তারুণ্যে ভর করে যেভাবে ইউরোর শিরোপা এল স্পেনে
এত দিন রেকর্ডটা ভাগাভাগি করতে হতো জার্মানির সঙ্গে। কিন্তু এবার জার্মানিকে ছাড়িয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেল স্পেন। ইউরোর ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে চারবার ইউরোপ-সেরা হওয়ার কীর্তি গড়ল তারা। জার্মানির মাটিতে এখন এই স্মরণীয় জয়ের পেছনের মুখগুলোকে যদি ধন্যবাদ দিতে চাও, তাহলে প্রথমে তোমরা কাকে ধন্যবাদ দেবে? নিশ্চয়ই তাদের কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তেকে। কিন্তু লুইস এনরিকে কেন নয়? নাকি সাবেক এই স্প্যানিশ কোচকে ভুলে গেছ সবাই!
২০০৮ ও ২০১২ ইউরো এবং মাঝে ২০১০ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত স্পেন বিশাল ধাক্কা খেয়েছিল ব্রাজিল বিশ্বকাপে। তত দিনে সেই সোনালি সময়ের নায়কেরা বুড়িয়ে গেছেন। দলের শক্তিমত্তাও কমছে ধীরে ধীরে। সেবার গ্রুপ পর্বে ডাচ বাহিনী তো তাদের কোমরই ভেঙে দিল। এরপর দুটি ইউরো আর দুটি বিশ্বকাপ—মাঝের সময়টা একেবারে ভালো যায়নি। সমস্যা ছিল খেলোয়াড়েরও। কোচরাও পারেননি থিতু হতে। রক্ষণ থেকে মধ্যমাঠ অথবা উইঙ্গার পজিশনে যথাযথ খেলোয়াড়ের অভাব ভোগাচ্ছিল ক্রমাগত। যেখানে খেলতেন ক্যাসিয়াস, পিকে, রামোস, পুয়োল, জাভি, বুসকেতস, ইনিয়েস্তা, আর ডেভিড ভিয়ারা—সেখানে উত্তরসূরিরা যেন তাঁদের মর্যাদা ঠিক রাখতে পারছেন না।
রাশিয়া বিশ্বকাপে আরও একবার ব্যর্থতার পরবর্তী সময়ে লুইস এনরিকের আগমন। তিনি এসে দলকে আগাগোড়া পাল্টে ফেললেন। রামোসের মতো ডিফেন্ডার ও ডেভিড ডে হায়ার মতো বড় নামগুলোর জায়গা হলো না স্পেন জাতীয় দলে। রক্ষণ থেকে মধ্যমাঠ বা আক্রমণ—প্রতিটি পজিশনের ভার তুলে দিলে তরুণ খেলোয়াড়দের হাতে। যদিও সমালোচনা শুনতে হয়েছিল তাঁকে। কাতার বিশ্বকাপেও সফলতার মুখ দেখেননি। কিন্তু তরুণ খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা রাখার সেই পরিকল্পনাই আজ স্পেনকে ইউরো এনে দিল। কারণ, লুইস দে লা ফুয়েন্তেও ভরসা রেখেছেন তরুণদের ওপরই। এনরিকের গড়া একাদশ বা তাঁর কৌশল—কোনো কিছুতেই তিনি বিশেষ পরিবর্তন আনেননি। বরং এনরিকের কাজের ওপরই বুনেছেন নিজের ফুটবলের বীজ।
কাতার বিশ্বকাপে স্পেনের পারফরম্যান্স চরম সমালোচিত হওয়ার পর, এবারের ইউরোতে তাদেরকে এগিয়ে রাখলেও হয়তো সেই তালিকায় স্পেন খুব একটা ওপরের দিকে ছিল না। গ্রুপ পর্বে গ্রুপটা কঠিন। ক্রোয়েশিয়া, ইতালি আর আলবেনিয়ার সঙ্গে তাদের গ্রুপটা তো ‘গ্রুপ অব ডেথ’ই। নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার দলে নেই। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেও বুড়িয়ে গেছেন নাচো। আইমেরিক লাপোর্তে খেলেন সৌদি প্রো লিগে আর রবিন দে নরমাদও পরিচিত কোনো মুখ নন। সবচেয়ে অনভিজ্ঞ তাদের আক্রমণভাগ। ২২ বছর বয়সী নিকো উইলিয়ামসের সঙ্গে ১৬ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামাল সামলাবেন তাদের আক্রমণ! অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছাড়া আর কী! কিন্তু গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে দানি কারভাহালকে যখন দুর্দান্ত একটা ক্রস করলেন লামিনে ইয়ামাল, সেদিন অবিশ্বাসগুলো হয়তো হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। কারণ, মাঠে লামিনে ইয়ামালকে দেখে ১৬ বছর বয়সী কিশোর মনে হয় না। ধারণা করা যায় না, ২০২২ বিশ্বকাপে চরম হতাশা উপহার দেওয়া নিকো উইলিয়ামসের আত্মবিশ্বাস দেখে। তবে শুধু খেলোয়াড়দের চমক নয়, স্পেন যে নিজেদের চিরাচরিত কৌশল থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র ফুটবল খেলতে পারে, সেটাই–বা কে ভেবেছিল?
ইউরোতে অভিষেক ম্যাচে, ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে স্পেন শুরু করেছিল দুজন উইঙ্গারকে টাচলাইনে রেখে তাদের অতিপরিচিত পাসিং ফুটবল দিয়ে। কিন্তু ইতালির সঙ্গে ভোজবাজির মতো বদলে গেল সেই কৌশল। ইতালির রক্ষণ সাধারণত ম্যান মার্ক করে খেলতে অভ্যস্ত। স্পালোত্তির শিষ্যদের এই স্বভাবের কারণে স্পেন তাদের খেলার ধরন বদলে ফেলল। পজেশন ধরে রেখে প্রথাগত পাসিং ফুটবল আর হাফ-স্পেসকে ব্যবহার বাদ দিয়ে তারা চলে গেল পজেশন বেজড লং বলের কৌশলে। আর এই টোটকাই তাদের জিতিয়ে দিল সেই ম্যাচ। সেদিন স্পেন দেখল এক বুড়ো হাড়ের ভেলকি আর ক্লাবে পুরো মৌসুমে সমালোচিত হওয়া এক ফুলব্যাকের ফিনিক্স পাখির মতো নতুন জীবন ফিরে পাওয়া।
দানি কারভাহাল রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুর্দান্ত একটা মৌসুম কাটিয়েছিলেন। সেই ফর্ম টেনে আনলেন স্পেনের জার্সিতেও, অন্যজন মার্ক কুকুরেয়া। ইউরো শুরু আগে গ্যারি নেভিল বলেছিলেন, ‘কুকুরেয়ার কারণে স্পেনের ইউরোতে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না।’ কিন্তু সেই কুকুরেয়াই হলেন এই ইউরোর অন্যতম সেরা ফুলব্যাক। ফাইনালে ওইয়ারসাবালকে বাড়ানো ওই পাস আর পুরো টুর্নামেন্টে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে শুধু একটা কথাই মাথায় আসে—সিম্পলি পারফেক্ট।
স্পেন গ্রুপ পর্ব পার হলো। শেষ ১৬–তে তাদের প্রতিপক্ষ জর্জিয়া। এই ‘সিম্পলি পারফেক্ট’–এর তালিকায় যোগ হলো আরও একটি নাম। পিএসজির মিডফিল্ডার ফাবিয়ান রুইজ। ২৮ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার পুরো টুর্নামেন্টে করেছেন ২ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট। জর্জিয়ার সঙ্গে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে অনেকে বলেছিলেন, রুইজ তো নয়, তার মুখোশ পরে আসলে ইনিয়েস্তা খেলছেন।
জার্মানির ম্যাচে মাত্র আট মিনিটে চোটে পড়লেন পেদ্রি। এবারের ইউরো তাঁর শেষ হয়ে গেল সেই ম্যাচেই। বদলি হিসেবে নামলেন দানি অলমো। বেঞ্চ থেকে প্রতিটি ম্যাচে নামলেও অলমোর ইউরো তো নতুন সেদিনই শুরু হয়েছিল। ৫১ মিনিটে করলেন প্রথম গোল আর ১১৯ মিনিটে করা মিকেল মেরিনোর গোলটাও এসেছিল তাঁর বাড়ানো বল থেকে। তবে সেদিন গোলবারের নিচে উনাই সিমোন দারুণ কিছু সেভ না দিলে হয়তো মেরিনোর গোল কোনো কাজে না–ও আসতে পারত। সেমিফাইনালেও ফ্রান্সের বিপক্ষে দৃশ্যপটে আগমন দানি অলমোর। কিন্তু পাদপ্রদীপের সব আলো ২১ মিনিটেই নিজের করে নিয়েছিলেন লামিনে ইয়ামাল। সম্ভবত ফ্রান্সের বিপক্ষে করা ওই গোলটা এবারের ইউরোর সেরা গোল।
ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিকো গোল করেছেন, গোল আছে ওইয়ারসাবালেরও। পুরো টুর্নামেন্টে জাত চিনিয়েছেন রদ্রি। হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে রক্ষণ ও আক্রমণভাগকে বেঁধে রেখেছেন এক সুতায়। কিন্তু যখন চোটে পড়ে ফাইনাল ম্যাচ থেকে উঠে গেলেন, তখন তাঁর জায়গায় জুবিমেন্দি নেমে রদ্রির শূন্যস্থান বুঝতে দিলেন না। কিন্তু এই ইউরোতে স্পেনের সাফল্যের গল্পগাথা শোনাতে গেলে শুরুতেই আসবে এক বিস্ময়বালকের নাম—লামিনে ইয়ামাল।
ইউরো যখন শুরু করেছিলেন, বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। কয়েক দিন আগে তাঁর বয়স হলো ১৭ বছর। জার্মানিতে নাকি নিজের বই–খাতাও নিয়ে গিয়েছিলেন। অনুশীলন আর ম্যাচের মাঝেও তাঁকে করতে হতো স্কুলের পড়া। কিন্তু ইয়ামাল যা করেছেন, তা হয়তো বিশ্বের যেকোনো কিশোর শুধু স্বপ্নই দেখতে পারে। ৭ ম্যাচে করেছেন ১ গোল এবং ৪ অ্যাসিস্ট আর প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে নাস্তানাবুদ করার কথা তো বাদই দিলাম। ইউরো শেষে নির্বাচিত হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ ফুটবলার, সেটা তোমরা ইতিমধ্যে জেনেই গেছ। কিন্তু সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট, সর্বোচ্চ চান্স তৈরি, বিগ চান্স ক্রিয়েশন, সর্বোচ্চ ওপেন-প্লে চান্স ক্রিয়েশনেও ইয়ামাল সবার চেয়ে এগিয়ে। একজন ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় ইউরোর মতো মঞ্চে দলকে এভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারেন, ফুটবল–বিশ্ব হয়তো আগে কোনো দিন দেখেনি। আসলে দেখবে কীভাবে! এ বয়সে মেসি বা রোনালদোও তো এমন কিছু করে দেখাতে পারেননি।
তবে একক পারফরম্যান্স অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু লুইস দে লা ফুয়েন্তে এই স্পেনকে একটি পূর্ণাঙ্গ দল হিসেবে খেলাতে পেরেছেন। তারকা খেলোয়াড় থাকার পরও পর্তুগাল, ইতালি এবং বেলজিয়ামের মতো দেশ এ কাজটা করে দেখাতে পারেনি। কার্ডজনিত নিষেধাজ্ঞায় কারভাহাল ও রবিন লে নরমাদ যখন নামতে পারেননি, তখন রক্ষণের হাল ধরেছেন ড্যানিয়েল ভিভিয়ান এবং হেসুস নাভাস। বেঞ্চ থেকে নেমে এই একই দায়িত্ব পালন করেছেন মেরিনো, জুবিমেন্দি আর ফেরান তোরেস। লুইস দে লা ফুয়েন্তের দলের এটাই বড় শক্তি। প্রত্যেকে নিজেদের দায়িত্বটা জানেন, বুঝতে পারেন দলের কঠিন সময়ে কোচ তাঁদের কাছ থেকে ঠিক কী আশা করছেন। নয়তো ম্যাচের অন্তিম সময়ে গোললাইন থেকে অলমোর মতো আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের কাছ থেকে মার্ক গুয়েহির হেড ঠেকানো আর জার্মানির বিপক্ষে মেরিনোর ওই হেডে গোল করা চাট্টিখানি কথা না। আসলে নিজেদের এই বোঝাপড়াই স্পেনকে এনে দিয়েছে এবারের ইউরোপ–সেরার মুকুট।
তারুণ্যের শক্তিতে চলা স্পেনের বেশ কিছু খেলোয়াড়কে এবারের ইউরোতে দেখা যায়নি। পেদ্রি নিজেও পুরোটা সময় খেলতে পারেননি। চোটের কারণে দলে ছিলেন না গাভি, আলেহান্দ্রো বালদে এবং পিনো। অলিম্পিকে খেলবেন বলে পাউ কুবারসিকেও উহ্য রাখা হয়েছে। তবে স্পেন যদি তাদের এই তরুণ তুর্কিদের ধরে রাখতে পারে, তাহলে হয়তো জাভি–ইনিয়েস্তাদের মতো আরেকটা রঙিন প্রজন্ম তাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। ইউরোতে এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, দলের মধ্যে বোঝাপড়া তো তাঁরই। এ জন্য ইউরোপ–সেরার হওয়ার পর ইয়ামাল–নিকোদের নিয়ে লা রোহারা স্বপ্নটা আরেকবার দেখতেই পারে। এই স্বপ্নটা দেখতে ও উপভোগ করতে স্পেনের সমর্থকেরা তো আগে থেকেই অভ্যস্ত।