১৭ বছর বয়সে আপনি কী করছিলেন? হয়তোবা স্কুল–কলেজে দৌড়াদৌড়ি করতেন অথবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেন ক্রিকেট। কিংবা বিকেলবেলা বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেলটা নিয়ে বের হয়ে যেতেন। আর ওদিকে ইউসুফা মৌকোকো কী করছে? ১৭ বছর বয়সী এই ফুটবলার এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করছে চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির হয়ে।
২০১৪ বিশ্বকাপের শিরোপাজয়ী জার্মানি অবিশ্বাস্যভাবে প্রথম পর্বেই বাদ পড়ে ২০১৮ বিশ্বকাপে। মেক্সিকো আর দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে বসে ক্রুস-মুলার-নয়্যারদের দল। চার বছর পর নতুন এক দল নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছে জার্মানি। তারুণ্যের সঙ্গে কিছুটা অভিজ্ঞতার মিশ্রণে এবার জার্মানি দলে চমক আছে বেশ কয়েকটি। প্রথমেই আসবে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্কোরার মারিও গোৎজার অন্তর্ভুক্তি। ইনজুরি আর অফ-ফর্ম মিলিয়ে নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন বেশ অনেকটা সময়। অবশেষে নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করেন গত মৌসুমে, ডাচ ক্লাব পিএসভিতে যোগ দেওয়ার পর। এ বছর তো ফ্রাঙ্কফুর্টের হয়ে ফিরে এসেছেন জার্মান লিগে। প্রায় ছয় বছর পর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে কিছু করার জন্য নিশ্চয়ই মুখিয়ে থাকবেন এই ফরোয়ার্ড।
২০১৪ বিশ্বকাপে খেলেছেন আবার ২০২২-এও আছেন এমন ফুটবলার মাত্র ৪ জন। গোৎজা ছাড়াও আছেন গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যার, ডিফেন্ডার ম্যাথিয়াস গিন্তার আর ফরোয়ার্ড থমাস মুলার। বেশ কয়েক বছর যাওয়া-আসার মধ্যে থাকলেও অবশেষে দলে থিতু হয়েছেন গিন্তার। আর ম্যানুয়েল ন্যয়ার তো এই কয়েক বছরের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন সর্বকালের সেরা গোলকিপারদের তালিকার ছোট্ট ব্রাকেটে। থমাস মুলার অপেক্ষায় আছেন বিশ্বকাপের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় নিজের নামটা আরও ওপরের দিকে তুলতে। ১০ গোল নিয়ে এখনো খেলে যাওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ গোল তাঁর। ১৬ গোল নিয়ে সবার ওপরে স্বদেশি মিরোস্লাভ ক্লোসা। ৩৩ বছর বয়সী থমাস মুলার নিশ্চয়ই সেরাটাই দিতে চাইবেন এবারও।
গত বিশ্বকাপটা কোনো গোল ছাড়া না কাটালে হয়তোবা ইতিমধ্যে সেখানে নিজেকে দেখতে পেতেন তিনি। তবে পুরো জার্মান শিবিরেই দুশ্চিন্তার কারণ মুলারের ইনজুরি। এ বছর ইতিমধ্যে দুবার বড় ইনজুরিতে পড়েছেন তিনি। জার্মান শিবির নিশ্চয় চাইবে না তেমন কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে।
এবার একটু বিশ্লেষণ করা যাক এ বিশ্বকাপের জার্মান দলকে। গোলকিপারের জায়গায় সব সময়ই একাধিক ভালো গোলকিপার থাকে দলেটিতে। এবারই যেমন ম্যানুয়াল ন্যয়ার ছাড়াও আছেন বার্সেলোনার আন্দ্রে টের স্টেগান আর ফ্রাঙ্কফুর্টের কেভিন ট্রাপ। গোলকিপারের আধিক্যের কারণে বাদ পড়েছেন নুবেল অথবা বাউমানের মতো দক্ষ গোলকিপাররা।
গোলকিপার নিয়ে সমস্যা না থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মানির জন্য হতাশার নাম ডিফেন্স। এই বিশ্বকাপেই যেমন ম্যাটস হুমেলসকে বাদ দিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন কোচ হান্সি ফ্লিক। জার্মান ডিফেন্সে সবচেয়ে বড় নাম রিয়াল মাদ্রিদের অ্যান্তনিও রুডিগার। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে তাঁর সঙ্গী হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন নিকলাস সুলে, একাদশে জায়গা পাওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন স্লটারব্যাক। দুই ফুলব্যাক হিসেবে থাকতে পারেন ডানে কেহরার আর বাঁয়ে ডেভিড রাউম। তবে ডানে কেহরারকে হটিয়ে দলে জায়গা পেতে পারেন ক্লস্টারম্যান।
এই বিশ্বকাপে জার্মান দলের ভরসার জায়গা তাদের মিডফিল্ড। বিশেষ করে হ্যান্সি ফ্লিকের ৪-২-৩-১ ফরমেশনে জার্মান দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা হচ্ছে মিডের ডাবল পিভট। এখানে জশুয়া কিমিখের সঙ্গী হবেন গুন্দোগান অথবা গোরেতজা। বায়ার্ন মিউনিখে কিমিখের সঙ্গী গোরেতজা হলেও ফ্লিকের প্রথম পছন্দ ম্যানচেস্টার সিটির গুন্দোগান। মজার ব্যাপার হলো, ডিফেন্সে বায়ার্ন মিউনিখ থেকে কোনো খেলোয়াড় না থাকলেও মিডফিল্ডে আছেন এই ক্লাবের ছয়জন!
এই বিশ্বকাপে ফ্লিকের জন্য অন্যতম কঠিন কাজ হবে তিনজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার নির্বাচন। এই ৩টি জায়গায় প্রতিযোগিতাটা হাড্ডাহাড্ডি। এবারের বিশ্বকাপে জার্মানির তুরুপের তাস হতে পারেন ১৯ বছর বয়সী তরুণ তুর্কি জামাল মুসিয়ালা। ট্রান্সফার মার্কেট ইউকের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ দামি এই খেলোয়াড় ইতিমধ্যে বায়ার্নের হয়ে বুন্দেসলিগায় ১৪ ম্যাচে ৯ গোল আর ৭ অ্যাসিস্ট করেছেন এ মৌসুমে। ৩ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের মধ্যে মাঝখানের জায়গাটি নিতে পারেন মুসিয়ালা। সঙ্গে বাঁয়ে থাকবেন লেরয় সানে অথবা কাই হাভার্টজ। ডানে থাকতে পারেন সার্জ নাব্রি অথবা জোনাস হফম্যান। তবে হাভার্টজের সামর্থ্য যেমন মাঝে খেলার, তেমনি মাঝের জায়গাটি দখল করতে পারেন থমাস মুলারও। তাঁদের বিকল্প হিসেবে জুলিয়ান ব্রান্ডট খেলতে পারেন অ্যাটাকিং মিডের যেকোনো জায়গাতেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মানির মাথাব্যথার কারণ স্ট্রাইকার। টিমো ভার্নারের অফ-ফর্মের কারণে কখোনো হাভার্টজ কখোনো মুলারকে দিয়ে স্ট্রাইকারের কাজ চালাতে হয়েছে জার্মানিকে। আর বিশ্বকাপের আগে ভার্নার চোটে পড়েছেন। তাঁর বদলে দলে ডাক পাওয়া ফুলক্রগ অবশ্য অভিষেকেই ওমানের বিপক্ষে গোল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপের জন্য তিনি প্রস্তুত।
বিশ্বকাপে জার্মান একাদশ হতে পারে এমন—
ন্যয়ার
কেহরার-রুডিগার-সুলে-রাউম
কিমিখ-গুন্দোগান
নাব্রি-মুসিয়ালা-সানে
হাভার্টজ
মুলার ম্যাচফিট হলে হয়তো তিনিও একাদশে ঢুকে যাবেন, অপর দিকে হাভার্টজ অথবা সানের বদলে দলে ঢুকতে পারেন ফুলক্রগ। নাব্রির বদলে জায়গা পেতে পারেন জোনাস হফম্যান। সর্বোপরি এই বিশ্বকাপে হান্সি ফ্লিকের প্রথম পরীক্ষা হবে জার্মানির সেরা একাদশটা বের করা। এই বিশ্বকাপে অনেকের মতেই জার্মানির মূল ভরসা কোনো খেলোয়াড় নন, বরং কোচ হান্সি ফ্লিক। তিনি প্রথম নজরে আসেন বায়ার্ন কোচ থাকাকালীন বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলে হারিয়ে। দীর্ঘদিন জোয়াকিম লোর অধীনে জার্মানির সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার পর এটাই তাঁর প্রথম কোনো বড় দলের দায়িত্ব পাওয়া। ২০২০–এ বায়ার্নকে ছয়টি ট্রফি জিতিয়ে সে দায়িত্বে যে তিনি সফল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানি ভুগছে ধারাবাহিকতার অভাবে। গত ইউরোতেই যেমন গ্রুপ পর্বে পর্তুগালকে হায়িয়ে নকআউটে তারা হেরে বসে ইংল্যান্ডের কাছে। আবার নেশনস লিগে ইতালিকে ৫-২ গোলে হারানোর পর তারা হেরে বসে হাঙ্গেরির কাছে। বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে হলে দল হিসেবে ধারাবাহিকতায় ফেরা ছাড়া উপায় নেই। তাই চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
এ বিশ্বকাপে জার্মানির পাশাপাশি স্পেন, জাপান ও কোস্টারিকাকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ‘ই’ কে বলা হচ্ছে গ্রুপ অব ডেথ। এশিয়ার মাটিতে বরাবরই জাপান দুর্দান্ত প্রতিপক্ষ। স্পেনের তরুণ মিডফিল্ড ফুটবল দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত বিষয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-ইতালিকে পেছনে ফেলে কোস্টারিকার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া কে-ইবা ভুলতে পারে! সব মিলিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে জার্মানি।
জার্মানির এই দলের বেশির ভাগ সদস্যই তরুণ। অনভিজ্ঞ এই দলকে অনেকেই তুলনা করছেন ২০১০ বিশ্বকাপের জার্মানি দলের সঙ্গে। আনাড়ি জার্মান দল কিন্তু সে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড আর আর্জেন্টিনা দুই দলকেই ৪ গোল দিয়ে সাড়া জাগিয়েছিল। আর সাম্প্রতিক ফর্ম যেমনই হোক না কেন, দলটার নাম জার্মানি দেখেই ভক্তরা এবারও আশা নিয়ে খেলা দেখতে বসবেন প্রিয় দলের।