গত ১০ বছরে ফ্রান্স ফুটবলের উত্থানকে যদি গল্পের মতো করে লেখা হয়, তাতে মূল চরিত্রের অভাব হবে না। কিলিয়ান এমবাপ্পে, পল পগবা আসবেন, কোচ দিদিয়ের দেশমও আসবেন। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে হিরো বনে যাওয়া করিম বেনজেমা কিংবা গোল না করেই বিশ্বকাপ জেতা অলিভিয়ের জিরুর নামও আসবে। আঁতোয়ান গ্রিজমানের নামটা বরাবরের মতো পাদপ্রদীপের আলোর নিচেই থেকে যাবে।
অথচ ফ্রান্স দলে গ্রিজমান আবির্ভূত হয়েছিলেন ত্রাতা হিসেবে। জিনেদিন জিদানের বিদায়ের পর অনেকটাই কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিল ফ্রান্সের মাঝমাঠ। একজন ‘নাম্বার টেন’-এর খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিল ব্লুজরা। এক করিম বেনজেমাকে দিয়ে দুটি কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। এমন সময়ই দিদিয়ের দেশমের দলে ডাক পান ২৩ বছর বয়সী এক তরুণ। গোলমুখে যেমন অসাধারণ, তেমনই অসাধারণ লিংকআপ। মাঝমাঠ আর আক্রমণভাগের মধ্যে যে সেতুবন্ধন, সে দায়িত্ব নিশ্চিন্তে গ্রিজমানের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া যায়। তাই তো মাত্র এক ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়েই বিশ্বকাপের মঞ্চে করে নিয়েছিলেন নিজের জায়গা। বিশ্বকাপে গোল অ্যাসিস্ট না থাকলেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো।
বিশ্বকাপের পর থেকেই ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়লেন গ্রিজমান। আরও নির্দিষ্ট করে বললে গ্রিজমান ছিলেন দিদিয়ের দেশমের ট্রাম্পকার্ড। করিম বেনজেমা আর ম্যাথু ভালবুয়েনা, ফ্রান্সের দুই ফরোয়ার্ড তত দিনে নিজেরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে জাতীয় দল থেকে নির্বাসিত। ফলে ফ্রান্সের আক্রমণভাগ সামলানোর গুরুদায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। সঙ্গে দেশমের ফ্লুইড বিল্ডআপ প্লে, গ্রিজমান আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠলেন ফ্রান্স ফুটবলের ‘পাওয়ারহাউস’।
বছর দুই পর দরজার কড়া নাড়ল বিশ্বকাপ। তত দিনে গ্রিজমান বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন। তবে যতটা না তাঁর তারকাখ্যাতি, তার থেকেও বেশি খ্যাতি তাঁর উদ্যাপনে।
যার প্রমাণ মিলল ২০১৬ ইউরোতে। ঘরের মাঠে ইউরো, নিজেকে প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। পুরো টুর্নামেন্টকে যেন নিজের করে নিলেন গ্রিজমান। ৬ গোল, ২ অ্যাসিস্ট। সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ২ গোল। পগবা-গ্রিজমান জুটি যেন যে কারও জন্য এক ত্রাস। কিন্তু এত কিছুর পরও শিরোপাটা ঘরে তোলা হয়নি তাঁদের। ফ্রান্সকে স্তব্ধ করে শিরোপা নিয়ে ঘরে ফেরে পর্তুগাল। ইউরোর গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট যেন সান্ত্বনা পুরস্কার হয়েই রইল গ্রিজির জন্য। তবে পারফরম্যান্সের পুরস্কার পেয়েছিলেন বৈকি। রোনালদো, মেসির পর ব্যালন ডি’অরের পোডিয়ামে তৃতীয় স্থানটা ছিল গ্রিজমানের।
বছর দুই পর দরজার কড়া নাড়ল বিশ্বকাপ। তত দিনে গ্রিজমান বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন। তবে যতটা না তাঁর তারকাখ্যাতি, তার থেকেও বেশি খ্যাতি তাঁর উদ্যাপনে। র্যাপার ড্রেকের বিখ্যাত গান ‘হটলাইন ব্লিং’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘কল মি’ সেলিব্রেশন কিংবা ‘ফোর্টনাইট’ গেমের ‘টেক দ্য এল’ ড্যান্স; গ্রিজমানের গোল উদ্যাপন জায়গা করে নিয়েছে সবার মনে। কিন্তু তিনি যে বড় মঞ্চের বড় তারকা, বিশ্বকাপ সেখান থেকে বাদ যায় কীভাবে? গ্রিজমান ফিরলেন বিধ্বংসীরূপে।
এমবাপ্পের আগমনে অনেকটাই বদলে গিয়েছিল গ্রিজমানের ভূমিকা। নিজের পুরোনো দায়িত্ব এমবাপ্পের ওপর সঁপে দিয়ে গ্রিজমান হয়ে উঠলেন অ্যাটাক আর মিডফিল্ডের ব্রিজ। পিওর ‘নাম্বার টেন’ বলতে যেটা বোঝায় আরকি। তাই বিশ্বকাপের সব আলো এমবাপ্পে কেড়ে নিলেও পেছন থেকে পুরো কলকাঠি নেড়েছেন গ্রিজি। বিশ্বকাপ শেষে তাঁর নামের পাশে ৪ গোল আর ৪ অ্যাসিস্ট! ফাইনালে ফ্রান্সের চার গোলের তিনটিতেই ছিল তাঁর সরাসরি অবদান। গ্রিজমান যখন বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে নিয়ে চুমু খাচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, শিরোপাটা বুঝি তাঁরই। মদরিচ, হ্যাজার্ডের পেছনে থেকে পেলেন বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জ বল। আর মদরিচ, রোনালদোর পেছনে থেকে ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে হলেন তৃতীয়।
বিশ্বকাপের পর গ্রিজমানকে নিয়ে আরেক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন কোচ দেশম। পগবার চোট আর অফ ফর্ম ফ্রান্সের মাঝমাঠকে একপ্রকার খালি করে ফেলেছিল। গ্রিজমানকে দিয়ে সে জায়গাটা পূরণের চিন্তা ছিল দেশমের মাথায়।
ফ্রান্সের নীল জার্সিতে গ্রিজমানের ক্যারিয়ার যতটা সমৃদ্ধ, ক্লাব ক্যারিয়ারটা তার ততটাই ফিকে। ক্যারিয়ারের সূচনাটা ঠিক টিপিক্যাল ফ্রেঞ্চ খেলোয়াড়দের মতো নয়। ১৪ বছর বয়সে পাড়ি দিয়েছিলেন স্পেনে। সেখান থেকে স্পেনই তাঁর ঘর। রিয়াল সোসিয়েদাদের যুব দলে খেলেছেন, সেখান থেকে পাড়ি দিয়েছেন আতলেতিকো মাদ্রিদে। কোচ দিয়েগো সিমিওনের ভরসার পাত্র ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ২০১৯ সালে ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন বার্সেলোনায়। ব্লাউগ্রানা জার্সিতে ঠিক নিজেকে প্রমাণ করে উঠতে পারেননি। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টা কাটিয়েছেন বার্সাতেই। সেখান থেকে আবার ঘুরে এসে থিতু হয়েছেন আতলেতিকোতেই। জাতীয় দলে যেমন দিদিয়ের দেশম, তেমনই ক্লাবে দিয়েগো সিমিওনে। লম্বা সময় ধরে একই কোচের অধীনে খেলতে হয়েছে তাঁকে। ডিফেন্সিভ আর ডার্টি ট্যাকটিসের জন্য খ্যাত সিমিওনের অধীনে তাই নিজেকে ঠিকঠাক মেলেও ধরতে পারেননি। অন্য কোচের অধীনে গেলে হয়তো ‘টিম প্লেয়ার গ্রিজমান’-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যাটাকার গ্রিজমান’ও দ্যুতি ছড়াত। সিমিওনের কারণে সেটাও তেমন হয়নি। তবে এত কিছুর মধ্যেও ‘অ্যাটাকার গ্রিজমান’ দ্যুতি ছড়িয়েছেন। আতলেতিকো মাদ্রিদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। ফ্রান্সের জার্সিতেও চতুর্থ সর্বোচ্চ। গ্রিজমানের জ্বলে ওঠা বেশির ভাগ সময়েই থেকে গেছে প্রদীপের আলোর নিচে।
বিশ্বকাপের পর গ্রিজমানকে নিয়ে আরেক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন কোচ দেশম। পগবার চোট আর অফ ফর্ম ফ্রান্সের মাঝমাঠকে একপ্রকার খালি করে ফেলেছিল। গ্রিজমানকে দিয়ে সে জায়গাটা পূরণের চিন্তা ছিল দেশমের মাথায়। খুব যে অসফল হয়েছিলেন, তা নয়। তবে স্ট্রাইকার হিসেবে শুরু করা গ্রিজমান অজান্তেই নিজেকে আবিষ্কার করলেন মাঝমাঠের সৈনিক হিসেবে। ২০২০ ইউরো, নেশনস কাপ—পরপর দুই টুর্নামেন্টে গ্রিজমান ছিলেন ফ্রান্স মিডফিল্ডের কান্ডারি। নির্বাসন শেষে বেনজেমার ফেরত আসা আক্রমণভাগেও তার প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছিল। ২০২২ বিশ্বকাপ পুরোটাই গ্রিজমান খেলেছেন মাঝমাঠে। মাত্র তিন অ্যাসিস্ট নিয়ে শেষ করেছেন বিশ্বকাপ।
বয়সটা মাত্র ৩৩। নীল জার্সিতে পথচলার ইতি টানলেন এখনই। আস্তে আস্তে হয়তো ক্লাব ক্যারিয়ারও গুটিয়ে আনবেন। নীরবে ঘোষণা দেবেন বিদায়ের।
গ্রিজমান এ নিয়ে অভিযোগ করেননি কখনোই। দলের জন্য গ্রিজমান আজীবনই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দলের প্রয়োজনে ডিফেন্সে দাঁড়াতে হলেও তাঁর কোনো অভিযোগ ছিল না। হুগো লরিসের বিদায়ের পর অধিনায়কত্ব পাওয়ার কথা ছিল তাঁর, কিন্তু তাঁকে টপকে অধিনায়কের ব্যাজ পেয়েছেন এমবাপ্পে। দলের প্রয়োজনে খেলেছেন মাঝমাঠে। চোটের কারণে বাদ পড়ার আগে টানা ৮৪ ম্যাচ খেলেছেন গ্রিজমান। তাঁকে ছাড়া ফ্রান্সের একাদশ কল্পনা করাও যেন ভুল ছিল। আট বছর পর ফ্রান্স পুরো ম্যাচ খেলেছে গ্রিজমানকে ছাড়া। যে কোচের জন্য জীবন বাজি রাখতে রাজি, সেই কোচ যখন হারের জন্য সরাসরি তাঁকে দায়ী করেন, তখন কষ্ট তো একটু লাগেই। পুরো ইউরোতে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। শেষ ১০ ম্যাচ ধরে নেই কোনো গোল-অ্যাসিস্ট। ফ্রান্সে এখন বইছে নতুনের সুবাতাস। এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, অরেলিয়ে শুয়েমেনিরা মাঝমাঠে নিজেদের জায়গা বুঝে নিচ্ছেন। রাবিও, গুয়েন্দোইজিরা রয়েছেন লাইনে। এমন সময়ে অযথা জায়গাটা ধরে না রাখাই ভালো। তাই তো গ্রিজমান নিজের বিদায়টাও ঘোষণা করলেন আড়ালে থেকেই।
বয়সটা মাত্র ৩৩। নীল জার্সিতে পথচলার ইতি টানলেন এখনই। আস্তে আস্তে হয়তো ক্লাব ক্যারিয়ারও গুটিয়ে আনবেন। নীরবে ঘোষণা দেবেন বিদায়ের। স্মৃতির পাতা থেকে আঁতোয়ান গ্রিজমান নামটা হয়তো ফিকে হয়ে যাবে, কিন্তু কখনো সোনালি, কখনো গোলাপি, কখনো সাদা, বাহারি চুলের ‘কল মি’ কিংবা ‘টেইক দ্য এল’ উদ্যাপন স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন।