মোহাম্মদ সিরাজের করা শর্ট বল পুল করে একটা ট্রেডমার্ক উইনিং শট খেলতে চেয়েছিলেন ট্রাভিস হেড। কিন্তু হলো না, বাউন্ডারিতে থাকা শুভমান গিলের হাতে তালুবন্দী হয়ে ফিরতে হলো তাঁকে। শিরোপা থেকে মাত্র দুই রানের দূরত্বে তখন অস্ট্রেলিয়া। শেষ হয়ে হইল না শেষ! তবে তাতে আফসোস থাকার কথা না হেডের। প্রতিকূল পরিবেশেও নিজের কাজটা ঠিকমতোই করে এসেছেন।
সরাসরি খেলা না দেখে থাকলে ট্রাভিস হেডের ইনিংসের মর্মার্থ কাউকে বোঝানো কঠিন। ২৪১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে একজন ওপেনার ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ জিতিয়েছে—এটাকে আধুনিক ক্রিকেটের সহজ-স্বাভাবিক ঘটনাই ধরে নেবে তখন। কিন্তু আহমেদাবাদের লাখখানেক স্বাগতিক দর্শকের সামনে, গগনবিদারী চিৎকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে, ৪৭ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর, টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ বোলিং আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া দারুণ কঠিন এক কাজ ছিল। ট্রাভিস হেড সেখানে এত অনায়াসে ব্যাটিং করেছেন যেটা দেখে মনেই হবে না ব্যাটসম্যানরা প্রায় সারাদিন নাকানিচুবানি খেয়েছেন এই পিচে।
দুপুরবেলা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে টসে জিতে বল নিয়েছিলেন প্যাট কামিন্স। তাতে ভ্রু কুঁচকেছিলেন অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকই। কিন্তু নিজের পরিকল্পনা নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন অজি অধিনায়ক। উইকেটও বুঝেছিলেন বেশ ভালোভাবেই। কিছুটা মন্থর-ধীর গতির উইকেট, সঙ্গে স্পিনারদের জন্যে সুবিধা আছে। মোদ্দাকথা ব্যাটিংয়ের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং। এরকম উইকেটে দিবারাত্রির ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করলে বাড়তি সাহায্য পাওয়া যায়। শিশিরের কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে বল স্কিড করে সহজে ব্যাটে আসে, ফলে রান করা সহজ হয়ে যায়। অজেয় টিম ইন্ডিয়াকে একটা সুবিধাজনক স্কোরে আটকে ফেলতে পারাটাই তাই মূল লক্ষ্য ছিল অস্ট্রেলিয়ার।
পিচের এই দ্বিমুখী আচরণ আঁচ করতে পেরেছিলেন রোহিত শর্মাও। তাই প্রথম ইনিংসে বড় টার্গেট বেঁধে দেওয়াই ছিল তাঁর ইচ্ছা। গত পাঁচ ম্যাচে সেটাই করেছেন তাঁরা। পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই তিন শর রান করেছে ভারত, যেখানে এক ইনিংসে আবার ছিল চার শর বেশি স্কোর। কিন্তু এবার বিধিবাম! ফাইনাল ম্যাচে এসে টিম ইন্ডিয়া আটকে গেল মাত্র ২৪০ রানে। এর জন্যে ভারতের ব্যাটসম্যানরা যতটা না দুয়ো পাবেন, তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব পাবেন অজি বোলাররা।
বোলিং-ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত সমন্বয় দেখিয়েছে কামিন্সবাহিনী। পিচের অবস্থা বুঝে একের পর এক শর্ট বল করে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার পেসাররা। কখনো স্লোয়ার বাউন্সার, কখনো গুড লেন্থের সুইং, কখনো আবার রিভার্স সুইং— স্টার্ক, হ্যাজলউড এবং কামিন্সের বিছানো ফাঁদে একে একে পা দিয়েছেন ভারতের টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডারের সবাই। উইকেটে থিতু হয়েও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি কোহলি এবং রাহুল। মাত্র ২৪০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার অনেকখানি দায় তাই চলে যায় তাঁদের ওপর। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডারদের ক্ষীপ্র ফিল্ডিংও এখানে প্রশংসা পায়। লাবুশেন-ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েলদের রান বাঁচিয়ে দেয়ার দৃশ্য বারবার রিপ্লে করে দেখানো হয়েছে টিভিতে, ধারাভাষ্যকারেরা দিয়ে গেছেন অগুনতি বিশেষণ।
এত কিছুর পরেও কামিন্সের পরিকল্পনা ছিল ভারতকে তিন শর ভেতর আটকে ফেলা। সেখানে এত অল্প রানে আটকে ফেলতে পারায় অবাকই হয়েছেন তিনি। রোহিতও ম্যাচের পরে স্বীকার করেছেন, অন্তত ৩০-৪০ রান কম করেছেন তাঁরা। নইলে অস্ট্রেলিয়া এত নির্ভার হয়ে খেলতে পারত না।
কিন্তু আসলেও কি অস্ট্রেলিয়া নির্ভার ব্যাটিং করতে পেরেছে? ম্যাচের প্রথম বলেই বুমরাহর বলে প্রায় উইকেট দিয়ে আসছিলেন ওয়ার্নার! মাত্র এক ওভার পরে মোহাম্মদ শামির বলে ঠিকই আত্মসমর্পন করতে হলো তাঁকে। আহমেদাবাদের উইকেট তখনো ব্যাটসম্যানদের শত্রু। বুমরাহ-শামির সুইংয়ে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা একের পর এক পরাস্ত হচ্ছেন। এর ফলও আসতে শুরু করল ভারতের পক্ষে। মাত্র ৭ ওভারের মধ্যে ৩ উইকেটের পতন, বোর্ডের রান তখন ৪৭।
তবে ভারতের আশার আলো ছিল অতটুকুই। এরপর ম্যাচ যত গড়িয়েছে, সেই আলো ম্রিয়মাণ হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ৫ নম্বরে ব্যাট করতে আসা মারনাস লাবুশেন যেন দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন এক প্রান্তে! অপর প্রান্তে থাকা ট্রাভিস হেড মাঝেমধ্যে ঘুরিয়েছেন রানের চাকা। এটাই ছিল এই জুটির প্রাথমিক রণকৌশল। বোর্ডে থাকা টার্গেট যে খুব বেশি, তা নয়। উইকেটের পতন রোধ করা তাই ভালোই কাজে দিয়েছে অজিদের। বুমরাহ-শামি-জাদেজা-কুলদীপ-সিরাজ, ঘুরেফিরে ভারতের যে বোলারই বল করেছেন, সাফল্যই আনতে পারেননি কেউই। উল্টো রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন মাঠে শিশির পড়েছে, বোলাররা হারিয়েছেন কার্যকারিতা। পুরোনো বলে কমেছে সুইং, কমেছে বল স্কিড করা পিচের মন্থরতা। ঠিকমতো গ্রিপ করতে না পারায় ধার হারিয়েছে স্পিনাররা। সব পাল্লাই ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়তে থাকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে। আর টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো দলে অতিরিক্ত বোলার না থাকার অসহায়ত্বও ফুটে ওঠে রোহিত শর্মার চোখে-মুখে।
তারপরের গল্পটা কেবল ট্রাভিস হেডের। সহযোদ্ধা লাবুশেনকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি গড়েন তাঁরা। সেই জুটিতে হেডের ১০৫ বলে ১২৭ রান, আর লাবুশেনের ধৈর্যশীল ১১০ বলের ৫৮ রান মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৯২ রানের রেকর্ড। শেষ পর্যন্ত সিরাজের বলে যখন জুটি ভাঙল, শূন্যে মিলিয়ে গেছে ভারতের বিশ্বকাপ–স্বপ্ন। নিজের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতার যে কীর্তি, তারা ২০১১ সালে তৈরি করেছিল, সেই রীতির অবসান ঘটল ২০২৩-এ এসে। তাও অকল্পনীয়ভাবে। টানা ১০ ম্যাচ জিতে উড়তে থাকা অপরাজেয় এই দলকে যে টেনেহিঁচড়ে মর্ত্যে নামানো হবে, ম্যাচ শুরুর আগে পরম শত্রুও ভাবতে পারেনি সেটা।
টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ম্যাচের পর প্রায় বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া অস্ট্রেলিয়াকে টেনে তোলার পেছনে বড় অবদান ক্যাপ্টেন কামিন্সের। তাঁরই হাত ধরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পর এবার ষষ্ঠ ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্বাদ পেল তাসমান-পারের দেশটি। সেই সঙ্গে দুবার বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার অনন্য কৃতিত্বও অর্জন করলেন ওয়ার্নার, স্মিথ, মার্শ, ম্যাক্সওয়েল, কামিন্স, স্টার্ক ও হ্যাজলউড। নিজ দলের জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে স্টেডিয়ামে এসেছিলেন নীল জার্সি পরা লাখো ভারত-সমর্থক। শেষমেশ পরাজয়ের বেদনায় নীল হয়েই ঘরে ফিরতে হয়েছে তাঁদের।