কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা। গোলবারের নিচে অপেক্ষা করছেন হুগো লরিস। পেনাল্টি স্পটে দাঁড়ানো গনজালো মন্টিয়েল। রেফারি বাঁশি দিলেন, একটু দৌড়ে গিয়ে শট নিলেন মন্টিয়েল। গোল! টাইব্রেকার জয়! মুহূর্তের মধ্যে স্টেডিয়ামের নীরবতা ভেঙে কানে তালা লাগার জোগাড়। মধ্যমাঠে সতীর্থদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ানো মেসি বসে পড়লেন হাঁটু গেড়ে! কেবল আর্জেন্টিনার ডাগআউটে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির মুখে কোনো অনুভূতি খেলা করছে না। এমন মুহূর্তে তিনি থমকে গেছেন! যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ করবেন!
বছর চারেক আগেও তাঁর নাম বললে কেউ চিনতেন না সেভাবে। ফুটবলের পাঁড় ভক্তও হয়তো বলতে পারতেন না কে এই ভদ্রলোক! বলছিলাম লিওনেল স্কালোনির কথা।
কোনো ক্লাবের ম্যানেজার হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, কখনো কোচিং করাননি কোনো জাতীয় দলকেও। তবু তাঁর ওপর ভরসা রেখে আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন লিওনেল মেসিদের ভাগ্য গড়ার দায়িত্ব তুলে দেয় তাঁর হাতে। সেই ভরসার কী দারুণ প্রতিদান দিলেন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ শিরোপা জেতানোর মাধ্যমে। লিওনেল মেসি যদি হন মাঠের কান্ডারি, তবে পর্দার পেছনে সফলতার সুনিপুণ রোডম্যাপ তৈরির সুকৌশলী ছিলেন ৪৪ বছর বয়সী লিওনেল স্কালোনি।
খেলোয়াড়ি জীবনে স্কালোনি ছিলেন রাইটব্যাক, মাঝেমধ্যে দলের প্রয়োজনে খেলেছেন রাইট মিডফিল্ডার হিসেবেও। ২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে ছিলেন স্কালোনি। খেলেছেন ম্যাচও। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেবার লিওনেল মেসির সতীর্থ হিসেবে খেলা স্কালোনি এবারের বিশ্বকাপে ছিলেন মেসির গুরু। এ জন্যই বোধ হয় দুই লিওনেলের রসায়নটা জমজমাট ছিল।
২০১৮ বিশ্বকাপের পর আলবিসেলেস্তেদের দায়িত্ব নেন এই আর্জেন্টাইন। ওই সময় খোদ আর্জেন্টিনার গ্রেট ম্যারাডোনাও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর কোচিং অভিজ্ঞতা নিয়ে। অনভিজ্ঞ স্কালোনিকে কথার বাণে বিদ্ধ করেছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি। সব সন্দেহ ভুল প্রমাণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই থেকে শুরু। মেসি-দি মারিয়া-ওতামেন্দিদের নিয়ে ভগ্নদশার এক আর্জেন্টিনা দলকে ধীরে ধীরে দাঁড় করিয়েছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী করেছেন আর ফল হিসেবে পেয়েছেন তিন–তিনটি শিরোপার ছোঁয়া।
শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা দিয়ে। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে দীর্ঘদিনের শিরোপা–খরা কাটায় আর্জেন্টিনা। তারপর দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইউরোপের সেরা দল ইতালির সঙ্গে ‘ফাইনালিসিমা’তে ৩-০ গোলের একপেশে জয় তুলে নেন স্কালোনির শিষ্যরা।
একটানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক আর্জেন্টিনা পা রাখে বিশ্বকাপে। আবার এই দলেই রয়েছেন বর্তমান শতাব্দীর সেরাদের একজন— লিওনেল মেসি। কিন্তু টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসতে হয় স্কালোনি বাহিনীকে।
সহজ প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে গ্রুপ রাউন্ড থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। স্কালোনি টের পান ফুটবলের সেই চিরায়ত সত্য—বড় মঞ্চে ছোট দল বলে কিছু নেই, এখানে কাউকে হালকাভাবে নিলে পস্তাতে হবে নিজেদেরই।
তার পর থেকে ধীরে ধীরে আর্জেন্টিনার খেলায় আসে পরিবর্তন। প্রতি ম্যাচেই আগের ম্যাচের চেয়ে ভালো ফুটবল খেলার চেষ্টা করতে থাকে তারা। গ্রুপ রাউন্ড থেকে নকআউট রাউন্ডের সব খেলায় তাদের এমন ধারাবাহিক উন্নতি চোখে পড়ার মতো। আর ফাইনালের আর্জেন্টিনা করল বাজিমাত, মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শকদের টেনে রাখল খেলার সৌন্দর্য দিয়ে।
এই সবকিছুর পেছনে মূল কারিগরের ভূমিকায় ছিলেন লিওনেল স্কালোনি। আর্জেন্টিনাকে এক ছকে বাঁধা কোনো দল হিসেবে খেলাননি তিনি, বরং প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতাকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন। ট্যাকটিকসে এনেছেন ছোট ছোট রদবদল, তাতেই প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয়েছে ম্যাজিকের মতো।
ফরমেশনের হিসাবে আর্জেন্টিনা বেশির ভাগ ম্যাচ খেলেছে ৪-৪-২–এর ছকে। রাইটব্যাক হিসেবে মলিনা, লেফটব্যাক হিসেবে আকুনিয়া, সেন্টারব্যাক হিসেবে রোমেরো-ওতামেন্দি, মধ্যমাঠের দায়িত্বে রদ্রিগো দি পল-এনজো ফার্নান্দেজ, দুই পাশের ওয়াইড মিডফিল্ডার হিসেবে দি মারিয়া, ম্যাক আলিস্টার এবং ফরোয়ার্ডে লিওনেল মেসি ও আলভারেজ—এটাই ছিল স্কালোনির প্রথম পছন্দের একাদশ। খাতা–কলমে ৪-৪-২–এ মাঠে নামলেও লিওলেন মেসি খানিকটা নিচে নেমে খেলতেন প্লেমেকিং ফরোয়ার্ডের মতো। ফলে আদতে ফরমেশনটা হয়ে যেত ৪-৪-১-১।
ছোট ছোট পাসিংয়ে আক্রমণ তৈরি করা আর্জেন্টিনার মূল শক্তি ছিল মিডফিল্ডের দখল। রদ্রিগো দি পল ও এনজো ফার্নান্দেজ—দুজনই ডিফেন্সিভলি বেশ ভালো। তাই প্রতিপক্ষের পা থেকে বল নেওয়ার দায়িত্ব যেমন ভালোভাবে পালন করতে পেরেছেন, তেমনি পজেশন রেখে পাসিং ফুটবল খেলতেও সাহায্য করেছেন। ম্যাক আলিস্টার এক পাশের উইংয়ে থাকলেও বেশির ভাগ সময় তিনি খেলেছেন ‘নাম্বার এইট’ রোলে। খানিকটা ভেতরে এসে বল রিকভারিতে যেমন সাহায্য করেছেন, তেমনি বল নিয়ে প্রতিপক্ষের ডি বক্সের কাছেও পৌঁছেছেন। আক্রমণে উইঙ্গারদের সাহায্য করতে আর্জেন্টিনার ফুলব্যাক দুজনও প্রায়ই ওপরে উঠতেন।
একদিকে লিওনেল মেসিকে আটকাতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের এগিয়ে আসা, আরেক দিকে ওই ফাঁকা হয়ে যাওয়া জায়গায় আলভারেজ কিংবা দি মারিয়ার দৌড়ে ঢুকে পড়া—এটাই ছিল আর্জেন্টিনার আক্রমণের অন্যতম অস্ত্র। মেসি-মারিয়া-আলভারেজের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা আটকানো যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্যই দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহ।
কেবল ৪-৪-২ কিংবা ৪-৪-১-১ ফরমেশনেই নয়, প্রয়োজনের সময় ৪-৩-৩ এমনকি ৩-৫-২–এর মতো তিন ডিফেন্ডারের ফরমেশনও ব্যবহার করেছেন স্কালোনি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে দি মারিয়াকে ইনজুরির কারণে পায়নি আর্জেন্টিনা। ওদিকে তিন ডিফেন্ডারের ফরমেশন ব্যবহার করে ডাচরাও ভয়ংকর ফুটবল খেলা শুরু করেছে নকআউট পর্বে। তাদের চেকমেট করতে সেই ম্যাচে ৫-৩-২ ফরমেশনের (যেটা আক্রমণ করার সময় ৩-৫-২ হয়ে যায়) আশ্রয় নেন আর্জেন্টিনার কোচ। দি মারিয়া কিংবা আগের ম্যাচে খেলা পাপু গোমেজের জায়গায় নামানো হয় তৃতীয় সেন্টারব্যাক লিসান্দ্রো মার্টিনেজকে। মূলত নেদারল্যান্ডসের আক্রমণকে প্রতিহত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। এতে সত্যি সত্যি আটকেও যায় ডাচরা!
ম্যাচের শুরু থেকে ডাচদের হাতে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে আর্জেন্টিনা মনোযোগ দেয় কাউন্টার অ্যাটাক করার দিকে। তাতে ফলও পায় তারা। লিওনেল মেসির দারুণ এক পাসে উইংব্যাক থেকে উঠে আসা মলিনা গোল করে এগিয়ে নেন। এরপর ৭০ মিনিটে মেসির পেনাল্টিতে ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও শেষ দিকে দারুণভাবে দুই গোল করে ম্যাচে ফিরে আসে নেদারল্যান্ডস। তবে এরপর আর আর্জেন্টিনার রক্ষণ ভাঙতে পারেনি তারা, বরং টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয়।
সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আবার চেনা ৪-৪-২ ফরমেশনে ফিরে আসেন স্কালোনি। তবে এই ম্যাচেও দি মারিয়াকে না পাওয়ায় আরেকজন অতিরিক্ত বল উইনিং মিডফিল্ডারকে নামান পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ক্রোয়েশিয়ার দুর্দান্ত মিডফিল্ড ট্রায়ো মদরিচ-কোভাচিচ-ব্রোজোভিচের কাছ থেকে বল নিতে চাইলে অতিরিক্ত আরেকজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বেশ কার্যকর। ম্যাচ শুরু হতে তার প্রতিফলনও দেখা গেল। ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডের কাছে বল জিতে নেওয়ামাত্রই কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করতে থাকে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির ড্রিবলিং এবং আলভারেজের গতি—এই দুইয়ে নাকাল হয়ে অল্পতেই ধরা ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগ। তাই হাফ টাইম শেষ হওয়ার আগেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায় স্কালোনির দল। শেষ পর্যন্ত তারা ফাইনালে পা রাখে ৩-০ গোলের বড় জয় নিয়ে।
ফাইনালে ফ্রান্সকে মোকাবিলা করতে আলাদা এক ফন্দি আঁটেন স্কালোনি। দলকে ৩-৫-২ ফরমেশনে প্র্যাকটিস করাতে থাকেন, যেন এমবাপ্পে-গ্রিজম্যান-জিরুকে আটকাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই! এটা দেখে বেশির ভাগ মিডিয়াও ৩-৫-২–কে ফাইনালে আর্জেন্টিনার ফরমেশন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ফাইনাল শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, ৪-৩-৩ ছকে খেলছেন মেসিরা। ইনজুরি থেকে ফেরা দি মারিয়াও আছেন একাদশে।
প্রায় পুরো টুর্নামেন্টে দি মারিয়াকে ডান দিকের উইঙ্গার হিসেবে ব্যবহার করা স্কালোনি ফাইনালে তাঁকে নামালেন বাঁ দিকে। বাঁ পায়ের দি মারিয়া বারবার বল পেয়ে ফ্রান্সের ওই পাশের ডিফেন্সকে তটস্থ করছিলেন ম্যাচের শুরু থেকে। ড্রিবল করে ডি বক্সে ঢোকা, কখনো বাঁকানো ক্রসে আলভারেজ-মেসিকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় ফরাসিদের নাকানিচুবানি খাওয়াতে থাকেন তিনি। তাঁরই কল্যাণে প্রথম পেনাল্টিও পায় আর্জেন্টিনা। কিছুক্ষণ পর দলের দ্বিতীয় গোল করে খেলাকে একপক্ষীয় করে দেন দি মারিয়া।
ফাইনালে ফ্রান্স দলের মূল শক্তি ছিল তাদের আক্রমণভাগের সামর্থ্য আর দুর্বলতা ছিল মাঝমাঠে ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারের অভাব। স্কালোনি এটা বুঝতে পেরেই তিন মিডফিল্ডার—দি পল, এনজো, ম্যাক আলিস্টারকে দিয়ে দখল করে রাখেন মাঝমাঠ। তারপর যখনই সুযোগ এসেছে, মেসি-দি মারিয়ার প্লেমেকিংয়ের সাহায্য নিয়ে দ্রুতগতির আক্রমণ করেছে আর্জেন্টিনা। এই জায়গাতেই ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে ফ্রান্স। যদিও শেষ দিকে এমবাপ্পের একক প্রচেষ্টায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়, কিন্তু ট্যাকটিকসের হিসাবে বেশ ভালোভাবে এগিয়ে ছিলেন লিওনেল মেসিরা।
যেমনটা বলেছিলাম, প্রতিপক্ষকে বুঝে ম্যাচের পর ম্যাচ লিওনেল স্কালোনির দল সাজানোর মুনশিয়ানা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ সাফল্যের পেছনে অন্যতম সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। তা ছাড়া দলের প্রতিটি পজেশনে একাধিক খেলোয়াড় রাখা, মেসি-ওতামেন্দি-মারিয়ার মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি এনজো-আলভারেজ-মলিনাদের মতো উঠতি তরুণদের মিশেলে দল নির্বাচন করা, ম্যাচের ভেতর অবস্থা বুঝে খেলোয়াড় পরিবর্তন করা—এসব বিষয়েও স্কালোনির দূরদর্শিতা ছিল জাত রণকৌশলীর মতো। বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ফুটবল খেলা এই আর্জেন্টিনাকে ফুটবল–বিশ্ব মনে রাখবে অনেক দিন, একই সঙ্গে মনে রাখবে তাঁকেও।