শেষের শুরুটা এমন হবে স্বপ্নেও ভাবেননি ডেভিড ওয়ার্নার। শেষ টেস্ট খেলতে মেলবোর্ন থেকে সিডনির পথে পা বাড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দল। হোটেলে ফিরে লাগেজ চেক করতেই খেয়াল করলেন, খোয়া গিয়েছে ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটা। ১৩ বছর ধরে প্রতিটি উত্থান-পতনের সাক্ষী এই ক্যাপ। কী দেখেনি সেই ক্যাপ? দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘স্যান্ডপেপার’ কেলেঙ্কারিতে নাম লেখানো, অশ্রুসিক্ত নয়নে নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা ফিরে এসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৩৫ রানের ইনিংস—সবকিছুর সাক্ষী ওয়ার্নারের এই ক্যাপ। যে ক্যাপ মাথায় দিয়েই অভিষেক হয়েছিল বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানের।
ওয়ার্নারের অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে চড়ানোর গল্পটা বাকি সব অস্ট্রেলিয়ানদের থেকে বেশ আলাদা। তাঁর শুরুটা হয়েছিল কামানের গোলার মতো, একেবারে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সব রেকর্ড চুরমার করে। কোনো ফার্স্ট–ক্লাস ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই অভিষেক হয়েছিল তাঁর। অজি ইতিহাসে এমন খেলোয়াড় একমাত্র ওয়ার্নারই। শুনতে অবাক লাগছে? অস্ট্রেলিয়ার মতো কড়া ক্রিকেট বোর্ড কীভাবে অভিজ্ঞতার ঝুলিবিহীন একজনের কাঁধে জার্সি চড়িয়ে দিল?
সময়টা ২০০৯ সাল। তত দিনে গিলক্রিস্ট, হেইডেনরা গ্লাভস তুলে রেখেছেন। ওপেনার সমস্যা নিয়ে চিন্তার বলিরেখা অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকদের কপালে। পাইপলাইনে ওপেনার তো অনেকেই আছেন, কিন্তু ম্যাচের শুরুতে নেমেই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মতো ব্যাটসম্যান আছেন কজন? তখনই ধূমকেতুর মতো দৃশ্যপটে আগমন ২২ বছর বয়সী এক তরুণের। নিউ সাউথ ওয়েলসের জার্সিতে একের পর এক বিধ্বংসী ইনিংস যুক্ত হচ্ছে যাঁর নামের পাশে। এমন প্রতিভাকে দলের বাইরে রাখা অন্যায়। অন্যদিকে ফার্স্ট–ক্লাস অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া? সেটাও তো সম্ভব নয়। নির্বাচকেরা তাই একটা বাজি ধরলেন ওয়ার্নারের ওপর। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হলো ওয়ার্নারের। ৪৩ বলে ৮৯ রানের ইনিংস দিয়ে তিনি জানান দিলেন, কোনো ভুল করেননি নির্বাচকেরা। টি-টোয়েন্টির জগতে স্থায়ী হতেই এসেছেন তিনি। সেই সিরিজেই এক দিনের ক্রিকেটে অভিষেক। এরপরের গল্পটুকু শুধু সামনে এগিয়ে চলার।
ওয়ার্নার কখনোই টেক্সটবুক মেনে চলা ব্যাটসম্যান ছিলেন না। ব্যাটিং টেকনিকের ধার ধারেননি কখনো। ফরম্যাটের ধরন বুঝে খেলেছেন ঠিক সেই মেজাজেই। ২০ ওভারের ক্রিকেটে ধুন্ধুমার ব্যাট চালিয়েছেন। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাউন্ডারির পাশাপাশি স্ট্রাইক পরিবর্তন করে খেলেছেন। আবার টেস্ট ক্রিকেটে শান্ত মেজাজে উইকেট ধরে রাখতে হলে সেটাও ধরে রেখেছেন। স্ট্রাইক রেটের দিকে তাকালেই তার উত্তর পেয়ে যাওয়া সম্ভব। টেস্টে ৭০, ওয়ানডেতে ৯৭ আর টি-টোয়েন্টিতে ১৪১! ধারাবাহিকতা যেন ওয়ার্নারের সমার্থক শব্দ। শুরুটা ধূমকেতুর মতো হলেও থিতু হতে একটু সময় লেগেছিল। ২০১২ সালে আসে প্রথম সেঞ্চুরি। এর পর থেকে এক এক করে এখন ওয়ার্নার ৪৯ সেঞ্চুরির মালিক।
মাইকেল ক্লার্কের অবসরের পর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব। সহকারী হয়েই থাকতে হয়েছে তাঁকে, কখনো অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়া দলকে নিয়ে মাঠে নামার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। কিন্তু এই সহকারী হওয়াটাই ডেকে এনেছিল ওয়ার্নারের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসময়। ২০১৮ সালের মার্চের ঘটনা, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেল অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংস চলছে। ম্যাচের মধ্যে হঠাৎই দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ক্যামেরন ব্যানক্রফট কিছু একটা দিয়ে বল ঘষছেন। যেই ক্যামেরা নজরে পড়ল, তৎক্ষণাৎ সব সরিয়ে ফেললেন। বল চকচকে করার জন্য স্যান্ডপেপার দিয়ে বল ঘষছিলেন ব্যানক্রফট, যা বল টেম্পারিংয়ের শামিল। এমন ঘটনা চমকে দেয় পুরো পৃথিবীকে। ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ও ক্যামেরন ব্যানক্রফটকে। এক বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন ওয়ার্নার। দুঃসময় নেমে আসে ওয়ার্নারের ক্যারিয়ারে। সবটা তো ঠিকঠাকই চলছিল, হঠাৎ কেন এভাবে দুঃসংবাদ নেমে এল তাঁদের জীবনে?
পুরো একটা বছর দুয়ো শুনতে হয়েছে তাঁকে। না পেরেছেন কোথাও খেলতে যেতে, না পেরেছেন নিজের মতো সময়টা উপভোগ করতে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেছেন ফিরে আসার, প্রস্তুতি নিয়েছেন বিশ্বকাপ খেলার। এমন সময় আশার বাণী হয়ে এল বিপিএল, ফিরে আসার সুযোগটাকে দারুণভাবে কাজে লাগালেন তিনি। সবাইকে জানান দিলেন, ক্রিকেট থেকে দূরে গেলেও ক্রিকেটটাকে তিনি এখনো ছাড়েননি। ফর্মে থাকার মূল্য পেলেন মাস কয়েক পরেই। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের জন্য দলে ডাক পেলেন ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়া যে ভুল ওপেনারের ওপর ভরসা করেনি, তার প্রমাণ ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ। তিনটি শতক, দুটি অর্ধশতকে ৬৪৭ রান তুললেন নিজের ঝুলিতে। মাত্র ১ রানের জন্য মিস করলেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান স্কোরারের পুরস্কার। ওয়ার্নার বুঝেছিলেন, শীর্ষে ওঠার গল্প যতটা না সুন্দর, ফিরে আসার গল্পটা আরও বেশি সুন্দর। ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা তাই ওয়ার্নার কাটিয়েছেন মুগ্ধ হয়ে, দর্শকদের মুগ্ধ করে।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ওয়ার্নারের শেষ লিখে ফেলেছিলেন অনেকেই। বাদ পড়েছিলেন আইপিএলের দল থেকে। কিন্তু বিশ্বকাপে ঠিকই জ্বলে উঠলেন ওয়ার্নার। ফিরে এলেন নিজের চিরাচরিত ফর্মে। ৭ ইনিংসে ২৮৯ রান, সর্বোচ্চ স্কোরার বাবর আজমের থেকে মাত্র ৯ রান কম। তাতে কী? ফাইনালের ৩৮ বলে ৫৩ রানের ইনিংসটাই তো ভিত গড়ে দিয়েছিল প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের। প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কারটাও তাই উঠেছিল তাঁর নামের পাশেই। ওয়ার্নার সেখানেই থামার পাত্র নন, ২০২৩ বিশ্বকাপ নতুন পালক যুক্ত করল ওয়ার্নারের নামের পাশে। ১১ ম্যাচে দুটি শতক, দুটি অর্ধশতকে করলেন ৫৩৫ রান। সর্বোচ্চ রানশিকারিদের তালিকায় নাম যুক্ত হয়নি তো কী হয়েছে? দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপাটা নিজের করে নিয়েছেন তিনি।
ওয়ার্নারের ক্যারিয়ারকে রোলার কোস্টার রাইড বললেও ভুল হবে না। সফলতার শীর্ষে যেমন চড়েছেন, তেমনই দুয়োধ্বনি শুনেছেন নিজের সমর্থকদের কাছেই। পুরো দুনিয়াকে যেমন হাসিয়েছেন নাচে, গানে ও ব্যাটিংয়ে, তেমনই হতাশ করেছেন স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারির সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে। কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ওয়ার্নারের ক্যারিয়ারের শেষটা হয়ে থাকবে অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট দিয়েই সাদা জার্সির ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন, ঘোষণা দিয়েছিলেন অনেক আগেই। নতুন বছরের প্রথম দিন ঘোষণা দিলেন, এক দিনের ক্রিকেটটাকেও না বলে দিচ্ছেন তিনি। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ হাতে ছবিটাই শেষ স্মৃতি হয়ে থাক। স্মৃতি সেঁটে রাখার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করতে পারেন তিনি।
শেষের শুরুটা বেদনাসিক্ত হলেও শেষটা হয়েছে দারুণ। পুরো সিরিজজুড়ে ওয়ার্নার ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। শতক, অর্ধশতকে করেছেন ৩০৩ রান। শেষ ইনিংসটাও স্মরণীয় করে রেখেছেন ৫৭ রানের এক ইনিংস দিয়ে। ম্যাচটা শেষ করেই আসতে পারতেন। সাজিদ খানের বলটা যখন পায়ে আঘাত হানল, তখন আম্পায়ারও নাকচ করে দিয়েছিলেন। অধিনায়ক শান মাসুদ হাসতে হাসতে রিভিউ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বল আঘাত হানে স্টাম্পে। সিদ্ধান্ত বদলে আম্পায়ার জানান, বিদায়ের সময় হয়েছে তাঁর। হেলমেট খুলে ব্যাট শূন্যে তুলে সাদা জার্সিকে শেষবারের মতো বিদায় জানালেন ওয়ার্নার। পার্থের মাঠে ‘বিদায় ডেভি’ লেখাটার সঙ্গে ডেভিড ওয়ার্নারের দুই হাত শূন্যে তুলে বিদায় জানানোর ছবিটা মানুষের মনে লেপটে থাকবে বহুদিন।
টেস্ট ও ওয়ানডে ছাড়লেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আপাতত ছাড়ছেন না। ২০২৪ বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার সুপ্ত বাসনাটা এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে। যে টি-টোয়েন্টি দিয়ে শুরু, সেই টি-টোয়েন্টি দিয়েই ইতি টানার ইচ্ছা তাঁর। কে জানে, বড় টুর্নামেন্টের খেলোয়াড় হয়তো চমক জমিয়ে রেখেছেন বিশ্বকাপের জন্যই।