বাংলাদেশের পক্ষে ৫০ গোল করা তহুরার গল্প
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমবার বিদেশ গেছেন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী টুর্নামেন্ট খেলতে কাঠমান্ডু যাওয়ার স্মৃতিটা আজীবন মনে রাখবেন তিনি। ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে জীবনে প্রথম লিফট দেখেন। কিন্তু লিফটে উঠবেনই না! অন্যরা সব উঠে ওপরে চলে গেলেও তহুরা খাতুন লিফটের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।
তারপর? ‘জীবনে প্রথমবার লিফটে উঠব কীভাবে, সাহস পাচ্ছিলাম না। কী করব, কী করব। ভয় লাগছিল। সঙ্গে ছিল তাসলিমা নাসরিন, আমার এলাকার মেয়ে। আমাদের দলেরই খেলোয়াড়। সে জোর করে ওঠায় আমাকে লিফটে। স্যাররা এটা দেখে হাসেন,’ তহুরা খাতুন একনিশ্বাসে বলে যান।
লিফটে ওঠার বিড়ম্বনা সামলে বিমানে ওটার পর কী হলো, সেটাও দ্রুত বলতে থাকেন। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অপরিহার্য এই ফুটবলার ফিরে তাকান সাত বছর আগে তাঁর প্রথম বিদেশ যাওয়ার দিনটিতে, ‘প্রথমবার বিমানে উঠছি। কেমন জানি লাগছিল। কিছুটা ভয় ভয়। শব্দ হচ্ছিল। তাই কান চেপে ধরে আছি। আমার সঙ্গে সিট পড়েছিল তাসলিমার। ফলে একটু সাহস পাই। একটু চোখ বন্ধ করে রাখার পর ঘুম চলে আসে। খানিকক্ষণ পর দেখি নেপালে চলে এসেছি (হা হা হা)।’
সেবার ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড হয়ে যায় নেপাল। ভূমিকম্পের সময় কাঠমান্ডুতেই হোটেলে ছিল বাংলাদেশ দল। সে এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। তহুরা তা কখনো ভুলবেন না। ভুলবেন নিজের ছোটবেলার কথাও। যখন তিনি আর দশটা গ্রামের মেয়ের চেয়ে একটু আলাদা ছিলেন। দিনভর মাছ ধরার নেশা ছিল তাঁর। এতটাই যে ঈদের দিনও নাকি মাছ ধরতেন।
তহুরার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার বিখ্যাত কলসিন্দুর গ্রামে। যে গ্রামের পরিচয়ই হয়ে গেছে ‘ফুটবলের গ্রাম’। বাবা ফিরোজ মিয়া চাষাবাদ করতেন নিজস্ব জমিতে, এখন সেভাবে করেন না। মা সাবেকুন নাহার গৃহিণী। পাঁচ বোন, এক ভাই। সবার বড় বোন, তারপর ভাই, তৃতীয় তহুরা। স্কুলে তহুরার মূল নাম ছিল সারাবান তহুরা। কিন্তু পাসপোর্টে দেওয়া হয় তহুরা খাতুন। এ নিয়ে তহুরার মনে রয়ে গেছে আফসোস।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে তাঁর। যদিও সেটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ঢাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্যাম্পে আসার আগে তাঁর জীবনটা ছিল শৈশবের চঞ্চলতায় ভরপুর। এখন বাফুফে ভবনে ক্যাম্পের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন আর আগে ছিল মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়ানোর সময়। তহুরা স্মৃতিতে তুলে আনেন সেসব দিন, ‘ছোটবেলায় ঘরের বাইরের কাজ বেশি করতাম আমি। বাবার সঙ্গে খেতে ধান লাগানোর কাজ করা হতো। ভাই আমার দুই বছরের বড়। আমি খেতে কাজ করতে না গেলে সে–ও যেতে চাইত না। অনেক কাজ করেছি আমি খেতে। আর আমি প্রচুর মাছ ধরতাম ( হাসি)।’
শুধু বাড়ির পুকুরে নয়। বাড়ির পাশে বিলেও যেতেন মাছ ধরার নেশায়। ‘রোদ, বৃষ্টি যা–ই হোক, আমি বিলে যেতাম। কেউ বিলে নেই কিন্তু আমি আছি। একা একা হলেও বিলে যেতাম। কেউ মাছ ধরতে পারেনি কিন্তু আমি ধরে আনতাম। এটা আমার আম্মা এখনো সবাইকে বলে,’ বলে যান বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ‘মেসি’। যোগ করেন, ‘ঈদের দিনও আমি মাছ ধরতে গেছি। বাড়িতে এলে আমাকে বকা দেওয়া হয়। সব ছেলেমেয়ে ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরছে আর আমি মাছ ধরছি! আসলে মাছ ধরে আমার সঙ্গে কেউ পারত না। এখনো বাড়ি গেলে মাছ ধরি। কখনো জাল দিয়ে, কখনো হাত দিয়ে। আমি পাখিও মারতাম। সবাই মজা করে বলত, পাখি মারি বলে আমার স্বাস্থ্য কম।’
ছোটবেলার জীবনটা অন্য রকমই কেটেছে তাঁর। একই এলাকা থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় দলের দুই শামসুন্নাহার। ছিলেন সাবিনা (মারা গেছেন)। তাঁরা ভালো বন্ধু ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার সময় চারজন জাম পাড়তে পাড়তে যেতেন। আসার সময়ও জাম পাড়তেন। তহুরা ডুব দেন সেই সময়ে, ‘মানুষ দেখলে আমাদের দৌড়ানি দিত। মানুষের টিনের চালে মারতাম। আমি আর ছোট শামসুন্নাহার পুকুরের পাড় থেকে গাছে ঢিল মেরে বরই পাড়তাম। শামসুন্নাহার, সাবিনা দেখত। সেই দিনগুলো ছিল অনেক আনন্দের।’
ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন তহুরা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন তখন। কলসিন্দুর স্কুলের মাঠেই খেলতেন। মফিজ স্যার বলেছিলেন, ‘তুই প্রতিদিন স্কুলে আসবি। প্র্যাকটিসের সময় থাকবি মাঠে।’ ২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টে খেলেন। পরের দুই বছরও খেলেন বঙ্গমাতায়। কলসিন্দুর স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়ে আলোড়ন তোলে। তহুরাও ছিলেন যার অংশ।
তারপর জীবন এগিয়েছে অনেক দূর। তহুরা এখন বাংলাদেশের জার্সিতে ৫০টি গোলের মালিক। জাতীয় দলের হয়ে ছয়-সাতটি বাদে বাকি সব গোল বয়সভিত্তিক ফুটবলে। সর্বশেষ ১ ও ৪ ডিসেম্বর ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দুটি ফিফা প্রীতি ম্যাচে ৪ গোল করেন তহুরা। বাংলাদেশ জেতে ৩-০ ও ৮-০ গোলে। অথচ নানা হতাশায় তহুরা খেলাই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন গত জুনে। বাড়িও চলে যান বাফুফের ক্যাম্প ছেড়ে। সব হতাশা দূর করে তহুরা ফিরেছেন ফুটবল মাঠে। তহুরা–ফুল অকালে শুকিয়ে যায়নি।