চমকটা ২০১৮ বিশ্বকাপেই দেখিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ২৭ জুন জার্মানির মুখোমুখি হয়েছিল দলটি। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে তত দিনে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে সন হিউং-মিনের কোরিয়া। কিন্তু জার্মানির তখনো আশা টিকে ছিল। এক জয় আর এক হার নিয়ে গ্রুপ ‘এফ’-এর তৃতীয় স্থানে ছিল দলটি। শেষ ষোলোতে যাওয়ার জন্য কোরিয়ার বিপক্ষে জিততেই হতো জার্মানদের, সঙ্গে ছিল গোলপার্থক্যের মারপ্যাঁচও। সবাই ভেবেছিল, ম্যাচটি জিতে সহজেই পরবর্তী রাউন্ডে চলে যাবে ২০১৪ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার মনে ছিল ভিন্ন কিছু। বাদ পড়ে গেছে দল, তাতে কি? অন্তত এক ম্যাচ জিতে বাড়ি ফিরতে হবে—এমন দৃঢ় মনোবল নিয়ে সেদিন মাঠে নামে তারা। দাঁতে দাঁত চেপে ম্যাচের ৯০ মিনিট জার্মানদের আটকে রাখে দলটি। সবাই ভাবছিল, ড্র হয়েই বোধ হয় খেলাটি শেষ হবে। তখনই জার্মানসহ পৃথিবীর তাবৎ ফুটবল–সমর্থকদের হতভম্ব করে দিয়ে যোগ করা সময়ে পরপর দুই গোল দিয়ে বসে তারা। আর তাতেই এক বিশ্বকাপ জেতার পরের বিশ্বকাপেই গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যায় জার্মানরা। বাদ পড়ে যায় কোরিয়াও। কিন্তু শেষ ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে জানান দিয়ে যায়, ইউরোপীয় দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়তে পারে তারাও!
রাশিয়া বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার থেকেও ভালো নৈপুণ্য দেখায় এশিয়ার আরেক ফুটবল পরাশক্তি জাপান। গ্রুপ ‘এইচ’–এ তাদের প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া, সেনেগাল আর পোল্যান্ড। তিন ম্যাচে একটি করে জয়, হার এবং ড্রয়ের মাধ্যমে শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেয় তারা। এমনকি শেষ ষোলোতে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তাদের শুরুটা ছিল দারুণ। ২-০ গোলে এগিয়ে যায় ম্যাচের ৫৩ মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ৩-২ গোলে হেরে হৃদয় ভাঙে জাপানের। জাপানের বিদায়ের পরও কোরিয়া আর জাপানের খেলা দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন সমালোচকেরা।
গত বিশ্বকাপ যেখান থেকে শেষ করেছিল এই দুই দল, এই বিশ্বকাপ যেন শুরু করেছে সেখান থেকেই। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিপক্ষে ছিল জাপানের প্রথম ম্যাচ। এবার জার্মান দল খুব অভিজ্ঞ না হলেও কোনো অংশেই জাপানের থেকে দুর্বল বলা যাবে না। বরং শক্তিমত্তার দিক দিয়ে জাপান ছিল পিছিয়ে, যা খেলা শুরু হওয়ার পর উল্টে যায় ভোজবাজির মতো। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচটি জাপান জিতে নেয় ২-১ গোলে। জন্ম দেয় অঘটনের। পরের ম্যাচে জাপান কোস্টারিকার বিরুদ্ধে হেরে গেলেও আবারও চমক দেখায় শেষ ম্যাচে, স্পেনের বিরুদ্ধে ২-১ গোল ব্যবধানে জয় তুলে নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ ষোলোতে পৌঁছে যায় হাইমে মরিয়াসুর দল।
জাপানের মতো উড়ন্ত সূচনা পায়নি দক্ষিণ কোরিয়া। প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ড্র আর দ্বিতীয় ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে হেরে খাদের কিনারায় পৌঁছে যান সন হিউং মিনরা। কোরিয়া তাদের দক্ষতা দেখায় গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেয়।
শেষ ষোলোতে জায়গা না পেলেও গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে হট ফেবারিট আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম অঘটনের জন্ম দেয় সৌদি আরব। এশিয়া থেকে বাছাইপর্ব খেলা আরেক দল অস্ট্রেলিয়াও ভালো ফুটবল খেলে উত্তীর্ণ হয় শেষ ষোলোতে।
আস্তে আস্তে এশিয়ার দলগুলো সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, প্রতি বিশ্বকাপেই চোখে পড়ছে দলগুলো উন্নতি। তবে এই বিশ্বকাপে এশিয়ানদের এত ভালো খেলার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দেখেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার টমি ওর, ‘এবারের বিশ্বকাপে এশিয়ার দলগুলো এমনি এমনি এত ভালো করছে না। এটা অনেকগুলো বিষয়ের সম্মিলিত ফলাফল। ইউরোপের বড় বড় লিগগুলোয় এখন নিয়মিত এশিয়ান ফুটবলাররা খেলছেন। ফলে ইউরোপ আর এশিয়ার ফুটবলের মধ্যে আগে যে ব্যবধানটা ছিল, তা অনেকাংশেই কমে গেছে।’
পাশাপাশি বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় আর কাতারের আবহাওয়াও এশিয়ানদের সাহায্য করছে বলে মনে করেন টমি ওর, ‘ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো এবার খুব বেশি প্রস্তুতির সুযোগ পায়নি। পাশাপাশি এশিয়ার দলগুলো মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়ার সঙ্গে বেশি পরিচিত, কারণ তারা এখানে অনেকবার খেলেছে। সব মিলিয়ে তারা এ বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলেছে। আর এ জন্য সবাই আগের চেয়ে তাদের সম্মানও বেশি দিচ্ছে।’
কোচিং স্টাফ আর ট্রেনিংয়ের ধরনের পরিবর্তন আনাও এশিয়ার দলগুলোকে বিশ্বকাপে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে বলে মনে করেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সাবেক স্ট্রাইকার মাইকেল ব্রিজেস। এ জন্যই ইউরোপের দলগুলোর সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করতে পারছে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, ‘এশিয়ার ফুটবল দলগুলোর প্রস্তুতিতেও এখন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। খেলার পরিস্থিতির সঙ্গে এখন দারুণভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম তারা। জাপানকেই দেখুন, জার্মানির বিপক্ষে প্রথমার্ধে পাত্তাই পায়নি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ফরমেশনে পরিবর্তন এনে চমৎকারভাবে ঘুরে দাঁড়ায় দলটি।’
অস্ট্রেলিয়ার ক্রীড়াবিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ‘অপটাস স্পোর্টস’-এর বিশ্বকাপ উপলক্ষে আয়োজিত এক পডকাস্টে এ বিষয়গুলো তুলে আনেন বক্তারা। এশিয়ার দলগুলোর এমন উন্নতি চলতে থাকলে, ভবিষ্যতে এ অঞ্চল থেকে বিশ্বকাপে আরও বেশি দল অংশ নিতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তাঁরা।
শেষ ষোলোতে এফ গ্রুপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে জাপান। আর জি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলা গ্রুপ এইচের রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া। সমর্থকদের চাওয়া একটাই, ফলাফল যা–ই হোক, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া খেলুক ভালো ফুটবল।