ফুটবল উৎসব, ফুটবলের উৎসব
ইউরোপিয়ান ফুটবলের মৌসুম শেষ। ইংলিশ লিগে সিটির আধিপত্য, সিরি ‘আ’তে ইন্টারের শিরোপা পুনরুদ্ধারের চেয়েও বড় চমক ছিল এই মৌসুমে বায়ার লেভারকুসেন। কিন্তু ক্লাব ফুটবলের উন্মাদনা উপভোগ করতে পারেন শুধু ক্লাবের ভক্তরাই। লিগ শেষে খেলোয়াড়দের আবার নেমে পড়তে হবে নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। কেউ কেউ নামবেন ইউরোপের গতিময় ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করতে, আবার আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাশে মেসি, দি মারিয়া, ভিনিসিয়ুসরা নেমে পড়বেন লাতিন ছন্দে মাতাতে।
একসময় আমেরিকা মহাদেশে ছিল ইউরোপিয়ানদের রাজত্ব। ফ্রান্স, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস বিভিন্ন সময় আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশ শাসন করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি দাপট ছিল স্প্যানিশদের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ সীমানা পর্যন্ত বিশাল এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল তারা। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বাংশ এবং ব্রাজিল বাদে প্রায় পুরো আমেরিকা মহাদেশই ছিল তাদের অধীনে। স্প্যানিশ শাসনের বিরুদ্ধে একসময় কেঁপে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকা। আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে ও ব্রাজিলের কিছু অংশে। সূচনা হয় আর্জেন্টিনার স্বাধীনতাযুদ্ধের।
ফুটবলের আলাপ করতে এসে এসব নিয়ে লিখছি কেন? আছে আছে! ঠিক ১০০ বছর পর মে বিপ্লব নামে পরিচিত সেই বিপ্লবকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯১০ সালে আয়োজন করা হয় এক ফুটবল টুর্নামেন্টের। স্বাগতিক আর্জেন্টিনার সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হয় উরুগুয়ে আর চিলিকে। এর আগে মূলত আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ে মিলে ফ্রেন্ডলি ম্যাচের আদলে কিছু টুর্নামেন্ট খেলত। ১৯১০–এর সেই টুর্নামেন্ট থেকেই দুইয়ের বেশি দেশ মিলে টুর্নামেন্ট আয়োজনের ধারণা মাথায় আসে আয়োজকদের। ১৯১৬ সালে আর্জেন্টিনার স্বাধীনতাযুদ্ধের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, চিলিকে নিয়ে আয়োজন করা হয় এক টুর্নামেন্টের, জন্ম হয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকার।
কোপা আমেরিকা শুরুর কৃতিত্ব আর্জেন্টিনার হলেও প্রথম কোপা জয়ের স্বাদ পেতে আর্জেন্টিনার খেলতে হয়েছিল পাঁচটি টুর্নামেন্ট। তার আগে তিনবার ফাইনালে ওঠে তারা। তিনবারই হারে উরুগুয়ের কাছে। সে সময় উরুগুয়ে বাধা পেরোতে সমর্থ হয় শুধু ব্রাজিল। ১৯১৯ সালে আয়োজিত তৃতীয় কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে দুই দলের পয়েন্ট সমান থাকার পরে প্লে-অফে উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারায় তারা। সেই প্লে-অফ আবার কোপার ইতিহাসেরই দীর্ঘতম ম্যাচ। তখন পেনাল্টি শুটআউটের অস্তিত্ব ছিল না। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে খেলা গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়েও খেলা গোলশূন্য। বাধ্য হয়ে আরও ৩০ মিনিট সময় বাড়ান রেফারি। ১২২ মিনিটের গোলে জয় পায় ব্রাজিল।
কোপা আমেরিকার কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট ছিল না কখনোই। কখনো রাউন্ড রবিন, কখনো হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েভিত্তিক আবার কখনোবা গ্রুপ এবং নকআউট—এভাবেই চলেছে কোপা। রাউন্ড রবিন টুর্নামেন্টগুলোতে পয়েন্ট সমান হলে হতো প্লে-অফ ফাইনাল। এমনই এক প্লে-অফে ১৯৪৯ সালে প্যারাগুয়েকে ৭-০ গোলে হারায় ব্রাজিল। কোপার ফাইনালে এখনো সেটা সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ড। ১৯৯৩ সাল থেকে অবশ্য প্রতি টুর্নামেন্টই গ্রুপ পর্বের পর নকআউট এই ফরম্যাটেই হয়েছে।
আর্জেন্টিনাকে ৩-২ আর ব্রাজিলকে উত্তেজনাকর এক ম্যাচে ৫-৪ গোলে হারানোর পর শেষ হাসি হাসে সেই বলিভিয়ানরাই। ১৯৮৩ সালে সক্রেটিসের ব্রাজিল হারে উরুগুয়ের কাছে। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা কলম্বিয়ার কাছে হেরে হয় চতুর্থ। ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালে আর্জেন্টিনা পরপর কোপা জিতলেও ম্যারাডোনা ছিলেন না সেই দলের অংশ।
ব্রাজিলের দ্বিতীয় কোপা জয় ১৯২২ সালে। তৃতীয়টি জয় করতে লেগে যায় ২৭ বছর। আর চতুর্থ কোপা জিততে অপেক্ষা ছিল ৪০ বছরের। ১৯৮৯ সালে ব্রাজিল যখন তাদের চতুর্থ শিরোপা জিতে তত দিনে আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ে দুই দলেরই কোপার শিরোপাসংখ্যা ডজন ছুঁয়েছে। পেলেসহ ব্রাজিলের সোনালি প্রজন্মের কখনো পাওয়া হয়নি কোপা জয়ের স্বাদ।
১৯৩০ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে উরুগুয়ে। কোপা আমেরিকার শুরু থেকেই দুই দলের পথচলা ছিল একসঙ্গে। দুই দেশের ফুটবল ফেডারেশনের মধ্যে ছিল আলাদা এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু এই ফাইনালকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে দেশ দুটির মধ্যে। তাই কোপা আমেরিকাতে পড়েছিল ছয় বছরের বিরতি। ১৯২৯ সালের পর কোপা আমেরিকার আসর বসে তাই ১৯৩৫-এ। তবে সেবারও প্রতিশোধ নিতে পারেনি আর্জেন্টিনা, দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে ৩-০ গোলে পরাজিত হয় তারা, শিরোপা জেতে উরুগুয়ে। কোপা আমেরিকায় সেটাই যে একমাত্র বিতর্ক এমনটা নয়। ২০০১ সালেই যেমন বিভিন্ন মাফিয়া গ্রুপের হুমকিতে টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে আর্জেন্টিনা, ম্যাচ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে উড়িয়ে আনা হয়েছিল হন্ডুরাসকে। কোপা আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বত্ব বিক্রির জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সাবেক ফিফা ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউজেনিওর বিরুদ্ধে। তবে যত বিতর্কই হোক না কেন, কোপার জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি একটুও, নইলে কি আর ১৯৮৭ সালে ১ দশমিক ৭ মিলিয়নে বিক্রি হওয়া কমার্শিয়াল রাইট ২০১৬ সালে এসে ১১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন হয়ে যায়?
১৯৩৯ সালে এসে উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের বাইরে কোপা জেতে পেরু। তবে কোপার ইতিহাসে বড় এক চমক ১৯৬৩ সালে বলিভিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এর আগে যতবার এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল বলিভিয়া, অধিকাংশ সময়ই তাদের স্থান ছিল পয়েন্ট টেবিলের একদম নিচে। ইকুয়েডর কোপা আমেরিকায় নিয়মিত হওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যে ইকুয়েডর দখল করত সে জায়গা। ১৯৬৩ সালে নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত কোপার উদ্বোধনী ম্যাচে ইকুয়েডরের সঙ্গে ৪-৪ গোলে ড্র করার পর সে রকমই এক অবস্থানের আশা হয়তো করছিল বলিভিয়ানরা। কিন্তু আর্জেন্টিনাকে ৩-২ আর ব্রাজিলকে উত্তেজনাকর এক ম্যাচে ৫-৪ গোলে হারানোর পর শেষ হাসি হাসে সেই বলিভিয়ানরাই। ১৯৮৩ সালে সক্রেটিসের ব্রাজিল হারে উরুগুয়ের কাছে। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা কলম্বিয়ার কাছে হেরে হয় চতুর্থ। ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালে আর্জেন্টিনা পরপর কোপা জিতলেও ম্যারাডোনা ছিলেন না সেই দলের অংশ। পেলের মতো তাঁরও তাই কখনো কোপা জেতা হয়নি। তারপরের গল্পটা ব্রাজিলের। পরের পাঁচবারের মধ্যে চারবার কোপা জেতে ব্রাজিল। ২০১১ সালে ফোরলান-কাভানিরা কোপা জেতান উরুগুয়েকে। তারপর পরপর দুবার চিলির কাছে আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গের পর ব্রাজিলের হাত ঘুরে ২৮ বছর পর শিরোপা আর্জেন্টিনার।
এবার নজর দেওয়া যাক কোপা আমেরিকার কিছু রেকর্ডের দিকে। সর্বমোট ৪৭ বার অনুষ্ঠিত কোপায় সব টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেনি কোনো দলই। সর্বোচ্চ ৪৫ বার কোপায় অংশ নেওয়া দল উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা অংশ নিয়েছে ৪৩ বার। ব্রাজিলের (৩৭) চেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেছে চিলি (৪০) ও প্যারাগুয়ে (৩৮)। সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ না থাকলেও সবচেয়ে বেশি ১২৮ জয় আর্জেন্টিনার। সমান ১৫ বার করে শিরোপা জিতেছে উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা। সবচেয়ে বেশি পরাজয় চিলির, ৮৮ ম্যাচে পরাজিত হয়েছে এই দলটি। মাত্র ৩৭ বার অংশ নিলেও আর্জেন্টিনার (৪৭৪) পর সর্বোচ্চ গোল ব্রাজিলের (৪৩০)। এবার কোপা আমেরিকায় কানাডা হতে যাচ্ছে অতিথি দল হিসেবে কোপায় অংশ নেওয়া দশম দল। অতিথি দল হিসেবে ১০ বার কোপা খেলেছে মেক্সিকো, হয়েছে দুবার রানার্সআপ। একবার করে এ পর্যন্ত অংশ নিয়েছে হন্ডুরাস, পানামা, কাতার, হাইতি। একবার অংশগ্রহণ করার সুবাদে সবচেয়ে কম গোল হজম করেছে হন্ডুরাস ও কাতার। তবে একবার অংশ নিয়েই ব্রাজিলকে টপকে সেমিফাইনালে খেলেছিল হন্ডুরাস। কোচদের পরিসংখ্যানে সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে আর্জেন্টিনার গুইলের্মো স্তাবিলে। সর্বমোট ছয়বার কোপা জিতেছেন তিনি, অন্য কেউ জিততে পারেনি দুবারের বেশি। ব্রাজিলের দুঙ্গা একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে খেলোয়াড় ও কোচ—দুই ভূমিকাতেই জিতেছেন কোপা। সর্বোচ্চ ১৭ গোল করেছেন আর্জেন্টিনার নরবার্তো মেন্ডেজ এবং ১৯৫০ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলজয়ী ব্রাজিলের জিজিনিও। সব চেয়ে বেশি পাঁচটি পেনাল্টি শুটআউট জিতেছে ব্রাজিল, সবচেয়ে বেশি ছয়বার পেনাল্টি ভাগ্যে হেরেছে উরুগুয়ে।
গত ১০ বছরের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত হতে যাচ্ছে কোপা। অনেকের মতে, এত ঘন ঘন টুর্নামেন্ট আয়োজনের কারণে কোপা হারাতে পারে এর গুরুত্ব। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ইউরোর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে কোপা। আবার দক্ষিণ আমেরিকার জনগণের একাংশ অখুশি নিজ মহাদেশের বাইরে গিয়ে কোপা আয়োজন করার জন্য। তবে যত যা–ই হোক, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথের কারণে বাংলাদেশিদের কোপা আমেরিকাও ব্যাপক জনপ্রিয়। মাসখানেকের জন্য ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, মেসি-ভিনিসিয়ুসে মাতবে সবাই। হাজার হাজার মাইল দূরে রচিত হবে সমর্থকদের আনন্দ–বেদনার কাব্য!