ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ: ম্যাচউইক ২৩ রিভিউ
‘আমাদেরও একটা আছে, তোমাদের শুণ্য’
মৌসুমের মাঝপথে এসে কমবেশি সকল দলেরই একই অবস্থা, পান থেকে চুন খসলেই পা ফসকাতে হবে। নির্ভার থেকে মাঠে নামার অবস্থায় নেই কেউ। এমন অবস্থায় কেমন গেল প্রিমিয়ার লিগের ২৩তম সপ্তাহ। দেখে নেওয়া যাক এক নজরে।
বোর্নমাউথ ৫-০ নটিংহাম ফরেস্ট
বোর্নমাউথ: জাস্টিন ক্লুইভার্ট ৯, ডঙ্গো ওউতারা ৫৫’, ৬১’, ৮৭’, অ্যান্তোনি সেমেনিয়ো ৯০+১’
সপ্তাহের প্রথম ম্যাচটাই চমকে দিয়েছে সকলকে। হারতে ভুলে যাওয়া দুই দলের লড়াই এতটা জমজমাট হবে, সেটা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি কেউ। ম্যাচের ফল দেখে অবশ্য বোঝা যাবে না তা, কিন্তু টানটান একটা ম্যাচই দেখেছে প্রিমিয়ার লিগ। মৌসুমের শুরু থেকে ফর্মের তুঙ্গে থাকা নটিংহাম ফরেস্ট হোঁচট খেল বোর্নমাউথের কাছে এসে। এটাকে অবশ্য হোঁচটের বদলে অপদস্ত হওয়া বললেই ভালো হবে। পুরো প্রিমিয়ার লিগকে ঘোল খাওয়ানো নটিংহাম ফরেস্টকে নিজেদের মাটিতে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়েছে আন্দোনি ইরাওলার শিষ্যরা। ফরেস্টের হয়ে গোলের খাতা খোলেন জাস্টিন ক্লাইভার্ট। প্রথমার্ধে গোল হয়েছিল একটাই। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে যেন আরও ভয়ানকরূপে ফিরে আসে বোর্নমাউথ। ডঙ্গো ওউতারা করেছেন হ্যাটট্রিক। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পর জালে বল জড়িয়েছেন সেমেনিয়ো। টানা আট ম্যাচ আর দেড় মাস অপরাজেয় থাকার পর অবশেষে হারের মুখ দেখল নুনো এস্পারিতো সান্তোর দল। প্রিমিয়ার লিগে চমক দেখানোর পথে হার একটা বড় বাধা হয়ে নেমে এল তাদের ওপর।
ব্রাইটন ০-১ এভারটন
এভারটন: ইলিমান এনদিয়ায়ে ৪২’ (পেনাল্টি)
ডেভিড ময়েসের প্রত্যাবর্তন নিয়ে চোখ কপালে উঠেছিল অনেকেরই। যে এভারটনকে রেখে গিয়েছিলেন, সেই এভারটন পথ হারিয়েছে অনেকদিন আগেই। নতুন করে পথের দিশা দিতে পারবেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকের। কিন্তু ৬১ বছর বয়সী কোচ যেন উত্তরপত্র তৈরি করেই মাঠে নেমেছেন। ব্রাইটনের মাটিতে গিয়ে ব্রাইটনকে হারিয়েছেন। একমাত্র গোলটা এসেছে ২৪ বছর বয়সী সেনেগালিজ মিডফিল্ডার ইলিমান এনদিয়ায়ে। তবে সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্ন হানা দিয়েছে তার ডাগআউটে। এক ম্যাচেই চোটের কারণে হারিয়েছেন দুই তারকাকে। ম্যাচের ১৩ মিনিটে ডমিনিক কালভার্ট-লেওয়িন ও ৮৪ মিনিটে ওরেল মানগালাকে উঠিয়ে নিতে হয় চোটের কারণে। ব্রাইটনের দূর্ধর্ষ আক্রমণভাগ ম্লান হয়ে ছিল এভারটনের দূর্দান্ত ডিফেন্সের কাছে। এই জয় দিয়ে অবনমনের সারি থেকে উঠে এল এভারটন।
লিভারপুল ৪-১ ইপসউইচ টাউন
লিভারপুল: ডমিনিক সোবোজলাই ১১’, মোহাম্মদ সালাহ ৩৫’, কোডি গ্যাকপো ৪৪’, ৬৫’
ইপসউইচ: জ্যাকব গ্রেভস ৯০’
ঠিক ১ বছর আগে লিভারপুল থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। সেদিন অনেক লিভারপুল ফ্যানের মাথাতে উঁকি দিয়েছিল দুশ্চিন্তা, ক্লপের পর দলকে কে সামলাবেন? কীভাবে সামলাবেন? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে এ+ নিয়ে পাশ করেছেন আর্নে স্লট। ইপসউইচ টাউনের বিপক্ষে ম্যাচটা যেন সেটার আরেকটি প্রমাণ। ২২ ম্যাচের মধ্যে ১৬টিতে জয় তুলে নিয়েছে অল রেডসরা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আর্সেনাল থেকে এগিয়ে আছে ৬ পয়েন্টে, সেটাও এক ম্যাচ কম খেলে। ম্যাচের শুরু থেকে ইপসউইচকে বিন্দুমাত্র জায়গা ছাড় দেয়নি লিভারপুল। প্রথমার্ধেই তিন গোলের লিড পেয়ে যায় তারা। দ্বিতীয়ার্ধে নিজের দ্বিতীয় গোল সম্পন্ন করেন কোডি গ্যাকপো। ম্যাচের শেষ মিনিটে এসে স্বান্তনাসূচক গোল দেন ইপসউইচের জ্যাকব গ্রেভস। এই হার দিয়ে এখনও অবনমনের সারিতে লড়াইয়ে ব্যস্ত ইপসউইচ।
সাউদাম্পটন ১-৩ নিউক্যাসল ইউনাইটেড
সাউদাম্পটন: জ্যান বেদনারেক ১০’
নিউক্যাসল: অ্যালেজেন্দার ইসাক ২৬’ (পেনাল্টি) ৩০’, সান্দ্রো তোনালি ৫১’
৯ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গত সপ্তাহে চুরমার করে দিয়েছে বোর্নমাউথ। চুরমার করে দিয়েছে ইসাকের টানা গোলের রেকর্ডও। প্রিমিয়ার লিগের শেষ চারে ফিরতে হলে বড়সর একটা ধাক্কা প্রয়োজন ছিল নিউক্যাসলের। বোর্নমাউথের বিপক্ষে সে ধাক্কা যেন চোখ খুলে দিয়েছে তাদের। সাউদাম্পটনের বিপক্ষে হেসেখেলে জয় যেন সেটারই প্রমাণ। জ্যান বেদনারেকের গোলে প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল সাউদাম্পটন। অতঃপর ফর্মে ফেরে নিউক্যাসল। গত ম্যাচের গোলশূণ্য থাকা ইসাক ফিরেছেন দূর্দান্তরূপে। করেছেন জোড়া গোল। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবধান বাড়িয়েছেন সান্দ্রো তোনালি। জয় পরও শীর্ষ চারে প্রবেশ করতে পারেনি ম্যাগপাইরা। গোলব্যবধানে পিছিয়ে থেকে আছে পঞ্চম স্থানে।
উলভস ০-১ আর্সেনাল
আর্সেনাল: রিকার্দো কালাফিউরি ৭৪’
ম্যাচের মূল প্রাণ কী? যে কেউ উত্তর দিবেন খেলোয়াড়েরা। এই ম্যাচে অবশ্য হয়েছে তার উল্টোটা। পুরো ম্যাচের আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছেন রেফারি মাইকেল অলিভার। দুই দলের দুই খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে ম্যাচের সব আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছেন তিনি একাই। আর্সেনাল মাঠে নেমেছিল মার্তিন ওডেগার্ড ও মিকেল মেরিনোকে ছাড়া মাঠে নেমেছিল গানার্সরা। ৪৩ মিনিটে ম্যাট ডোহার্টিকে ফাউল করায় সরাসরি লাল কার্ড দেখান মাইলেস লুইস-স্কেলিকে। বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডার পরও সিদ্ধান্ত একই রাখেন তিনি। ৭০ মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠে ছাড়েন উলভস মিডফিল্ডার হোয়াও গোমেস। ৭৪ মিনিটে দলকে এগিয়ে নেন রিকার্দো কালাফিউরি। তার একমাত্র গোলেই জয়ের দেখা পায় আর্সেনাল।
ম্যানচেস্টার সিটি ৩-১ চেলসি
সিটি: জ্যাসকো গার্ভিদল ৪২’, আর্লিং হল্যান্ড ৬৮’, ফিল ফোডেন ৮৭’
চেলসি: ননি মাদুয়েকে ৩’
আস্তে আস্তে যেন পর্দার আড়াল থেকে বের হতে শুরু করেছেন ম্যান সিটি। প্রায় দেড় মাস জয়শূণ্য থাকার পর আবারও নিজেদের সাধারণ খেলে খেলতে শুরু করেছে পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মাতেও কোভাচিচ আর ফিল ফোডেনের। দীর্ঘ ইঞ্জুরি আর অফ ফর্মের পর দুজনই আবারও স্থায়ী হয়েছেন সিটির শুরুর একাদশে। আর তাদের ফর্মের ওপর ভর করে একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে সিটি। ইতিহাস স্টেডিয়ামে অবশ্য গোলের শুরু করেছিল চেলসিই। ৩ মিনিটে ডিফেন্ডার আব্দুকাদির খুসানোভের ভুলে দলকে এগিয়ে নেন ননি মাদুয়েকে। নতুন খেলোয়াড়ের এমন ভুলকে মাথার উপর চেপে বসতে দেননি সতীর্থরা। ৪২ মিনিটে দলকে সমতায় ফেরান জ্যাসকো গার্ভিদল। ৬৮ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে দূর্দান্ত এক গোলে দলকে এগিয়ে নেন হল্যান্ড। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে এটা ছিল তার আঠারোতম গোল। আর চেলসির কফিনে শেষ পেরেক মারেন ফিল ফোডেন। এই জয় দিয়ে আবারও শীর্ষ চারে প্রবেশ করল সিটি। অন্যদিকে দুই ধাপ পিছিয়ে চেলসি নেমে গেল ছয়ে।
ক্রিস্টাল প্যালেস ১-২ ব্রেন্টফোর্ড
প্যালেস: রোমেইন ইসে ৮৫’
ব্রেন্টফোর্ড: ব্রায়ান এমবুয়েমো ৬৬’ (পেনাল্টি), কেভিন শাদ ৮০’
ঘরের বাইরে নাকি ব্রেন্টফোর্ড যেতে না। মৌসুমের শুরু থেকে এই অপবাদ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল তাদের নামের পাশে। অবশ্য মাঝপথ থেকে সেটাও বদলে গিয়েছে, গত নয় ম্যাচে এক জয় নিয়ে ঘরে-বাইরে উভয় জায়গাতে বেশ বিপাকে আছে তারা। এই জয়টা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে তাদের কাছে। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে শুরুটা হয়েছিল ব্রেন্টফোর্ডের হাত ধরে। পেনাল্টি থেকে দলকে এগিয়ে নেন এমবুয়েমো। ৮০ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কেভিন শাদ। ৫ মিনিট পর রোমেইন ইসে গোল করলেও ম্যাচের ফিরতে পারেনি তারা। ঘরের মাটিতে হার দিয়ে ম্যাচ শেষ করতে হয় তাদের।
টটেনহাম হটস্পার্স ১-২ লেস্টার সিটি
স্পার্স: রিচার্লিসন ৩৩’
লেস্টার: জেমি ভার্দি ৪৬’, বিলাল এল খানাউস ৫০’
শেষ বাঁশি বাজার পর স্পার্স কোচ আগ্নে পোস্তকোগলুর শুণ্য দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল, ঠিক কতটা শুণ্য হয়ে আছে টটেনহামের পয়েন্ট টেবিল। একের পর এক ম্যাচ চলে যাচ্ছে, জয় দূরে থাক ড্রয়ের সম্ভাবনাও তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে টটেনহাম। অথচ ম্যাচের শুরু থেকে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল তারাই। ৩৩ মিনিটে দূর্দান্ত এক হেডারে দলকে এগিয়ে নেন রিচার্লিসন। চোট থেকে ফিরে গোলমুখে কিছুটা হলেও চেষ্টা করছেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার। কিন্তু বাকি দল যেন আটকে আছে পুরোনো বৃত্তেই। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতে না হতে আয়েশী ডিফেন্ডারদের সুযোগ নেন জেমি ভার্দি। দলকে ফেরান সমতায়। আর তারপরই স্পার্স দর্শকদের সামনে উদযাপন করেন প্রিমিয়ার লিগের লোগো দেখিয়ে। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, লেস্টারের একটা প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা আছে, টটেনহামের নেই। ৪ মিনিট পর আব্রও ডিফেন্ডারের ভুল, ডি-বক্সের বাইরে থেকে দূর্দান্ত এক গোলে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন বিলাল এল খানাউস। এরপর আর গোলের দেখা পাননি কেউ। এই হারের পরও আগ্নে পোস্তকোগলুর ডাগআউটে টিকে থাকা বেশ আশ্চর্যজনকই হবে। অন্যদিকে রুড ফন নিস্টলরয় বেশ আয়েসেই থাকবেন। হাজার হলেও তার দল এখন অবনমনের সীমার বাইরে।
অ্যাস্টন ভিলা ১-১ ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড
ভিলা: জ্যাকব রামসি ৮’
ওয়েস্ট হ্যাম: এমারসন ৭০’
চ্যাম্পিয়নস লিগের আগে একটা ভালো রাতে অপেক্ষায় ছিল অ্যাস্টন ভিলা। বরং রাত যত গভীর হয়েছে, উনাই এমেরি যেন তত হতভাগ্য হয়েছেন। ৮ মিনিটে জ্যাকব রামসির গোলে এগিয়ে গিয়েছিল ভিলা। এরপর থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ হানা দিয়েছে তার কাছে। চোটের কারণে দলে ছিলেন না পাউ তোরেস, নিয়মিত ডিফেন্ডার টাইরন মিংসও মাঠ ছেড়েছেন কাঁদতে কাঁদতে। দল ছাড়বেন বলে দলের সঙ্গে ছিলেন না ডিয়েগো কার্লোস। ফলে লেফট ব্যাক লুকাস ডিগনেকে দিয়ে জোড়াতালির দল চালাতে হয়েছে তাকে। জোড়াতালি অবশ্য টেকেনি বেশিক্ষণ। ৭০ মিনিটে দূর্দান্ত এক হেডে ওয়েস্ট হামকে সমতায় এমারসন। ১-১ গোলে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে দুই দল।
ফুলহাম ০-১ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ইউনাইটেড: লিসান্দ্রো মার্তিনেজ ৭৮’
ঘরের বাইরে খেলা হলে কি রুবেন আমোরিম মনে মনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন? ফেলাটা স্বাভাবিক। ঘরের মাটিতে যতটা বাজে অবস্থা, ঘরে বাইরে তার থেকে অনেকটা ভালো। ঘরের মাটিতে অপদস্ত হয়েছেন ব্রাইটন, নিউক্যাসল, বোর্নমাউথের কাছে। অপরদিকে প্রতিপক্ষের মাটিতে গিয়ে হারিয়েছেন সিটিকে, ড্র করেছেন লিভারপুলের সঙ্গে। এবার তো জয় ছিনিয়ে আনলেন ফুলহামের কাছ থেকে। জয়ের জন্য অবশ্য ভাগ্য বেশ সাহায্য করেছিল বটে। ডি-বক্সের বাইরে থেকে লিসান্দ্রো মার্তিনেজের শট গোলরক্ষকের হাত ছুঁয়ে প্রবেশ করে জালে। ম্যাচের শেষদিকে দূর্দান্ত এক গোল লাইন ক্লিয়ারেন্স করে দলকে বাঁচান টবি কলিয়ের। শেষ মুহূর্তে আরেকটি গোল করলেও অফসাইডের জন্য বাতিল হয়ে যায় তা।