেষ হয়েছিল ১-১ গোলের সমতায়। ৮ মিনিটে করা ইতালির গোল জার্মানি শোধ করে ৯০ মিনিটে এসে। অতিরিক্ত সময়ে এসে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
৯৪ মিনিটে গার্ড মুলারের গোলে এগিয়ে যায় জার্মানি। ৯৮ মিনিটে বার্হনিচের গোলে সমতায় ফেরে ইতালি। ১০৪ মিনিটে ইতালিকে এগিয়ে নেন রিভা। ১১০ মিনিটে আবারও ত্রাতা হয়ে জার্মানিকে সমতায় ফেরান মুলার। কিন্তু ১১১ মিনিটে রিভের গোল আর শোধ করে উঠতে পারেনি পশ্চিম জার্মানি। ৪-৩ গোলের সেমিফাইনালকে শতাব্দীর সেরা ম্যাচ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় এখনো।
বিশ্বকাপ ফাইনাল হয়ে ওঠে জুলে রিমে ট্রফি নির্ধারণী এক ফাইনাল। যে জিতবে, আজীবনের জন্য সেই শিরোপা হয়ে যাবে সেই দলের। ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ প্রবাদের প্রমাণ দিতেই যেন ফাইনালে ফুঁসে উঠলেন পেলে। ১৮ মিনিটেই এগিয়ে নেন ব্রাজিলকে। ৩৭ মিনিটে কাগজে-কলমে ইতালি সমতায় ফিরলেও ম্যাচের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল না তাদের হাতে। সাম্বা আর পাসিং ফুটবলের মিশেলে সেদিনের অ্যাজটেক স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিল ব্রাজিলের নিজেদের মাঠ। দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলকে এগিয়ে নেন গারসন। পেলের বানিয়ে দেওয়া গোলে ব্যবধান বাড়ান জার্জিনহো। আর ইতালির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তোর। ৪-১ গোলে জিতে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপার সঙ্গে সঙ্গে জুলে রিমে ট্রফিটাও চিরদিনের মতো নিজেদের করে নেয় সেলেসাওরা।