আরামবাগের কালা ভাই ফুটবল শেখান, মানুষও গড়েন
কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলে বোঝার উপায় নেই তিনি একজন ফুটবল কোচ। বছরের পর বছর ধরে কাজ করে চলেছেন ফুটবল নিয়ে। তৈরি করে চলেছেন অসংখ্য ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছেন, এমন ফুটবলারদের মধ্যে ২৪ থেকে ২৫ জন তাঁর ছাত্র। জাতীয় দলেও আছেন বেশ কয়েকজন। বেশ গর্ব করেই বললেন, ‘বর্তমান জাতীয় দলে আমার ছাত্র আছে তিনজন।’
ছোটখাটো গড়নের মানুষটি আরামবাগ এলাকায় অতিপরিচিত কালা মিয়া নামে। এ নামের কারণে ঢাকা পড়ে গেছে মা-বাবা প্রদত্ত নামটি। আসল নাম ইব্রাহিম খলিল। ফুটবল কোচ হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, কোচদের বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স থাকে, সেগুলোর কোনোটিই তাঁর নেই। কিন্তু তাঁর জন্য আছে আরামবাগ এলাকায় কিশোর-তরুণদের অগাধ সম্মান। ফুটবলার হতে চাও? জাতীয় দলের জার্সি পরে খেলতে চাও? খেলতে চাও আবাহনী, মোহামেডান, বসুন্ধরা কিংসের মতো ক্লাবে? কালা স্যারের কাছে যাও। তিনি একজন পাকা জহুরি। কালা মিয়া হয়তো তোমাকে জাতীয় দল কিংবা আবাহনী, মোহামেডান, বসুন্ধরা কিংসে ঢুকিয়ে দিতে পারবেন না, কিন্তু তিনি তোমাকে তৈরি করে দেবেন আগামী দিনের জন্য। বাফুফে টার্ফের পাশে দাঁড়িয়ে জনৈক ব্যক্তি বললেন, ‘কালা স্যার কাউকে বল নিয়ে দৌড়াতে দেখলেই বুঝতে পারেন, তার প্রতিভা কতটুকু। ছেলেটি বা মেয়েটি কত দূর যাবে! এমনি এমনি তো তাঁর ফুটবল ক্লাস থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের এতজন খেলোয়াড় বের হয়নি!’
চাকরি করার সামর্থ্য আমার ছিল না। ব্যবসা বলতে দোকান-টোকান হয়তো দিতে পারতাম। সে ব্যাপারে সাহায্য করার মতো মানুষ ছিল। কিন্তু ফুটবলের নেশাটা কখনোই ছাড়তে পারিনি। তাই কোচ হয়ে ওঠা। কোচ হিসেবে এখন যদি প্রতিবছর তিনজনও নতুন প্রতিভাবান ফুটবলার দেশের ফুটবলকে দিতে পারি, লাভ বলুন, আনন্দ বলুন, সেটিই।ফুটবল কোচ ইব্রাহিম খলিল
ফুটবলারই হতে চেয়েছিলেন ইব্রাহিম খলিল। খুব ছোটবেলা থেকেই আরামবাগ, মতিঝিল এলাকায় তাঁর বসবাস। ঢাকা স্টেডিয়াম, ক্লাবপাড়া—সবকিছুই বাড়ির কাছাকাছি থাকার কারণেই হয়তো আগ্রহের শুরুটা। ফুটবল নিয়ে নেশাটা এমন পর্যায়ে ছিল যে একটা পর্যায়ে বাড়ি ছেড়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেই থাকা শুরু করলেন। নিজের চোখে এনায়েত হোসেন, সালাম মুর্শেদী, শামসুল আলম মঞ্জু, আবুল হোসেন, মোসাব্বের হোসেন, লাল মোহাম্মদদের মতো সাদা-কালো তারকাদের দেখতে পান—এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে! ক্লাবে থাকতে থাকতে হয়ে গেলেন বল-বয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে লিগ বা বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্টের ম্যাচে মোহামেডান দলের সঙ্গে যান। পানি টানেন, খেলোয়াড়দের ফাইফরমাশ খাটেন, তবে নিজের নেশাটাকে মাটিচাপা দেননি কখনোই। দলের অনুশীলনেই বল নিয়ে নিজের অনুশীলনটাও সেরে ফেলতেন।
একটা সময় খুব জমজমাট ছিল পাইওনিয়ার লিগ। নতুন প্রতিভা অন্বেষণের খুব বড় মঞ্চ ছিল সেটি। ১৯৮৩ সালে ফিফার সাবেক সভাপতি হুয়াও হ্যাভেলাঞ্জ বাংলাদেশে এসে সেই টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন। প্রথম আসরে একটা দলও পেয়ে গেলেন ইব্রাহিম খলিল। খেললেন প্রথম দুই আসর। এরপর খেললেন তৃতীয় ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগ। স্বপ্নপূরণের সিঁড়িটা যখন বেয়ে উঠছেন, তখনই হাঁটুতে বাজে একটা চোট পেলেন। অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা—এসব করানোর মতো আর্থিক সংগতি তাঁর ছিল না। বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা তাই স্বপ্নই রয়ে গেল। কিন্তু ফুটবলের নেশাটা কি এত সহজে ছাড়ানো যায় নিজের ভেতর থেকে? সেটি তিনি পারলেন না কখনোই, আজ পর্যন্তও না। ফুটবল শেখানোর কাজটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। দায়িত্ব নিলেন দেশকে ভালো ভালো ফুটবলার উপহার দেওয়ার। কেউ তাঁকে সেটি করতে বলেনি। কোনো আর্থিক হাতছানি নেই। সবটাই নেশা আর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন ইব্রাহিম খলিল, হয়ে গেলেন কোচ কালা ভাই।
‘আরামবাগের বালুর মাঠে (যেটি এখন বাফুফে টার্ফ) একটা সময় এলাকার কতগুলো বাচ্চাছেলেকে ফুটবল শেখাতে শুরু করি। এভাবেই শুরু।’ নিজের কোচিং-জীবনের শুরুর কথাটা এভাবেই বললেন ইব্রাহিম খলিল। যদি অন্য কোনো কাজকর্ম খুঁজে নিতেন, নিদেনপক্ষে একটা ব্যবসা করতেন, তবে তাঁর আর্থিক অবস্থা হয়তো আরও ভালো হতে পারত। কিন্তু ইব্রাহিম খলিল ভেবেছেন অন্যভাবে, ‘চাকরি করার সামর্থ্য আমার ছিল না। ব্যবসা বলতে দোকান-টোকান হয়তো দিতে পারতাম। সে ব্যাপারে সাহায্য করার মতো মানুষ ছিল। কিন্তু ফুটবলের নেশাটা কখনোই ছাড়তে পারিনি। তাই কোচ হয়ে ওঠা। কোচ হিসেবে এখন যদি প্রতিবছর তিনজনও নতুন প্রতিভাবান ফুটবলার দেশের ফুটবলকে দিতে পারি, লাভ বলুন, আনন্দ বলুন, সেটিই।’
এ মুহূর্তে আরামবাগ ফুটবল একাডেমির কোচের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ইব্রাহিম খলিলের সেই ছোট্ট ফুটবল প্রশিক্ষণকেন্দ্রটিই আরামবাগ ফুটবল একাডেমি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সেই একাডেমিতে ভর্তি নেওয়া হয় ফুটবল-আগ্রহী ছেলেদের। প্রতিদিন বিকেলে বাফুফের টার্ফে চলে অনুশীলন। এভাবেই ইব্রাহিম খলিলের কয়েকজন ছাত্র দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় দল ও বসুন্ধরা কিংসের মিডফিল্ডার সোহেল রানা। মোহামেডানে খেলছেন মিনহাজুর আবেদীন বাল্লু ও গোলকিপার সুজন হোসেন, আবাহনীর গোলকিপার পাপ্পু হোসেন।
এই তো সেদিন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অস্ট্রেলিয়া ও লেবাননের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ দুটি ম্যাচের জন্য ঘোষিত বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ মিলল গোলকিপার সুজন হোসেনের। মোহামেডানের এই গোলকিপার খবরটা পেয়েই ফোন দিয়েছিলেন প্রিয় কালা ভাইকে (ইব্রাহিম খলিল)। এমন ফোন আগেও পেয়েছেন। ভবিষ্যতেও পেতে চান ইব্রাহিম, ‘সুজন আমাকে ফোন দিয়েছিল। খুব ভালো লেগেছে। আমার ছাত্ররা যখন জাতীয় দল, জাতীয় বয়সভিত্তিক দল বা বড় কোনো ক্লাবে খেলার সুযোগ পায়, তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। আমি তো এতটুকুই চাই। দেশকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় উপহার দেওয়া।’
দেশের ফুটবল নিয়ে হতাশাও কম নেই ইব্রাহিম খলিলের, ‘এই দেশে ফুটবলটা কখনোই ঠিকভাবে চলল না। খেলোয়াড় তৈরির প্রক্রিয়াটা ঠিক নেই দেখে আমরা প্রতিভাবান খেলোয়াড় কম পাই। বয়সভিত্তিক দলগুলোয় বেশি বয়সী খেলোয়াড় খেলানো যে দেশের ফুটবলের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকারক, এই ব্যাপারটা কেউ বুঝল না। এই তো সেদিন বাফুফে একাডেমি কাপ আয়োজন করেছে বেশ ঘটা করেই। কিন্তু প্রায় প্রতিটি দলেই ছিল বেশি বয়সী ফুটবলারদের আধিপত্য। এভাবে চলতে থাকলে ফুটবল কখনোই এগোবে না।’
ফুটবল কোচিংয়ে নিজের অভিজ্ঞতা কম নয়। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাফুফের কাছ থেকে কখনোই পাননি তিনি। ইব্রাহিম খলিলের ফুটবল কোচিং-দর্শন খুবই সাধারণ—৬ থেকে ১০ বছর বয়সী বাচ্চাদের প্রতিজনকে একটা করে বল দিয়ে মাঠে ছেড়ে দাও। বাচ্চারা বল নিয়ে দৌড়াক। মনের আনন্দে খেলতে থাক। সেখান থেকেই পেয়ে যাবে ভালো ফুটবলার। ইব্রাহিম খলিলের খুব ইচ্ছা, প্রতিবছর এমন কিছুর আয়োজন করুক বাফুফে, ‘বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠে দিনব্যাপী বাচ্চারা ফুটবল খেলুক। প্রতিটি বাচ্চাকে একটা করে বল দিয়ে মাঠে ছেড়ে দিন, ওরা মনের আনন্দে খেলতে থাকুক। সেখান থেকে বাফুফের কোচরা বাছাই করুক। আমি নিশ্চিত, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১০টি প্রতিভা খুঁজে বের করা খুবই সম্ভব।’
ইব্রাহিম খলিল শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন আরামবাগের অভিভাবকদেরও। একাডেমিতে নিজের ফুটবল-পাগল ছেলেকে নিয়ে আসেন কামরুন্নাহার শম্পা। বিকেলবেলাটা ছেলে অনুশীলন করে, তিনি বাফুফে টার্ফের এক পাশে বসে বসে দেখেন, ‘কালা স্যারের কাছে ছেলেকে ফুটবল শিখতে দিয়ে স্বস্তি পাই। আমি জানি আমার ছেলে ঠিক পথেই আছে। কালা স্যার শুধু ফুটবলই শেখান না, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাও শেখান। কালা স্যারের ফুটবল প্রশিক্ষণে ভালো মানুষও তৈরি হয়।’
কামরুন্নাহার শম্পা যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন ইব্রাহিম খলিল পৌঁছে গেছেন তাঁর ছাত্রদের কাছে। সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে করছেন ব্রিফিং। ফুটবল নিয়ে তাঁর স্বপ্নটা তো ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে। তাঁর যে চাওয়া-পাওয়ার আর কিছুই নেই।