টাকা দিয়ে সমাধান খুঁজছে ম্যান সিটি

ভুলে যাওয়ার মতো একটা মৌসুম পার করছে ম্যান সিটি। লিগের দৌড় থেকে অনেক দূরে তারা, শেষদিনে নিশ্চিত করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্লে-অফ। এমনসময় দরজার কড়া নেড়েছে শীতকালীন দলবদলের বাজার। সিটিও লেগেছে উঠেপড়ে। বাজারে সবচেয়ে বেশি খরচ করে কেমন দল গড়ল সিটি? 

দূঃস্বপ্ন কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেপ গার্দিওলার মতো করে আর কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। এই মৌসুমটা যেন তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল। হারের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া ম্যান সিটি যেন তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা এক বানর। এক কদম উঠতেই দুই কদম পিছিয়ে যায়। গত কয়েক মৌসুম ধরে প্রিমিয়ার লিগে রীতিমতো অপরাজেয় ম্যান সিটি, এই মৌসুমে নিজেদের খুঁজে ফিরছে। শিরোপার লড়াই দূরে থাক, চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ পাওয়া নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ রাতে কষ্টার্জিত এক জয় দিয়ে নিশ্চিত করেছে প্লে-অফ রাউন্ড। 

মৌসুমের মাঝপথে ম্যান সিটি এভাবে খেই হারাবে, এমনটা কল্পনাতেও মাথায় আসেনি কারো। একের পর এক চোট, মূল খেলোয়াড়দের অফ ফর্ম আর ফিটনেসের ঘাটতি সঙ্গে পেপ গার্দিওলার ট্যাক্টিসের ভয়াবহ পতন– সবমিলিয়ে এখনও নিজেদের সামলে উঠতে পারেনি প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সফল দলটি। আর মৌসুমের প্রথমার্ধে দল যখন হালে পানি না পায়, তখনই দলগুলো শরণাপন্ন হয় ট্রান্সফার মার্কেটের। আর দলবদলের মৌসুমে পয়সার ছড়াছড়ি করতে ওস্তাদ কারা, সেটা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। 

এবারের দলবদলের মৌসুমে যে আঁটঘাট বেঁধে বাজারে নামবে সিটি, সেটা অনুমিতই ছিল। পয়সা ছড়ালে যে সমাধানের অভাব হয় না, সেটা তাদের খুব ভালোভাবেই জানা। তবে টাকার অঙ্কটা এতটা ফুলেফেপে উঠবে, সেটা ভাবনাতেও ছিল না কারও। এই দলবদলের মৌসুমে ম্যান সিটি খরচ করেছে মোট ১৮০ মিলিয়ন পাউন্ড। আর বাকি ১৯ দল মিলে করেছে ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ড! পুরো প্রিমিয়ার লিগকে একাই টেক্কা দিয়েছে সিটি। কিন্তু সিটির ডিফেন্স আর আক্রমণের ফাকফোঁকরগুলো পূরণ হলো তো? 

টানা হারে সিটি একাদশের প্রতিটি সমস্যা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সকলের কাছে। একে তো চোটের কারণে লম্বা সময় ধরে মাঠের বাইরে রদ্রি ও রুবেন ডিয়াস। সিনিয়র দুই খেলোয়াড়ের অভাব বেশ ভুগিয়েছে সিটিকে। তাদের ব্যাকআপ খেলোয়াড়েরাও সময়ে অসময়ে চোটের কারণে ছিলেন মাঠের বাইরে। ফলে রক্ষণ ও মধ্যমাঠের বোঝাপড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সিটির। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যাকআপ স্ট্রাইকারের অভাব। জুলিয়ান আলভারেজের রেখে যাওয়া শুণ্যস্থান পূরণ করতে পারেননি কেউ। ফলে প্রতিটি পজিশনেই তরুণ এবং দক্ষ খেলোয়াড়ের খুঁজে ছিল সিটি। 

আরও পড়ুন

বছরের প্রথম দল বদলটাই হয়েছে সব হিসেব-নিকেশ মাথায় রেখে। ৬ ফুট ১ ইঞ্চির উজবেক ডিফেন্ডার আবদুকাদির খুসানোভ প্রথম নজর কাড়েন অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের পর যোগ দেন লেন্সে। তার বিশাল শরীর আর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে দলের মধ্যে তার ডাকনাম ‘মনস্টার’। বয়সটা মাত্র ২০ হলেও মাটিতে ও বাতাসে, দুই জায়গাতেই সমান পারদর্শী তিনি। ফলে তাঁর জন্য ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ড ঢালতে দুইবার ভাবেনি সিটি। 

তার ঠিক একদিন পর ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার ভিতোর রাইসকে দলে ভেড়ায় সিটি। ১৯ বছর বয়সী ডিফেন্ডারকে ধরা হয়ে ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ ডিফেন্সের কাণ্ডারি। লিকলিকে শরীরের ডিফেন্ডার যেমন হাওয়ায় ভাসতে পারেন, তেমনই বল পায়েও বেশ পারদর্শী। সিটির খেলার স্টাইলের সঙ্গে যা মানিয়ে যায় সহজেই। ব্রাজিলের পালমেইরাস থেকে দলে টানতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। 

ডিফেন্সের দুশ্চিন্তা কমলেও মাঝমাঠ আর আক্রমণভাগ সাজানো তখনও বাকি ছিল সিটির। বিশেষ করে ব্যালন ডি’অর জয়ী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রির রিপ্লেসমেন্ট তখনও হাতড়ে ফিরছে তারা। নিউক্যাসলের ব্রুনো গুইমারেস, ক্রিস্টাল প্যালেসের অ্যাডাম ওয়ারটনের জন্য প্রথমে চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু ফিরতে হয়েছে ব্যর্থ হয়ে। অবশেষে নজর পরে পোর্তোর ২৩ বছর বয়সী মিডফিল্ডার নিকো গঞ্জালেজের দিকে। লা মাসিয়াতে থাকাকালীন সময় থেকেই তার দিকে আলাদা নজর ছিল সিটির। গত মৌসুমে বার্সা ছেড়ে যোগ দেন পোর্তোতে। সেখান থেকে হয়ে উঠেন পোর্তোর ভরসার পাত্র। কিন্তু স্প্যানিশ মিডফিল্ডারকে এত সহজে ছাড়তে রাজি ছিল না পর্তুগিজ দলটি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে দলবদলের মৌসুম শেষ হওয়ার একদম আগ মুহূর্তে তাকে দলে ভেড়ায় সিটি। ‘ডেডলাইন ডে’তে এসে তাকে ভেড়াতে সিটির খরচ হয় মোট ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। 

মৌসুমের শুরুতে জুলিয়ান আলভারেজকে ছেড়ে দিয়েছিল সিটি। একা হল্যান্ডের উপর পরেছিল আক্রমণের সব দায়িত্ব। হল্যান্ড যখন একটু হোঁচট খেলেন, আক্রমণভাগ থেকেও বন্ধ হয়ে গেল গোল আসা। দলবদলের মৌসুমে তাই একটা স্ট্রাইকারের খোঁজ করছিল তারা। আর সেটাই খুঁজে পেয়েছে মিশরীয় তারকা ওমর মারমুশের মাঝে। গোলমুখে ক্ষিপ্র আর  বেঞ্চ থেকে নেমে ফলাফল বদলে ফেলার ক্ষমতা আছে তার। গত মৌসুমে ফ্র্যাঙ্কফ্রুটের জার্সিতে ২৬ ম্যাচে করেছেন ২০ গোল। তাই তাকে ভেড়াতে বড় অঙ্ক খরচ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি সিটি। ৬২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে সিটিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। যদিও ২ ম্যাচ খেলে এখনও গোলের দেখা পাননি মিশরীয় তারকা।

আরও পড়ুন

শুধু যে খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়ে ক্ষান্ত হয়েছে সিটি তা কিন্তু নয়। নিজের সবচেয়ে কাছের সেনানিকে ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি পেপ গার্দিওলা। ৮ মৌসুম সিটি রাইটব্যাক পজিশন সামলানোর পর সিটি ছেড়ে মিলানে যোগ দিয়েছেন কাইল ওয়াকার। বেশ অনেকদিন ধরেই আগের সেই ফর্ম কিংবা ক্ষিপ্র গতি কোনটাই আয়ত্ত্বে আনতে পারছিলেন না ওয়াকার। বিশেষ করে সিটির দেড় মাসের ‘হারযাত্রা’য় তার বাজে ফর্ম ছিল অন্যতম বড় সহায়ক। দলের সিনিয়র ডিফেন্ডার হয়েও খুব একটা কিছু করতে পারেননি তিনি। ফলে তাকে ছেড়ে দেওয়াই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। ৩২ বছর বয়সী ডিফেন্ডারকে ৬ মাসের জন্য ধারে নিয়েছে এসি মিলান। তবে তাইলে পাকাপাকিভাবে কিনে নেওয়ার সুযোগও থাকবে তাদের কাছে। 

খরচের খেড়োখাতা মিলিয়ে মাঠে ফেরাটা সুখকর হয়নি সিটির। শিষ্য মিকেল আর্তেতার কাছে ৫-১ গোলে হারের লজ্জা পেতে হয়েছে তাদের। নতুন খেলোয়াড়দের নিয়ে পেপ গার্দিওলা কতটা সামলাতে পারেন দল, সেটা এখন দেখার বিষয়। 

আরও পড়ুন