রাঙ্গাটুঙ্গির স্বপ্না-সাগরিকারা এখন সারা দেশের গর্ব
সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেই খেলায় হেরেই যেতে বসেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মোসাম্মৎ সাগরিকার গোলে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। পরে টাইব্রেকারে দুই দলের ১১ করে ২২ খেলোয়াড়ের সবাই বল জালে জড়ান। শেষ পর্যন্ত যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ ও ভারতকে। সেই সাগরিকাকে এখন সারা দেশ চেনে।
সাগরিকার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে। সেই গ্রামের তাজুল ইসলাম সাগরিকাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন একটি ফুটবল একাডেমি। গ্রামের নামেই নাম রেখেছিলেন—রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি।
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরের উপজেলা রানীশংকৈল। সেখানে থেকে চার কিলোমিটার দূরে রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রাম। গ্রামটিতে বেশির ভাগ দিনমজুর, প্রান্তিক কৃষকের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। সেই গ্রামেই তাজুল ইসলাম গড়ে তোলেন এই ফুটবল একাডেমি। কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা ফুটবলের কলাকৌশল রপ্ত করছে সেখানে। এই একাডেমির ১৮ জন মেয়ে এ পর্যন্ত বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে খেলেছেন। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে রয়েছেন সাতজন মেয়ে। পাশাপাশি গত নারী লীগে আট দলে ২২ জন খেলেছেন দেশের বিভিন্ন ক্লাবে।
যেভাবে শুরু
২০১৪ সালের কথা। রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলত। ছেলেদের সঙ্গে সেখানে ফুটবল খেলতেন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলাম। সে বছরের আগস্টে গ্রামের ওই মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি দেখেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন মেয়ে ফুটবল নিয়ে ছুটোছুটি করছে। তাঁর ভাবনায় এল, মেয়েরাও তো ফুটবল খেলতে পারে! খেলা চলার সময় ওই কিশোরীদের ডেকে পরিচিত হলেন তিনি। জানালেন নিজের ভাবনার কথা। প্রস্তাব পেয়ে রাজি হয়ে গেল মেয়েরা। পরদিনই শুরু হয়ে গেল দল গঠনের কাজ। সঙ্গে যোগ দিলেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুবক সুগা মুর্মু, স্থানীয় যুবক জয়নুল আবেদিন ও সেতাউর রহমান। তবে খেলোয়াড় জোগাড় করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়লেন তাঁরা। গ্রামে ঘুরে ঘুরে যখন তাঁরা খেলোয়াড় জোগাতে করতে লাগলেন, তখন অভিভাবকেরা জানালেন আপত্তি। মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এটা কেমন কথা! তাদের বিয়েশাদির ব্যাপার আছে না! ছোট পোশাক পরে ফুটবল খেলা মেয়েকে কারা ঘরে তুলে নেবে? তবে এতে তাজুল, সুগারা দমে যাননি। অভিভাবকদের পেছনে লেগে রইলেন। শেষমেশ তাঁদের অনুরোধে এক এক করে কিশোরীরা মাঠে আসতে শুরু করল। কয়েক দিনের মাথায় ১৪ থেকে ১৫ জনের একটা দল পেয়ে গেলেন তাঁরা। তাদের ঘিরেই গড়ে উঠল একটি ফুটবল দল—নাম রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। আর পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাজুল ইসলাম নিজেই।
মেয়েদের ফুটবল দল গড়ে উঠলেও তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না। প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের পক্ষে ফুটবলের জন্য বাড়তি টাকা জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। তবে তাজুল ইসলাম দমার পাত্র নন। সাধারণ পোশাক আর খালি পায়েই মেয়েদের অনুশীলন চালাতে লাগলেন। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রীড়াসামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা। একসময় স্থানীয় বাসিন্দারাও এগিয়ে আসেন। এর পর থেকে আর তাঁদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একাডেমিতে এখন বিভিন্ন বয়সী ৩৮ জন মেয়ে নিয়মিত অনুশীলন করছে।
দুই বছরেই ধরা দেয় সফলতা
২০১৫ সালটা ছিল একাডেমির জন্য কঠিন সময়। তখন দলটি গড়ে উঠছিল মাত্র। ২০১৬ সালে এসে বেশ শক্তিশালী ফুটবল দলে পরিণত হয় রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির দলটি। সেই বছর জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টে ঠাকুরগাঁও জেলা দল গড়ে তোলা হয় রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েদের নিয়েই। একের পর এক জেলা দলকে পরাজিত করতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা। হইচই পড়ে যায় গোটা দেশে। তবে সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ রংপুর জেলা দলের সঙ্গে হেরে বসে দলটি। ২০১৭ সালে একই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ছিল ঠাকুরগাঁও জেলা দলের রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা। গাইবান্ধায় হওয়া প্রথম দুই ম্যাচে লালমনিরহাটকে ১৬-০ আর দিনাজপুর জেলা দলকে হারায় ৮-০ গোলে। ফাইনালে গাইবান্ধা জেলা দলকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ঢাকায় যাওয়ার টিকিট নিশ্চিত করে ফেলে তারা। মূল পর্বে ঢাকায় গিয়েও সফল রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা। গ্রুপে টানা তিন ম্যাচ জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে পৌঁছে যায় ফাইনালে। ফাইনালে অবশ্য কলসিন্দুরের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ময়মনসিংহ জেলা দলের সঙ্গে পেরে ওঠেনি দলটি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টেও রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঠাকুরগাঁও ফুটবল দল রানার্সআপ হয়।
এখন একাডেমির কে কোথায়
এরপরই এই একাডেমির মেয়েরা একের পর এক বিভিন্ন পর্যায়ের দলে সুযোগ পেতে শুরু করেন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের সহ–অধিনায়ক স্বপ্না রানী, মোছাম্মৎ সাগরিকা ছাড়াও মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হওয়া বাংলাদেশ দলের সোহাগী কিসকু, বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে কোহাতি কিসকু, অনন্য মুর্মু, সুমি আক্তার ও রেশমী বেগম রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনী ফুটবল যোগ দিয়েছেন আশামুনি ও মুনিরা আক্তার। মুন্নী আখতার আদুরী, রঞ্জনা রাণী, কাকলী আক্তার ও বিথিকা কিসকুসহ ১৮ জন মেয়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলে খেলেছেন। কাকলী আক্তার, ঈশরাত জাহান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রশিক্ষণে পর্তুগাল যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। একাডেমির ২২ জন খেলোয়াড় গতবারে দেশের নারী ফুটবল লিগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে অংশ নিয়েছেন।
ওদের নিয়ে গ্রামবাসীর গর্বের শেষ নেই
মেয়েরা ফুটবল খেলবে—এ নিয়ে গ্রামবাসীর কত কথা, কত কটূক্তি! এই কটূক্তি সইতে না পেরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দলের সাগরিকার বাবা লিটন আলী মেয়েকে ফুটবল মাঠে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। পরিবার থেকে এমন নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন আরও অনেক মেয়ে। কিন্তু তাঁরা দমে যাননি। সেসব কটূক্তি আর বাধা পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করেন ফুটবল। এখন গ্রামের মানুষ তাঁদের জন্য গর্ব করেন। পাশাপাশি খেলায় উৎসাহ জোগান। রাঙ্গাটুঙ্গির মাঠে বিভিন্ন জেলা থেকে নারী দলের খেলোয়াড়েরা এসে প্রীতি ম্যাচ খেলেন। আর বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজন ও প্রতিবেশীরা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁদের মেয়েদের খেলা উপভোগ করেন। ওই দিনের বিকেলটা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। এই খেলোয়াড়েরা যেন গ্রামের সবার আত্মীয়। এখন ওরা যেন সবার সন্তান। একাডেমির মাঠে অনুশীলন করে প্রান্তিক পরিবারের এই মেয়েরা নিজেদের যেমন খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলছেন, তেমনি আয়ও করছেন। আর এতেই তাঁদের পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে।
একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওরা হতে চায় স্বপ্না-সাগরিকা
পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়ে মেঘলা মার্ডি। রানীশংকৈল কেন্দ্রীয় উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা খেতখামারে শ্রম দিয়ে সংসার চালান। মেঘলাও স্বপ্ন দেখে সাগরিকা আর স্বপ্নার মতো দেশের হয়ে ফুটবল খেলবে। মেঘলার মতো সোমা আক্তার, টুপুর রানী, জবা কিসকু, শুমাইয়া আক্তাররাও রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমিতে নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারাও একদিন দেশের জার্সি গায়ে নিয়ে খেলতে চায়।
একাডেমির খেলোয়াড় কাকলী আক্তার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রশিক্ষণে পর্তুগাল যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনিও এলাকার প্রান্তিক পরিবারের মেয়ে। কাকলীর মা বানেসা বেগম বলতে লাগলেন, ‘মেয়েরা ফুটবল খেলিবে, এই নিয়া কত কথা। অ্যালা দেখেন ওই মেয়েদের নিয়াই আজ গ্রামের সবাই গর্ব করছে।’
জাতীয় নারী ফুটবল দলের নিয়মিত মুখ স্বপ্না রানীর বাবা নীরেন রায় বলেন, ‘যাঁরা মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে নানা কথা বলতেন, এখন তাঁরাই মেয়েদের নিয়ে গর্ব করেন।’ স্বপ্নার বাবা আরও বলেন, ‘আমার বাড়ি রানীশংকৈল শুনলে অনেকেই বলেন, “ফুটবল খেলে স্বপ্না, সোহাগী, সাগরিকাকে চেনেন?” তাঁদের যখন বলি, ‘আমিই স্বপ্নার বাবা’, তখন তাঁরা আমাকে খুব সম্মান করেন। মেয়ের জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়। আর এটা সম্ভব হয়েছে রাঙ্গাটুঙ্গির এই একাডেমির হাত ধরেই।
কথা হলো অনুশীলনে আসা প্রতিকা রানী, জারমিন আক্তার, বেনুকা হেমরন, বেলী সরেন, রুমিতা সরেনসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের সবার চোখে আগামীর স্বপ্ন। ফুটবল ও তাদের স্বপ্ন নিয়ে জানতে চাইলে সবার যেন একটাই উত্তর, ‘আমরা দেশের হয়ে খেলতে চাই।’
একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ দেশের নারী ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা নারী ফুটবল একাডেমিগুলোকে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ করে গড়ে তোলা গেলে নারী ফুটবলাররাই দেশকে মাতিয়ে রাখবে। এর জন্য আমাদেরও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। নারী ফুটবলারদের প্রতি সামান্য করলে অসামান্য ফল পাবেন।’