বিদায় লাল দুর্গের রাজা
অন্ধকারকে প্রচণ্ড ভয় পান রাফায়েল নাদাল। অন্ধকার আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠলে আঁতকে ওঠেন। পশুপাখিও খুব একটা পছন্দ না। সমুদ্রপারে জন্ম, জাহাজের নাবিক হয়ে বহুদূর পাড়ি দেওয়া তাঁর স্বপ্ন। অথচ একটু গভীর পানি হলেই সাঁতরাতে বুক দুরুদুরু করে তাঁর। মোটরসাইকেল কিনেছেন, কিন্তু চড়তে গেলে মনে হয়, থাক না। একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছোটবেলায় কখনো মারামারি করেছেন? নাদাল আঁতকে উঠে উত্তর দিয়েছিলেন, কখনো না। ছোটবেলায় মারামারি দেখলেই দূরে সরে আসতেন তিনি।
অথচ নাদালের সব ভয় উবে যায় কোর্টে পা দিতেই। জীবনের প্রতি পদে ভীতসন্ত্রস্ত নাদাল হয়ে ওঠেন হিংস্র, পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে বেড়ান কোর্টের প্রতিটি প্রান্তে। তাঁর রাজত্বে হানা দেওয়ার অধিকার নেই কারও। রজার ফেদেরারের চোখধাঁধানো ফোরহ্যান্ড কিংবা নোভাক জোকোভিচের টপস্পিন–কোর্ট পাড়ি দিয়ে হলেও নাদাল সে শট থামাবেন। কোর্টে খেলা প্রতিটি শটের মূল্য যে তাঁর জীবনের থেকেও বেশি।
আক্ষরিক অর্থেই নাদাল নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবেসেছেন টেনিসকে। আর কোর্টের মাটি, ঘাস, কার্পেটের চেয়ে থেকে তাঁকে বেশি টেনেছে চোট। নাদালের পেশাদার ক্যারিয়ারের বয়স তখন মাত্র তিন। চোটের কারণে মায়োর্কাতে নিজের বাড়িতেই কাটাচ্ছেন অলস সময়। শোকেসে ঝকঝক করছে নিজের একমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যামটা। এমন সময় মাদ্রিদ ডাক্তারের ফোন, পায়ের পাতার হাড়ে ধরা পড়েছে এক বিরল রোগ। পায়ের পাতার হাড় ঠিকঠাক বৃদ্ধি পায়নি তাঁর। ফলে যখনই পায়ের ওপর বেশি চাপ পড়ে, নাদাল কুঁকড়ে ওঠেন ব্যথায়। এই রোগের নেই কোনো চিকিৎসা, পায়ের ওপর চাপ যত কম পড়বে, ততই ভালো থাকবেন তিনি। আগবাড়িয়ে নাদালকে ভিন্ন পথও দেখিয়ে দিলেন, ‘গলফটা খেলতে পারো। ওতে পায়ের ওপর অত চাপ পড়ে না।’
কোর্টে ফেরা তখন অনিশ্চিত। মাটিতে পা ফেলতেই ব্যথায় কেঁপে ওঠে শরীর। সব ছেড়ে নাদাল ফিরে গেলেন নিজের বাড়িতে, সমুদ্রের খুব কাছাকাছি। দুঃস্বপ্ন ভুলতে আর কোনো পথ জানা ছিল না তাঁর। কোচ টনি নাদাল হাল ছাড়ার পাত্র নন। ছোট্টবেলা থেকেই সবার চোখের মণি রাফা। পরিবারের প্রথম নাতি বলে কথা, দাদা-চাচাদের প্রথম খেলার সঙ্গী। রাফার হাতে অপশন ছিল দুটোই, হয় বড় চাচার সঙ্গে টেনিস খেলা। নইলে ছোট চাচা মিগুয়েল অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে ফুটবল খেলা। মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল তখন বার্সার বড় তারকা। পত্রিকায় তাঁর পরিচিতি, মাঠে তাঁর ডাকনাম ‘দ্য বিস্ট অব বার্সেলোনা’। মিগুয়েলের সঙ্গে সঙ্গে রাফাও তত দিনে বার্সা ড্রেসিংরুমের বিশাল তারকা।
গোলাকার বল ছেড়ে রাফা খুঁটি গেড়েছিলেন কোর্টে। গোলাকার বল ভালোবেসেছেন, সময়ে–অসময়ে খেলেছেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন র৵াকেটকে। সেই ভালোবাসাকে এত সহজে ছেড়ে যেতে দেবেন টনি? সম্ভব নয়। নাদালকে নিয়ে এলেন কোর্টে। পা চলছে না? না চলুক। কোর্টের মধ্যে একটা চেয়ারে বসিয়ে চলল অনুশীলন। যোগাযোগ করলেন নাইকির সঙ্গে। বিশ্বের সেরা অর্থোপেডিক ডাক্তারদের সাহায্য নিয়ে বানানো হলো বিশেষ জুতো। সেই জুতো পায়ের পাতা থেকে ভর সরিয়ে নিয়ে গেল পায়ের গোড়ালি। বদলে গেল রাফার খেলার ধরণ, কোর্টে নাদাল হয়ে উঠলেন আরও দুরন্ত।
রজার ফেদেরার ততদিনে টেনিস জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। শিরোপা জিতছেন রীতিমত ঘোষণা দিয়ে, টেক্কা দেওয়ার নেই কেউ। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্লিভলেস টি-শার্টের এক ছেলে হাজির হলেন, রাজত্ব্যে বসিয়ে দিলেন এক হাত। পুরো কোর্ট দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন, ছুড়ে দিচ্ছেন একের পর এক ফোরহ্যান্ড আর টপস্পিন। ফেদেরারের হাজার কারিকুরিও উবে যাচ্ছে তার সামনে। কী আশ্চর্য! পুরো পৃথিবী জয় করে এসে ফেদেরার কিনা আটকা পরছেন বিশ না পেরোনো এক দস্যি ছেলের কাছে। নাদাল এসেছিলেন ‘কিংস্লেয়ার’ হয়ে। যেন জানতেন রাজাকে আটকালে রাজত্ব এমনিতেই আসবে। গ্রাস কোর্টে টানা ৫ বছর, ৬৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড থেমে গেল স্প্যানিয়ার্ডের কাছে, সেটাও আবার উইমবল্ডনের ফাইনালে। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও ফেদেরার ভোলেননি সেই স্মৃতি। নাদাল বরাবরই তার চোখে অমলিন, ভয়ানক আর সেই সঙ্গে এক প্রিয় বন্ধুর নাম।
দুই দশকের ক্যারিয়ারে নাদালের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পেরেছেন একজন, নোভাক জোকোভিচ। কোর্টে সবচেয়ে বেশি দেখা হয়েছে তাঁর বিপক্ষেই। ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ফাইনাল থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে ‘বেগেল’, ঘাস-মাটি-কার্পেটের প্রাঙ্গনে রচিত ইতিহাস। কৈশোরে রজার, যৌবনে জোকোভিচ আর শেষে এসে আলকারাজ; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী বদলেছে। বদলেছেন নাদালও। বয়সের সঙ্গে থ্রি কোয়ার্টার ছেড়ে হাফ প্যান্ট পরেছেন, স্লিভলেস ছেড়ে থিতু হয়েছেন টি-শার্টে। যৌবন শেষে হারিয়ে গিয়েছে মাথার লম্বা চুল। হারায়নি শুধু তাঁর উন্মাদনা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মানসিকতা।
নাদাল আজীবন পরিচিত হয়ে এসেছেন নিজের হার না মানা মানসিকতার জন্য। পত্রপত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে তাঁর রেকর্ড। ক্লে কোর্টের রাজা বললেও যেন অনেক কম বলা হয়ে যায়। মাটির রাজ্যে যে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন, তা কলমের কালিতে বোঝানোর সাধ্য নেই কারও।
নাদালকেও একদিন শেষ করতেই হতো। বিশাল আয়োজন বরাবরই অপছন্দ তাঁর। ইচ্ছে ছিল একটাই, কোর্ট থেকে বিদায় বলার। ফ্রেঞ্চ ওপেন চেয়েছিল আয়োজন করতে, অলিম্পিকেও ছিল বন্দোবস্ত। নাদাল খারিজ করে দিয়েছেন বারবার। বিদায়ে তাঁর বড্ড ভয়। এই বন্ধুর পথ একা পাড়ি দেওয়া সম্ভব না। বিদায়ের ঘর হিসেবে বেছে নিলেন নিজের ঘর, সঙ্গী হিসেবে নিজের দল আর মঞ্চ হিসেবে নিজের প্রথম লাইমলাইট ডেভিস কাপ।
ডেভিস কাপের মঞ্চে নাদাল প্রথম এসেছিলেন ২০০০ সালে। ১৩ বছর বয়সী রাফার হাতে তখন শোভা পাচ্ছিল স্পেনের পতাকা। নাদাল ছিলেন স্পেনের পরশপাথর, ছয়টি ডেভিস কাপের প্রতিটিই এসেছে তাঁর সংস্পর্শে। পাঁচবার জিতিয়েছেন মাঠ থেকে, আরেকবার মাঠে ছিলেন পতাকা নিয়ে। স্পেনের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার প্রথম সিঁড়ি ছিল সেই পতাকা। যে মঞ্চ থেকে নিজের উত্থান, সেই মঞ্চেই শেষ করার সুযোগ কজনের হয়?
নাদাল নিজেও জানতেন, শরীরটা তাঁকে আর টানছে না। কোর্টে নিজেকে যত ঢেলে দিয়েছেন, তত যেন আটকে পড়েছেন এক অদৃশ্য বেড়াজালে। এমনটা আগে কখনো হয়নি। এর আগেও শরীরকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন অনেক দূর। সহ্য করতে না পেরে শরীর ভেঙে পড়েছে, কিন্তু দমে যাননি। তখনই বুঝেছেন, দরজায় কড়া নাড়ছে বিদায়।
সত্যি বলতে, নাদাল তাঁর সবটা দিয়ে রাঙিয়েছেন ২০২২ সালকে। দুই সেটে পিছিয়ে পড়েও হার মানেননি, মেদভেদেভের জেতা শিরোপা ছিনিয়ে এনেছেন নিজের কাছে। পূরণ করেছেন নিজের ডাবল ক্যারিয়ার স্লাম। ফ্রেঞ্চ ওপেনে পাঁচ সেটের ম্যাচ খেলেছেন ফেলিক্সের বিপক্ষে, কোয়ার্টারে জোকোভিচকে হারিয়েছেন টেক্কা দিয়ে। শরীরের একের পর এক পেইনকিলার নিয়েছেন, ইনজেকশন দিয়ে অবশ করে রেখেছেন শরীরের বিভিন্ন অংশ। ১৪ নম্বর ফ্রেঞ্চ ওপেন নিয়ে উদ্যাপনও করতে পারেননি, সরাসরি বসে পড়েছেন হুইলচেয়ারে। সগৌরবে ফিরেছেন উইলম্বলডনে, কয়েকবার বিরতি নিয়েও মাঠ ছাড়েননি। কোয়ার্টার ফাইনালে টেইলর ফ্রিটজকে হারিয়েছেন পঞ্চম সেটে গিয়ে। শরীর আর সায় দেয়নি, কোয়ার্টার জিতেই সরাসরি হাসপাতাল, অতঃপর সেমি থেকে ওয়াকওভার। শরীরের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, জাস্ট ফর ‘ওয়ান লাস্ট ড্যান্স’! চোট নিয়েও নাদাল ফিরেছিলেন, ফেদেরারকে বিদায় বলতে, লেভার কাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষবারের মতো কোর্টে দেখতে।
এরপরই বদলে গিয়েছে নাদালের জীবন। ১৪ বছরের প্রেম পূর্ণতা পেয়েছে ২০১৯ সালে। ২০২২–এর অক্টোবরে যুক্ত হয়েছে নতুন সদস্য। রাফার জীবনের এখন সবচেয়ে বড় ভালোবাসার নাম রাফায়েল জুনিয়র। সন্তানের ছোঁয়ায় কতজনই তো বদলে যান, নাদালও হয়তো গিয়েছেন। বছরের পর বছর চোটের সঙ্গে লড়াই করে কোর্টে টিকে থাকা রাফার কোলে যখন ছোট্ট রাফায়েল এল, মুহূর্তেই যেন সব সমীকরণ বদলে গেল। ক্লে কোর্টের লাল মাটি থেকে গ্যালারিতে সন্তানের মুখমণ্ডলটা বেশি প্রিয় হয়ে উঠল।
চাইলে হয়তো নাদাল আরেকবার ফিরে আসার গল্প লিখতে পারতেন। এমন তো না তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়নি। বিদায়ের ঘণ্টা তাড়া করেছে নাদালকে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে তিনি ফিরেছেন বহুগুণ ভয়ানক হয়ে। এবারের শেষের শুরুটা করেছেন নিজেই। শেষটা রাঙিয়েছেন নিজের মনমতো করে। জিততে পারেননি, কিন্তু জিততে নাদাল কখনোই চাননি। তিনি চেয়েছেন জয় করতে।
নাদাল আজীবন পরিচিত হয়ে এসেছেন নিজের হার না মানা মানসিকতার জন্য। পত্রপত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে তাঁর রেকর্ড। ক্লে কোর্টের রাজা বললেও যেন অনেক কম বলা হয়ে যায়। মাটির রাজ্যে যে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন, তা কলমের কালিতে বোঝানোর সাধ্য নেই কারও। রোলাঁ গারো জিতেছেন ১৪ বার! ১১২ জয়ের বিপরীতে ছিল মাত্র ৪ হার। দুই বছর মাটির কোর্টে ছিলেন অপরাজিত। পাঁচ বছর হারের দেখা পেয়েছেন মাত্র একবার। ২০০৪ থেকে ২০২৩, ১৯ বছরে ক্লে কোর্টে হেরেছেন মাত্র ৩৮ বার। বিপরীতে জয়? ৪৬২! টানা ৯১২ সপ্তাহ ছিলেন র৵াঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০-এ। কামড় বসিয়েছেন ২২ গ্র্যান্ড স্লাম, ৯২ শিরোপা, ২ অলিম্পিক গোল্ডে। সবটাই অর্জন করেছেন ফেদেরার জোকোভিচের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে। নিজের শরীরকে বাজি রেখে।
পরিসংখ্যানের খাতা খুঁড়ে যত গভীরে যাওয়া যাবে, নাদালের রেকর্ডগুলো ততই অবিশ্বাস্য শোনাবে। অথচ নাদাল কখনো সংখ্যা হতে চাননি। ঠাঁই পেতে চাননি খাতায়। নাদাল আজীবনই জায়গা খুঁজেছেন মানুষের মনে। টনি চাচার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন, তিন বছর বয়সে করা র্যাকেট না ভাঙার প্রতিজ্ঞা মেনে চলেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। শিরোপায় কামড় দেওয়া আইকনিক উদ্যাপন হয়তো মুছে যাবে, কিন্তু ভালো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাওয়া নাদাল মণিকোঠায় থাকবেন আজীবন।