ফুটবলের অভিশাপ ‘কিরিকোচা’
২০২০ সাল। চলছে ইউরো ফাইনাল। ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ইতালি। প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। দ্বিতীয়ার্ধে সেই গোল শোধ করে ইতালি, খেলা শেষ হয় ১-১ গোলে। অতিরিক্ত সময়েও কোনো দল গোল দিয়ে পারেনি। ফলে টাইব্রেকারের জন্য প্রস্তুত হয় দুই দল। টাইব্রেকারে দুই দলই দুটি করে গোল করতে ব্যর্থ হয়। ৯ শট শেষে ইতালি ৩, ইংল্যান্ড ২। শেষ কিক করবেন ইংল্যান্ডের বুকায়ো সাকা। গোল করতে পারলে দুই দলের মধ্যে আবার টাইব্রেকার হবে, কিন্তু সাকা গোল মিস করলে জিতে যাবে ইতালি।
ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে আসছেন সাকা। একটু দৌড়ে থামছেন, আমার দৌড়াচ্ছেন। আসলে গোলকিপারকে বিভ্রান্ত করার জন্য খেলোয়াড়েরা অনেক সময় এ কৌশল ব্যবহার করে। যাহোক, সাকা এগিয়ে গেলেন। বলে কিক মারবেন, ঠিক সেই সময় দূর থেকে চিৎকার করে ‘কিরিকোচা’ শব্দটা উচ্চারণ করে ইতালির ডিফেন্ডার জর্জো কিয়েল্লিনি। বল গোলে ঢুকবে, ঠিক সেই মূহূর্তে ডাইভ দিয়ে বলটা ঠেকিয়ে দেয় ইতালির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মা। ইতালি জিতে যায় ২০২০ ইউরো।
এই খেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত কোনটা? নিশ্চয়ই দোন্নারুম্মার শেষ বলটা ঠেকিয়ে দেওয়া। কিন্তু তাঁকে হঠিয়ে এই ম্যাচের নায়ক বনে যান ডিফেন্ডার কিয়েল্লিনি। কারণ, তাঁর সেই কিরিকোচা শব্দ। পরে এই শব্দটাকে বলা হয় ফুটবলের অভিশাপ। পরে কিয়েল্লিনি এক্সে (আগের নাম টুইটার) একটি ভিডিওতে স্বীকার করেন, তিনি সাকাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যাতে সাকা গোল মিস করে। আসলেই কি কিয়েল্লিনির অভিশাপ কাজ করেছিল? কী এই অভিশাপ? কোথা থেকে এল এই শব্দটা? এর মানে কী?
এ রহস্য সমাধান করতে হলে যেতে হবে আশির দশকে। জনশ্রুতি আছে, ১৯৮০-এর দশকে আর্জেন্টিনার একটা ফুটবল দলের নাম ছিল এস্তুদিয়েন্তেস দে লা প্লাতার। এই ক্লাবের একজন পাগল ভক্ত ছিল। তাঁর নাম কিরিকোচা। দলের নিয়মিত অনুশীলন পর্যন্ত দেখতে আসত কিরিকোচা। কিন্ত দুঃখের ব্যাপার, প্রতিদিন ওই ক্লাবের কেউ না কেউ ইনজুরিতে পড়ত। তখন মন খারাপ হতো তাঁর। তবে কিরিকোচার সঙ্গে সঙ্গে আরও একজনের মন খারাপ করতেন–দলের কোচ কার্লোস বিলার্দো। নামকরা কোচ তিনি। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন । অভিজ্ঞ এই কোচ খেয়াল করলেন, কিরিকোচা অনুশীলন দেখতে এলেই কেউ না কেউ অসুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু কী আর করা! কিরিকোচাকে তো আর বলা যায় না যে তুমি একটা অভিশাপ, আর আমাদের খেলা দেখতে এসো না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই কোচ একটা বুদ্ধি আঁটলেন।
একদিন কিরিকোচাকে কাছে ডাকলেন। প্রস্তাব করলেন বিপক্ষ দলের অনুশীলন দেখতে যাওয়ার। কিরিকোচা যদি বিপক্ষ দলের অনুশীলনে উপস্থিত থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের খেলোয়াড়রা অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই বিশ্বাস নিয়েই কিরিকোচাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন কোচ। কিরিকোচাও রাজি হলেন। এমন বড় মাপের একজন কোচের কথা ফেলবেনই বা কীভাবে!
এস্তুদিয়েন্তেসের খেলার আগে প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে উপস্থিত হতেন কিরিকোচা। আর তাতেই কাজ হতে লাগল। অসুস্থ বা ইনজুরিতে পড়তে শুরু করল খেলোয়াড়েরা। আর এতে ম্যাচ জিতে যেত ক্লাব এস্তুদিয়েন্তেস। ১৯৮২ সালে ক্লাবটি শিরোপা জিতেছিল। ম্যাচ হেরেছিল মাত্র একটা। রহস্যজনকভাবে সেই হারা ম্যাচের আগে কিরিকোচা অনুশীলনে যাননি। আসলে অসুস্থ থাকার কারণে অনুশীলন দেখতে যেতে পারেননি তিনি।
কিরিকোচার এই কাহিনি দ্রুত স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে। কুসংস্কারকে আলিঙ্গন করে নেয় সমর্থকরা। যখনই বিরোধী দলের খেলোয়াড়েরা গোল দেওয়ার অবস্থায় যায়, তখনই তারা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে কিরিকোচা। স্পেনে এই কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনেও আছে কোচ বিলার্দোর ভূমিকা। তিনিই নব্বইয়ের দশকে স্পেনের ক্লাব সেভিয়ার কোচ ছিলেন।
এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ২০২০ সালের ইউরোতে কিলিয়ান্নি ও সাকার ঘটনা তো শুরুতেই বললাম। এরপর ২০২১ সালে কিরিকোচা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার আর্লিং হালান্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি পায় ডর্টমুন্ড। গোল করতে আসেন হালান্ড। বল কিক মারার সময় উচ্চারণ করেন কিরিকোচা শব্দটি। ফলে বল গোলের দিকে যাওয়ার আগেই গোল পোস্ট ছেড়ে সরে যান ইয়াসিন বুনু। এরপর হালান্ড আবার কিক মারেন। সেবার গোল দিতে সক্ষম হয়েছিলেন হালান্ড। কিন্তু এই শব্দের মানে তখনো জানতেন না এই তারকা। এর ঠিক কিছুক্ষণ আগেই একটা পেনাল্টি মিস করেছিলেন হালান্ড। আর তখন কিরিকোচা শব্দটি বলেছিল বুনু। এই কারণে পরের পেনাল্টি কিক দেওয়ার সময় হালান্ডও না বুঝে একই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
এই অভিশাপ যে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সমর্থকদের মনেই ভালোই গেঁথে গেছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে ২০২০ সালের ইউরো ফাইনালে কিয়েলিন্নির ওই কাহিনির পর মানুষ আরও বেশি বিশ্বাস করতে থাকে এই অভিশাপ, যার সূত্রপাত করেছিলেন কুসংস্কারাছন্ন কোচ বিলার্দো। তারপর নিজেই তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই কি এমন কোনো অভিশাপ আছে বা থাকতে পারে?
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, এই সম্পূর্ণ বিষয়টাই একটা কুসংস্কার মাত্র। অনুশীলনে প্রায়ই খেলোয়াড়েরা অসুস্থ হন। কারো খেলা দেখা বা না দেখার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মনের জোর বলতে একটা কথা আছে। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে এই শব্দের সাহায্যে অভিশাপ দেওয়া যায়, তাহলে সে আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে খেলতে পারে। আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে খেললে ফল তো ভালো হবেই। এরসঙ্গে নির্দিষ্ট কোনো শব্দের যোগ থাকতে পারে না। আধুনিক যুগে এসে এ কথা বিশ্বাস করাও কঠিন। কিন্তু তবুও কেউ কেউ এই অভিষাপ বিশ্বাস করেন এবং প্রয়োজনে তা ব্যবহারও করেন।
সূত্র: গোল ডট কম ও ইউরো স্পোর্টস ও মোজার্টস্পোর্টস ডট কেই