মেসি এখন কোথায় যাবেন?

২০ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ার লিওনেল মেসির। খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবল মাঠে যত রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব, সবটাই পেয়েছেন তিনি। হাতছোঁয়া দূরত্বে বিশ্বকাপ শিরোপা রেখে যেমন ফিরেছেন, কোটি দর্শকের সামনে একইভাবে চুমুও খেয়েছেন বিশ্বকাপ শিরোপায়। সাতটি ব্যালন ডি’অর নিয়ে যেভাবে দর্শকদের উদ্দেশে তুলে ধরেছেন, তেমনই এক ম্যাচে আট গোল হজম করার লজ্জাজনক ইতিহাসও আছে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও লিওনেল মেসির জীবনে একটা অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি—নিজ সমর্থকদের কাছ থেকে দুয়োধ্বনি শোনার। পিএসজি সমর্থকদের কাছ থেকে সেটাও পেতে হলো তাঁকে।

করোনা–পরবর্তী ফুটবলে সবচেয়ে বড় চমক ছিল লিওনেল মেসির পিএসজি যাত্রা। ঋণের দেনায় ডুবতে থাকা বার্সেলোনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না নিজেদের সন্তানকে আগলে রাখার। নিজেদের একপ্রকার বাঁচিয়ে রাখতেই মেসিকে ছেড়ে দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় বার্সাকে। মেসিও বার্সা থেকে দূরে সরে এসে যোগ দেন ফ্রেঞ্চ ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে। শুরু হয় লিওনেল মেসির পিএসজি–অধ্যায়। মধুর সম্পর্কের শুরুটা এত দ্রুতই যে তিক্ত হয়ে উঠবে, তা হয়তো ভাবনাতেও ছিল না কারও।

লিওনেল মেসি ছিলেন পিএসজির নতুন স্বপ্নদ্রষ্টা। ফ্রেঞ্চ লিগ নিয়ে মাথা ঘামানো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে তারা। তাদের লক্ষ্য ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানজনক শিরোপাটা নিজেদের ক্যাবিনেটে ভেড়ানোর। লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে এবার মেসি এসেছেন, নেইমার-এমবাপ্পে তো আছেনই। সবাই মিলে শুভসূচনা করবেন পিএসজির ইউরোপ–শাসনের। ভক্তদেরও সে আশাই দেখিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু সব আশা পূরণ হয় না, সব গল্পে রূপকথার মতো সমাপ্তি পাওয়া যায় না।

মেসি পারেননি, নেইমার-এমবাপ্পে-রামোসদের নিয়েও ইউরোপ–শাসন দূরে থাক, চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টারেই পা রাখতে পারেনি পিএসজি। পিএসজি সমর্থকদের বোনা স্বপ্ন তৈরি হওয়ার আগেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কিন্তু মুদ্রার ঠিক উল্টো পাশে লিওনেল মেসি ঠিকই তাঁর স্বপ্নযাত্রা সম্পন্ন করেছিলেন। আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়েছেন, উঁচিয়ে ধরেছেন বিশ্বকাপ শিরোপা। আর সেটাও ফ্রান্সকে হারিয়ে।

মেসির বিশ্বকাপ জয় দোটানায় ফেলে দিয়েছিল পিএসজি সমর্থকদের। নিজেদের খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপ জয় উদ্‌যাপন করবেন, নাকি আরেকটি বিশ্বকাপ হাতছাড়া হওয়ার জন্য দোষারোপ করবেন? মেসির ওপর রাগ ধরে রাখেননি পিএসজি সমর্থকেরা। দুই হাত বাড়িয়ে তাঁকে গ্রহণ করেছেন, আশা ছিল বিশ্বকাপের মতো ইউরোপ জয়ের স্বপ্নও পূরণ করবেন তিনি। কিন্তু বায়ার্নের কাছে হেরে, সেই স্বপ্নেও গুড়ে বালি। পত্রিকায় খবর বের হলো, চুক্তি শেষেই বিদায় নিচ্ছেন মেসি। তখন পর্যন্ত সবটাই ঠিক ছিল। ঝামেলাটা বাধল যখন মৌসুমের মাঝপথে কাউকে না জানিয়ে সৌদি আরবে রওনা দিলেন মেসি।

সৌদি সরকারের পর্যটনবিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন শুট করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে যান মেসি। ক্লাবকে জানানো না–জানানো নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। ক্লাবের অভিযোগ, তাদের না জানিয়েই সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন মেসি। সেটাও আবার দল হারার পরদিনই। একে তো সাফল্য নেই, তার ওপর ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বজয়। আবার ক্লাবের খেলাতেও মনোযোগ নেই। সব মিলিয়ে পিএসজি সমর্থকেরা জ্বলে উঠলেন তেলে–বেগুনে। কাটা গেল বেতন, হলেন নিষিদ্ধ। ক্ষমা চেয়ে যখন ফিরলেন প্যারিসে, তখন মাঠ থেকে শুরু করে রাস্তা, সবটা জুড়ে শুরু মেসির নামে দুয়োধ্বনি। মেসি পায়ে বল পেলে আগে যেখানে জ্বলে উঠতেন সমর্থকেরা, সেখানে মেসির পায়ে বল গেলেই তেলে-বেগুনে চটে উঠছেন সমর্থকেরা। মেসির পিএসজিতে থাকার যে বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটাও বোধ হয় শেষ হয়ে যায় সেদিনই।

লিওনেল মেসি শুধু অপেক্ষায় আছেন তাঁর চুক্তি শেষ হওয়ার। আগামী জুন মাসেই শেষ হতে চলেছে পিএসজির সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি, এরপর চাইলে যেকোনো দলে যোগ দিতে পারবেন তিনি। চাইলে এখনই যেকোনো দলের সঙ্গে প্রি-কন্ট্রাক্ট সাইন করে রাখার সুযোগও আছে। কিন্তু দ্বিতীয় দলবদলের সিদ্ধান্তটা মেসি একটু ভেবেচিন্তেই নেবেন বলে মনে হয়। কারণটা খুব সাধারণ।

আগামী জুনে মেসি পা রাখতে চলেছেন ৩৬-এ। তাঁর খেলায় বয়সের ছাপ পড়েনি বটে, কিন্তু ফুটবল মাঠে বয়স অনেক বড় একটা ব্যাপার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই দলবদলই হতে চলেছে তার শেষ দলবদল। বড় কোনো চুক্তি পাওয়ার আশা, টাকাপয়সার চিন্তা মেসির কোনো দিনও ছিল না, অভাবও হয়নি। বার্সেলোনা থেকে পিএসজি, ফুটবলারদের বেতনের তালিকায় তিনি সব সময়ই ছিলেন শীর্ষে। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে সে চিন্তা করতেও হবে না। তাঁকে নেওয়ার জন্য খরচ করার মতো দলের অভাব এখনো নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মেসি বেছে নেবেন কোনটা?

বার্সেলোনা

দুই বছর আগে যখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বার্সা ছাড়ার কথা বলেছিলেন মেসি, তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো একদিন এই ক্যাম্প ন্যুতে ফিরবেন তিনি। ফুটবলপ্রেমীরাও চান বার্সার জার্সিতে মেসিকে দেখতে। মেসিও বার্সায় ফিরতে চান, বার্সেলোনাও তাঁকে নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু মিয়া-বিবি রাজি থাকলেও বাদ সাধছে কাজি। লা লিগার নিয়ম অনুযায়ী মেসিকে দলে ভেড়াতে হলে হয় অনেক কম বেতনে আসতে হবে, নইলে বার্সেলোনার কিছু খেলোয়াড়কে বিদায় বলতে হবে। গত দুই বছরে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি বার্সা। লিগ জিতলেও বিশাল বেতন দিয়ে মেসিকে দলে ভেড়ানোর অবস্থা তৈরি হয়নি তাদের। ফিরতে হলে অর্থনৈতিক অবস্থাটা বুঝেই ফিরতে হবে লিওনেল মেসিকে। চাইলেই বড় অঙ্কের টাকা দাবি করতে পারবেন না বার্সেলোনার কাছ থেকে। বার্সেলোনায় ফিরলে গত দুই বছর ধরে ঘর থেকে দূরে থাকার যে কষ্ট ভুগেছেন মেসি, তার অনেকটাই লাঘব হবে।

আল হিলাল

মেসির কাছে থাকা সবচেয়ে লোভনীয় অফারটি এসেছে সৌদি থেকে। পিএসজির খেলা ফেলে বিজ্ঞাপন করতে যখন সৌদি গিয়েছিলেন মেসি, তখনই এই প্রস্তাব সামনে আনেন আল হিলাল সভাপতি। গত জানুয়ারিতে, সৌদি দল আল নাসরে যোগ দিয়েছেন রোনালদো। সেদিন থেকেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, সব জায়গাতেই একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের। আল হিলাল চাচ্ছে এই মনোপলি ভাঙতে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে। তাই তো রোনালদোর বিপরীতে তারা দাঁড় করাতে চায় মেসিকে। তাঁকে দলে আনার জন্য প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব তৈরি করে রেখেছে তারা। অপেক্ষা শুধু চুক্তি স্বাক্ষরের।

সৌদির লক্ষ্যটা অবশ্য মেসি–রোনালদোর থেকে অনেক বড়। বিশ্বকাপের ১০০তম বছর নিজেদের মাটিতে উদ্‌যাপন করতে চায় সৌদি আরব। তাদের লক্ষ্য ২০৩০ বিশ্বকাপ আবারও মধ্যপ্রাচ্যে ফিরিয়ে আনার। কাতার যেমন নেইমারকে কেন্দ্র করে নিজেদের বিশ্বকাপ সাজিয়েছিল, সৌদিও চাইছে সেভাবেই বিশ্বের কাছে বিশ্বকাপের গল্প পৌঁছে দিতে, মেসি-রোনালদোকে সঙ্গে নিয়ে।

ইন্টার মায়ামি

তবে লিওনেল মেসি যদি টাকা আর অখণ্ড অবসর একসঙ্গে উপভোগ করতে চান, তবে তাঁর জন্য সেরা বিকল্প আমেরিকার মেজর সকার লিগ। ফুটবল আর অবকাশের মিশ্রণে তৈরি লিগ শেষ বয়সী ফুটবলারদের জন্য একপ্রকার স্বর্গের মতো। একদিকে অফুরন্ত টাকা, অন্যদিকে হলিউডের লোকজনের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা। আর সেই সঙ্গে ফুটবল তো আছেই। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় এসে তাই অনেকেই নিজের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন আমেরিকাকে। লিওনেল মেসিকে পাওয়ার জন্য অবশ্য ওত পেতে বসে আছেন ডেভিড বেকহ্যামের দল ইন্টার মায়ামি। তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছা মেসি-রোনালদোকে এক দলে খেলাবেন। মাস ছয়েক আগে রোনালদোকে একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রোনালদো সে সময় গ্রহণ করেছিলেন সৌদির প্রস্তাবটা। সে সময় প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিলেও, মেসির আগমনে সে মত বদলাতে পারে যেকোনো সময়। কে জানে শেষ বেলায় মেসি-রোনালদোকে এক দলে দেখার ইচ্ছা পূরণ করে দেন কিনা ডেভিড বেকহ্যাম।

নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ

মেসির প্রথম ক্লাব। যে ক্লাবের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল মেসির ফুটবল ক্যারিয়ার। অনেক দিন আগেই বলেছিলেন ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চাইলে তিনি ফেরত যাবেন আর্জেন্টিনা। নিজের প্রথম ক্লাব নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ ক্লাবে। মেসি এখনই তাঁর অবসরের কথা ভাবছেন না। কিন্তু যদি ভেবে থাকেন, তবে আর্জেন্টিনায় হতে যাচ্ছে তাঁর গন্তব্য।

লিওনেল মেসি কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা এখনো অজানা। নতুন কোনো দলে যাবেন নাকি পিএসজির সঙ্গে আবার নতুন করে চুক্তি করবেন, তা বলা মুশকিল। তবে এটুকু নিশ্চিত, লিওনেল মেসি যত দিন না পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন, তত দিন পর্যন্ত পত্রপত্রিকার খেলার পাতাটা বরাদ্দ থাকবে তাঁর জন্যই।