ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুর্দান্ত খেলা জাকের আলীর ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প
২০১৬ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসেছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও বেশ কয়েক বছর ধরে ভালো খেলছিল। স্বাভাবিকভাবেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা—এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশ বেশ ভালো ফল করবে।
সেই স্বপ্নের পালে হওয়া দেয় গ্রুপ পর্বের পারফরম্যান্স। গ্রুপ পর্বে স্কটল্যান্ড, নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ দল। কোয়ার্টার ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। সে সময় এই দলের সাইড বেঞ্চে বসে একটি ছেলে ভাবছিলেন, কোনোভাবে যদি বাংলাদেশের জয়ে যদি আমিও অবদান রাখতে পারতাম! ছেলেটার আশা পূরণ হয় না, কারণ দলের অন্যরা তখন বেশ ভালো পারফর্ম করছে।
২০১৬ সালেই প্রথম বিভাগে নাম লেখালেও নিজেকে খুঁজে পেতে একটা দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে জাকের আলীকে। তাঁরই দলের অন্যরা যখন জাতীয় দলে আলো ছড়াচ্ছেন, তখন প্রথম বিভাগ আর লিস্ট–এ ক্রিকেটে ব্যাট করছেন জাকের। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তখন তাঁর দল প্রাইম দোলেশ্বর।
সেবার সেমিফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছেলেরা। সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বদলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল বাংলাদেশ, কারণ বিশ্বকাপের আগে তিন ম্যাচের এক সিরিজ খেলতে শিমরন হেটমায়ারের নেতৃত্বে বাংলাদেশে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব–১৯ দল। সেই সিরিজে তিনটি ম্যাচেই শোচনীয়ভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করেছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে হারিয়ে পুরো দেশকে হতাশায় ডুবিয়ে ফাইনালে চলে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচ উইনিং ইনিংসের পর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিশোর শামার কামাল স্প্রিংগারের নাচে কষ্ট আরও বাড়ে সমর্থকদের। খুব আঘাত পান বাংলাদেশের সাইড বেঞ্চে বসে থাকা সেই ছেলেটাও।
সেবার বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে তৃতীয় হয়। স্থান নির্ধারণী এই ম্যাচে সেই ছেলেটির সুযোগ হয় উইকেট কিপিং করার। পরে ব্যাট হাতে দলের জয়ে অবদানও রাখেন তিনি। আসিথা ফার্নান্দো, লাহিরু কুমারা, ওয়ানান্দু হাসারাঙ্গাদের বিপক্ষে করেন ৪৫ বলে অপারজিত ৩১ রান। শুধু তা–ই নয়, উইনিং স্কোর করে ছেলেটি যেভাবে নেচেছিলেন, ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান বলেছিলেন, গত ম্যাচের পরাজয়ের বেদনা আজকে সে ফিরিয়ে দিল। সেই ছেলেটাই জাকের আলী অনীক।
২০১৬ বিশ্বকাপে সেটাই অনীকের প্রথম ও শেষ ম্যাচ। আর সেটাই তাঁর একমাত্র যুব বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপের দল থেকে জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সে দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ, দলের তারকা ব্যাটার নাজমুল হোসেন শান্ত, বোলার সাইফুদ্দিন, ব্যাটার জাকির হাসান ও সাইফ হাসান। কিন্তু সেই দলের জাকের আলী অনীকের নামটিই প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল।
২০১৬ সালেই প্রথম বিভাগে নাম লেখালেও নিজেকে খুঁজে পেতে একটা দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে জাকের আলীকে। তাঁরই দলের অন্যরা যখন জাতীয় দলে আলো ছড়াচ্ছেন, তখন প্রথম বিভাগ আর লিস্ট–এ ক্রিকেটে ব্যাট করছেন জাকের। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তখন তাঁর দল প্রাইম দোলেশ্বর।
২০১৮ সালে বিপিএলে দল খুঁজে পেলেন আনীক। নিজ বিভাগের দল সিলেট সিক্সার। ছয় মারা শুরুর সেখান থেকেই। ক্রমেই শাণিত করতে থাকা জাকেরের বিস্ফোরক ব্যাটিং আমরা দেখি ২০২৩ সালে। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ বা বিসিএলে।
ঘরোয়া ক্রিকেটের এই লিগে ৯৮.০৪ গড়ে ৪৯২ রান করেন জাকের। সেবার চার ম্যাচের ৬ ইনিংসে তিনটি সেঞ্চুরি ও একটি হাফ সেঞ্চুরিতে এই রান করেন তিনি। এরপর বিপিএলেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। ধারাবাহিকতার পুরস্কার পেয়েছেন জাকের। নির্বাচকেরা জাতীয় দলে তাঁকে না ডেকে পারেননি।
৪ অক্টোবর ২০২৩ সালে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি দিয়ে শুরু যাত্রা। ২১ অক্টোবর ২০২৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে অভিষেক হয় তাঁর। এরপর ৯ নভেম্বর ২০২৪–এ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়ানডে অভিষেক জাকের আলীর।
আর এবার ২০২৪–এর নভেম্বর-ডিসেম্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিরিজে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির সব ফরম্যাটে নিজেকে একজন অপরিহার্য ব্যাটার হিসেবে প্রমাণিত করেছেন অনীক।
ঘরোয়া লিগে জাকের আলী সিলেট বিভাগের হয়ে খেলেন। তাঁর জন্ম সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায়। জাকের আলীর বাবা শওকত আলী ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন সদস্য।
বড় ভাই শাকের আলী অপু ক্রিকেট খেলেন। বড় ভাইকে দেখে জাকের আলীরও ইচ্ছা হয় ভাইয়ের মতো ক্রিকেটার হবেন। বড় ভাই স্ট্যাম্পের পেছনে দাঁড়ান। বড় ভাই অপুর মতো জাকেরেরও ইচ্ছা স্ট্যাম্পের পেছনে দাঁড়াবেন। অনেক ভেবে এই ইচ্ছাটা ভাইকে জানাতেই ভাই রাজি।
২০১০ সালে জাকের যখন বলকে সহজে সীমানা ছাড়া করা শুরু করেছেন, তখন পরিবারের অনুপ্রেরণায় ও বড় ভাইয়ের হাত ধরে বিকেএসপিতে এসে হাজির জাকের। ব্যাটিংয়ে আলো ছড়াবেন বলে বিকেএসপির ছাত্র হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৫, অনূর্ধ্ব–১৭ , অনূর্ধ্ব–১৯ জাতীয় দলে ডাক পান। এরপর মাঝখানে একটা বিরতি দিয়ে আবার জাতীয় দলের অংশ জাকের।
উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান জাকের আলীর প্রিয় ক্রিকেটার স্বদেশে মুশফিকুর রহিম, আর বিদেশে অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ব্র্যাড হাডিন।
এ বছর বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সব ফরম্যাটেই ব্যাট হাতে আগুন ঝরিয়েছেন জাকের। আশা করা যায়, এবার আর কোনো বিরতি নয়, বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন দীর্ঘ এক সময়।