মরক্কোর সবচেয়ে বড় শহর কাসাব্লাঙ্কা থেকে দোহার দূরত্ব ৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। কিন্তু সে দূরত্ব যেন ঘুচে গেছে এবারের বিশ্বকাপে, আরব মানচিত্র তো বটেই, পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরাই চোখ রাখবেন আল বাইত স্টেডিয়ামে, বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে। এই ম্যাচে যে ফ্রান্স থাকতে পারে বলে ধারণা করেছিল অনেকেই, কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ হবে মরক্কো, খোদ মরোক্কান ফুটবলের পাঁড় সমর্থকও হয়তোবা এতটা কল্পনা করেননি। কিন্তু বাস্তবতা যে কল্পনাকেও মাঝেমধ্যে হার মানায়, তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে আশরাফ হাকিমি, হাকিম জিয়েশের দল।
বিশ্বকাপে মরক্কো দলের মূল চালিকা শক্তি বিভিন্ন লিগে খেলা বিভিন্ন খেলোয়াড়ের অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন। মরক্কোর স্কোয়াডের ২৬ জনের মধ্যে ১৪ জনেরই জন্ম স্পেন, নেদারল্যান্ডস অথবা ফ্রান্সের মতো ফুটবল পরাশক্তি দেশগুলোতে। স্পেনের বিপক্ষে পেনাল্টিতে নায়ক বনে যাওয়া গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনুর জন্মই যেমন কানাডায়, কিন্তু ক্যারিয়ার গড়েছেন স্পেনের লা লিগায়। সেভিয়ার জার্সিতে এই সিজনটা খুব বেশি ভালো যাচ্ছিল না তাঁর, সেটার দুঃখ ঘোচালেন তিনি বিশ্বকাপে এসে।
এই বিশ্বকাপে মরক্কোর যে খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন, তিনি আশরাফ হাকিমি। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই রাইটব্যাকের ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরুটা রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলে। সেখান থেকে ইন্টার মিলান ঘুরে ২০২১ সালে মেসি, নেইমারের সতীর্থ হিসেবে যোগ দেন পিএসজিতে। তার আগেই অবশ্য পরপর দুবার জিতে নিয়েছিলেন আফ্রিকার সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের তকমা, পরপর চারবার জায়গা পেয়েছেন ফ্রান্স ফুটবলের নির্বাচিত আফ্রিকার সেরা একাদশে। ইতালিয়ান লিগের ২০২০-২১ সিজনে সেরা একাদশে জায়গা করে নেওয়া খেলোয়াড়ের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ ছিল না কোনো, প্রয়োজন ছিল শুধু বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রমাণ করার। সেটি যে তিনি বেশ ভালোভাবেই করেছেন, এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই কারও।
গত সিজনের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গ্রুপ পর্বে ছয় ম্যাচের ছয়টিই জিতেছিল ডাচ ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডাম। সে যাত্রায় নজর কেড়েছিলেন ডিফেন্ডার নাসের মাজরাউই। মৌসুম শেষ হতেই তাই নেদারল্যান্ডসে জন্ম নেওয়া এই ডিফেন্ডারকে টান দিয়ে নিয়ে যায় বায়ার্ন মিউনিখ। এই বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা সোফিয়ান আমরাবাত। ‘মরোক্কান ট্যাংক’ নামে খ্যাতি পেয়ে যাওয়া এই ফুটবলারেরও জন্ম নেদারল্যান্ডসে। মরোক্কান ডিফেন্সের আরেক সৈনিক ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া রোমান সাইস ওলভসের হয়ে এত দিন প্রিমিয়ার লিগ মাতিয়ে যোগ দিয়েছেন তুর্কি ক্লাব বেসিকতাসে।
তারকাখ্যাতি আছে হাকিম জিয়েশেরও। আয়াক্সের হয়ে খেলার সময়ই খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রতিভাবান হিসেবে। তবে চেলসিতে যোগ দেওয়ার পরের গল্পটা শুধুই হতাশার। এ মৌসুমে মাত্র দুটি ম্যাচে ছিলেন তিনি শুরুর একাদশে। তবে বিশ্বকাপে দেশের হয়ে পারফর্ম করছেন দুর্দান্ত। গোল অথবা অ্যাসিস্টের হিসাবে খুব বেশি এগিয়ে না থাকলেও বিশ্বকাপে নজর কাড়ছে তাঁর ফ্রি-কিক। প্রতিটি ফ্রি–কিক যেন বিপক্ষ দলের গোলকিপারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বকাপে ২ গোল করা ইউসুফ এন-নেসিরির জন্ম মরক্কোতে হলেও পুরো খেলোয়াড়ি জীবন পার করেছেন তিনি স্পেনে। প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ ডিফেন্সে কাঁপন ধরানো সোফিয়ানে বোফালের জন্ম ফ্রান্সে। ফ্রান্সের পাশাপাশি ইংল্যান্ড এবং স্পেনের লিগেও খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। এমনকি মরোক্কান কোচ রেগরাগুইয়ের জন্মও ফ্রান্সে।
এই মরক্কো দলের মূল চালিকা শক্তিই বলা চলে এই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন লিগের খেলোয়াড়দের একসঙ্গে ভালো খেলা। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তিনটি বড় দলকে হারিয়েছে মরক্কো—বেলজিয়াম, স্পেন আর পর্তুগাল। বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম থেকে স্পেনের নতুন প্রজন্ম হয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল, কেউই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি মরক্কোর সঙ্গে। ডিফেন্সের দিক দিয়ে তো মরক্কো এবার অনন্য। প্রতিপক্ষ কোনো গোল দিতে পারেনি, যে একটি গোল মরক্কো হজম করেছে, সেটিও ছিল আত্মঘাতী। তাই ফ্রান্স যতই ফেবারিট হোক, ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মরক্কোকে অনেক বেশি পিছিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে অনেক মরোক্কান সমর্থক রওনা দিয়েছেন কাতারের দিকে। মরোক্কান ফুটবলাররাও নিশ্চয় চাইবেন এই সমর্থনের প্রতিদান দিতে। লাল রঙের উৎসবে রাঙিয়ে দিতে চাইবেন তাঁরা কাসাব্লাঙ্কার রাস্তাঘাট।
প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার পর এবার সেমিফাইনালে মরক্কো। রূপকথার এই যাত্রায় প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে ফাইনালে উঠতে বাধা শুধু ফ্রান্স। আইবেরিয়ান উপদ্বীপের প্রতিবেশী দুই দেশ স্পেন আর পর্তুগালকে হারানোর পর এবার প্রতিপক্ষ তাঁদেরই সীমানাঘেঁষা এই দেশ। ব্যাপারটা কি এমন, মরক্কোর বিশ্বজয় শুরু হলো প্রতিবেশীদের দিয়ে আর সেটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাবে বিশ্বব্যাপী?