উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ক্রিকেটের গোড়াপত্তনের পর কেটে গেছে অনেক বেলা। শুরুর দিকে ক্রিকেট বলতে টেস্ট ম্যাচকেই বুঝত সবাই। তখন একটাই ফরম্যাট ছিল ক্রিকেটের—টেস্ট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে ক্রিকেট কর্তাদের মনে হলো, শুধু পাঁচ দিনব্যাপী ম্যাচ না খেলে এক দিনের ম্যাচ খেললে কেমন হয়? এমন ভাবনা থেকেই ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি পৃথিবী দেখে ক্রিকেটের এক নতুন ফরম্যাট—এক দিনের ম্যাচ। মূলত তখন থেকেই ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণের শুরু। সবাই বুঝতে পারলেন, ক্রিকেটকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটাই উপায়—খেলাটার দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা।
এই ভাবনা থেকেই ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি শুরু করে ক্রিকেটের আরেকটি নতুন সংস্করণ—টি-টোয়েন্টি। ২০ ওভারের এই খেলাকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পরের বছরেই দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করে আইসিসি। সেই শুরু। এর পর থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উত্তেজনা। জনপ্রিয়তা বুঝতে ভুল করেনি আইসিসিও। তাই ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো চার বছর পরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন না করে দুই বছর পরপর আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয় ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
তাই অল্প সময়েই অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সাতটি আসর। এর মধ্যে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে দুইবার। বাকি পাঁচবার শিরোপা জিতেছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। এই বিশ্বকাপগুলোতে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে টুর্নামেন্ট–সেরা হয়েছেন বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়েরা। বিশ্বকাপজয়ী দলের হাতেই যে সব সময় টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার উঠেছে, তা কিন্তু নয়। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটে–বলে অনবদ্য পারফরম্যান্সে যিনি দলকে জিতিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূর, টুর্নামেন্ট–সেরা হয়েছেন তিনিও। চলো, দেখে নেওয়া যাক এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপগুলোর সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন কোন কোন খেলোয়াড়।
শহীদ আফ্রিদি (২০০৭)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসেছিল ২০০৭ সালে। সে বছরের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। দারুণ ফর্মে ছিল রিকি পন্টিংয়ের দল। সবাই ভেবেই নিয়েছিল, ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের বিশ্বকাপটাও অস্ট্রেলিয়ার হাতেই যাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বকাপ জিতল ভারত। অথচ ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল দলটি। শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৫ রানে হারিয়ে শিরোপা জেতে মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। তবে ভারত শিরোপা জিতলেও টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কারটি ওঠে পাকিস্তানি অলরাউন্ডার শহীদ আফ্রিদির হাতে। ব্যাটে–বলে দুর্দান্ত একটি টুর্নামেন্ট কাটিয়েছিলেন আফ্রিদি। ৭ ম্যাচ খেলে ১৯৭.৮২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৯১ রান। বল হাতে নিয়েছেন ১২ উইকেট। রানসংখ্যা কম মনে হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আফ্রিদিরি ইনিংসগুলো। দলের প্রয়োজনে তাঁর ছোট কিন্তু ঝোড়ো ইনিংস বদলে দিয়েছে ম্যাচের গতিপথ। সঙ্গে অসাধারণ বোলিং পাকিস্তানকে ফাইনালে তুলতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তিলকারত্নে দিলশান (২০০৯)
বিশ্বকাপের এই আসরেও সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন রানার্সআপ শ্রীলঙ্কার ওপেনিং ব্যাটসম্যান তিলকারত্নে দিলশান। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও মারকুটে ব্যাটিংয়ের জন্য টপ অর্ডারে নিয়ে আসা হয় দিলশানকে। ওপেনিংয়ে নেমেই বাজিমাত করেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। টুর্নামেন্টজুড়েই ব্যাটে ঝড় ছিল তাঁর। ৭ ম্যাচে ১৪৮ স্ট্রাইক রেটে করেন টুর্নামেন্ট–সর্বোচ্চ ৩১৭ রান। সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দিলশানের ৫৭ বলে ৯৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ভর করেই ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও দলকে ফাইনালে তুলতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখায় টুর্নামেন্ট–সেরা হন দিলশান।
কেভিন পিটারসেন (২০১০)
দুই বছর পরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর অনুষ্ঠিত হয় এক বছর পরেই, ২০১০ সালে। কারণ, আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সূচি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর আয়োজন করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। প্রথম দুই আসরের সেরা খেলোয়াড় রানার্সআপ দল থেকে নির্বাচিত হলেও এবার সেরা হন শিরোপাজয়ী ইংল্যান্ডের তারকা ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসেন। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৬ ম্যাচে করেন ২৪৮ রান। এর মধ্যে দুটি ফিফটি। তবে এই টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি মাহেলা জয়াবর্ধনে। কিন্তু দলকে ফাইনালে তোলা এবং শিরোপা জেতায় ভূমিকা রেখেছিলেন পিটারসেন। তাই এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের হাতেই ওঠে টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার।
শেন ওয়াটসন (২০১২)
২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ফাইনালে যেতে না পারলেও টুর্নামেন্ট–সেরা হিসেবে নির্দ্বিধায় শেন ওয়াটসনকে বেছে নিয়েছেন সবাই। না নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে টুর্নামেন্টটি নিজের করে নিয়েছিলেন ওয়াটসন। ব্যাটিংয়ে ওপেন করতে নেমে প্রতি ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিয়েছেন উড়ন্ত সূচনা। প্রথম চার ম্যাচের তিন ম্যাচেই অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন ওয়াটসন। পাশাপাশি বল হাতেও রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দলের মূল পেসার না হয়েও প্রায় প্রতি ম্যাচেই করেছেন প্রথম ওভার। ব্যাট হাতে ৬ ম্যাচে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ওয়াটসন করেন টুর্নামেন্ট–সর্বোচ্চ ২৪৯ রান। মাত্র ১৬ গড়ে তুলে নেন ১১টি উইকেট। এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পর অন্য কাউকে কি আর টুর্নামেন্ট–সেরার খেতাবটা দেওয়া যায়!
বিরাট কোহলি (২০১৪)
২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাংলাদেশ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এককভাবে আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ। তবে নিজেদের মাটিতে মোটেও সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। সব কটি ম্যাচ হেরেই বিদায় নেয় টাইগাররা। বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে এশিয়ার আরেক পরাশক্তি শ্রীলঙ্কা। টুর্নামেন্টটির সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে টুর্নামেন্ট–সেরা হন ফাইনালিস্ট ভারতের বিরাট কোহলি। পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ ব্যাটিং করেন কোহলি। ফাইনালেও শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের মন্থর উইকেটেও খেলেন ৫৮ বলে ৭৭ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। কিন্তু ভারতকে শিরোপা জেতাতে এই ইনিংসটি যথেষ্ট ছিল না। ফলে ভারত ফাইনালটি হেরে যায় ৬ উইকেটে। পুরো টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচ খেলে ৪ ফিফটিতে অবিশ্বাস্য ১০৬.৩৩ গড়ে ৩১৯ রান করে টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার অর্জন করেন বিরাট কোহলি।
বিরাট কোহলি (২০১৬)
বাংলাদেশের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরটিও বসে এশিয়ায়। এবার আয়োজক ভারত। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ হলেও এবারও শিরোপার দেখা পায়নি স্বাগতিক দেশ। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ বল বাকি থাকতে ম্যাচটি জিতে নেয় ৭ উইকেটে। শিরোপা জিততে না পারলেও টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কারটি হাতে ওঠে বিরাট কোহলির হাতে। টুর্নামেন্ট–সেরা না হওয়ার কোনো কারণও ছিল না কোহলির। ২০১৬ সাল ছিল কোহলির ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বছর, ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন এ বছর। আইপিএলে (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) ১৬ ম্যাচ খেলে ৪ সেঞ্চুরিতে কোহলি সংগ্রহ করেন ৯৭৩ রান, যা এখন পর্যন্ত আইপিএলের এক আসরে সর্বোচ্চ রান। ২০১৬ সালে কোহলি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন মোট ১৩টি, ৭ ফিফটি এবং দানবীয় ১০৬.৮৩ গড়ে সংগ্রহ করেন মোট ৬৪১ রান। এই ফর্মের শুরুই হয় বিশ্বকাপ থেকে। বিশ্বকাপে তিনি খেলেন মোট ৫ ম্যাচ। এই ৫ ম্যাচে ৩ ফিফটিতে সংগ্রহ করেন ২৭৩ রান। বিশ্বকাপে তাঁর গড় ছিল আরও বেশি, ১৩৬.৫০! এমন পারফরম্যান্সের পর ফাইনালে যেতে না পারলেও টুর্নামেন্ট–সেরার স্বীকৃতি পান বিরাট কোহলি।
ডেভিড ওয়ার্নার (২০২১)
২০২১ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল তেমন কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই। ছন্দে ছিলেন না দলের কেউই। ক্রিকেটবোদ্ধারা শেষ দেখে ফেলেছিলেন স্টার্ক, ওয়ার্নার, স্মিথ, ফিঞ্চদের মতো খেলোয়াড়দের। কিন্তু বিশ্বকাপের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়া যে বরাবরই অপ্রতিরোধ্য, সেটা তারা আবারও প্রমাণ করে দেখায়। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যে দলকে কেউ কোনো সমীকরণেই ফাইনালে দেখছিল না, সেই দলই চলে গেল ফাইনালে। শুধু তা–ই নয়, নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে একপ্রকার ছেলেখেলা করেই প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা নিজেদের ঘরে নেয় অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ডেভিড ওয়ার্নার হন টুর্নামেন্ট–সেরা। অথচ বিশ্বকাপের আগে কী বাজে সময়টাই না গিয়েছিল ওয়ার্নারের। বাজে ফর্মের জন্য প্রথমে আইপিএলের নিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের অধিনায়কত্ব হারান, এরপর বাদ পড়েন স্কোয়াড থেকেও। কিন্তু বিশ্বকাপে দেখা যায় বদলে যাওয়া এক ওয়ার্নারকে। দাপটের সঙ্গে পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটিং করে ৩ ফিফটি এবং ১৪৬.৭০ স্ট্রাইক রেটে সংগ্রহ করেন ২৮৯ রান। এই দাপুটে পারফরম্যান্সের কারণে নির্বাচকেরা ডেভিড ওয়ার্নারকে দেন টুর্নামেন্ট–সেরার স্বীকৃতি।