‘ফুটবল বড় নিষ্ঠুর একটি খেলা। শিরোপা জিততে না পারলে এখানে আপনার কোনো মূল্যই নেই।’ ইতিহাসের নির্মম সত্য সেদিন অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন লেভারকুসেনের তৎকালীন সিইও রেইনার কালমুন্ড। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তিন শিরোপা হারানো দলের প্রধান আর কীই-বা বলতে পারেন! ঠিক কতটা দুর্ভাগা হলে ৫ মৌসুমে তিনটি ভিন্ন টুর্নামেন্টে রানার্সআপের তকমা পেতে হয় কাউকে। ২৮ মৌসুম লেভারকুসেনে কাটিয়েছেন কালমুন্ড, জার্মান লিগ বুন্দেসলিগার প্লেট উঁচিয়ে ধরার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। জার্মানিজুড়ে টিটকারি শুনতে হয়েছে ‘ভিজকুসেন’, ইংরেজিতে ‘নেভারকুসেন’কে। শতবর্ষী এক ক্লাবের ইতিহাসজুড়ে শুধু রুপালি পদক, স্বর্ণালি পদক যেন তাদের চির অধরা।
লেভারকুসেন যে একেবারেই শিরোপা জেতেনি, তা কিন্তু নয়। ১২০ বছরের ইতিহাসে মাত্র দুবার শিরোপা উঁচিয়ে ধরার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের। ইউরোপা লিগ আর জার্মান কাপ জিতলেও বুন্দেসলিগা ছিল লেভারকুসেনের দুঃস্বপ্ন। মাইকেল বালাক, বার্ন্ড শুস্টার, টনি ক্রুস থেকে শুরু করে লুসিও—তারকাভর্তি দল নিয়েও জার্মানির শীর্ষ লিগে তাদের অর্জন শূন্য। শূন্য হলেও হয়তো ভালো ছিল, মনকে অন্তত সান্ত্বনা দেওয়া যেত। কিন্তু তাদের ইতিহাসজুড়ে শুধু তীরে এসে তরি ডোবার উপাখ্যান। শত বছরের সে উপাখ্যানে নতুন মাত্রা যোগ করলেন এক স্প্যানিশ জাদুকর।
অক্টোবর ২০২২। আট ম্যাচে ৫ পয়েন্ট নিয়ে বুন্দেসলিগার রেলিগেশন লড়াইয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে লেভারকুসেন। পত্রপাঠে বিদায় হলেন কোচ, ডাগআউটে ডাক পড়ল সাবেক স্প্যানিশ মিডফিল্ডার জাবি আলোনসোর, যাঁর ঝুলিতে আছে শুধু রিয়াল মাদ্রিদ অনূর্ধ্ব-১৪ আর রিয়াল সোসিয়েদাদ ‘বি’ দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা। আজীবন শিরোপার জন্য লড়াই করা এই সাবেক খেলোয়াড়ের হাতে তুলে দেওয়া হলো অবনমনের শঙ্কায় ধুঁকতে থাকা এক দলের দায়িত্ব।
সোনায় মোড়ানো ক্যারিয়ার বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল আলোনসোর। বাবা ছিলেন ফুটবলার, পেশাদার ফুটবলে অভিষেকটাও তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায়। রিয়াল সোসিয়েদাদ থেকে লিভারপুল, সেখান থেকে রিয়াল মাদ্রিদ হয়ে বায়ার্ন মিউনিখ। খেলোয়াড়ি জীবনে আলোনসো যেখানেই গিয়েছেন, জিতেছেন। জিতবেন নাই-বা কেন? তিনি ছিলেন ফুটবল মাঠের অন্যতম নিখুঁত সেনানী। খেলেছেন বিশ্বসেরা দলে সেরা কোচদের অধীন। রাফা বেনিতেজ, জোসে মরিনিও, কার্লো আনচেলত্তি থেকে শুরু করে পেপ গার্দিওলা কিংবা ভিসেন্তে দেল বস্ক—যেকোনো পরিবেশে, যেকোনো কৌশলে আলোনসো ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। স্প্যানিশ তিকিতাকা থেকে মরিনিওর কাউন্টার অ্যাটাক—সব কৌশলেই অনায়াসে মানিয়ে নিতেন জাবি আলোনসো। মাঝমাঠে এতটাই নিখুঁত ছিলেন যে আনচেলত্তি আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘দ্য প্রফেসর’! আলোনসো ডাগআউটে দাঁড়ালে যে বিপ্লব ঘটবে, সে আন্দাজ আগে থেকেই করেছিলেন অনেকে। কিন্তু ১৪ মাসের মাথায় সেই বিপ্লব নাড়িয়ে দেবে ফুটবল-বিশ্বকে, তা হয়তো ভাবনাতেও ছিল না কারও।
আলোনসোর প্রথম লক্ষ্য ছিল দলকে হারের বৃত্ত থেকে বের করে আনা। প্রতিভার অভাব ছিল না দলে, দরকার ছিল যোগ্য অভিভাবকের। আর সেটা ছিল আলোনসোর মধ্যে। এ কারণে অল্প সময়েই হারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এল লেভারকুসেন। জয়ের ধারা জার্মানি থেকে পৌঁছে গেল ইউরোপেও। মৌসুম শেষ করলেন লিগ টেবিলে ষষ্ঠ আর ইউরোপা লিগের সেমিফাইনাল দিয়ে। নিজের সাবেক কোচের মুখোমুখি না হলে হয়তো প্রথম মৌসুমে ফাইনালের দেখাও পেয়ে যেতেন। মৌসুম শেষেই আলোনসো বসলেন দলকে নতুন করে সাজাতে।
কোচ হিসেবে জাবি আলোনসোর দর্শন খুবই সাধারণ। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখো তো ম্যাচও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নিজেও ছিলেন মাঝমাঠের মায়েস্ত্রো, যে কারণে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঠিক কী কী করা প্রয়োজন, তা খুব ভালোভাবেই জানা ছিল তাঁর। তরুণ তারকাদের নৈপুণ্যে হয়তো ম্যাচ জেতা যায়, কিন্তু শিরোপা জিততে দরকার ধারাবাহিকতা আর অভিজ্ঞতার। তাই ইউরোপ খুঁজে ‘অভিজ্ঞ কিন্তু বিতারিত’ তারকাদের জড়ো করলেন এক ছাদের নিচে। আর্সেনাল থেকে এলেন গ্রানিত শাকা, মনশেনগ্লাডবাখ থেকে জোনাস হফম্যান। তরুণ রবার্ট অ্যানরিখ ফ্লোরিয়ান উইর্টজের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিয়েছেন শাকা-হফম্যানরা। দলে আসতে না আসতেই পুরো মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শাকা।
তবে লেভারকুসেনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন অ্যালেক্স গ্রিমালদো ও জেরেমি ফ্রিমপং। পজিশন অনুযায়ী তাঁদের কাজ দুই উইংয়ের রক্ষণ সামলানো হলেও আলোনসো তাঁদের ছেড়ে দিয়েছিলেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। দুই উইং-ব্যাকের কাছ থেকে এসেছে ৩৪ গোল!
আক্রমণে অভিজ্ঞ প্যাট্রিক শিকের সঙ্গে ছিলেন তরুণ ভিক্টর বনিফেইস। ২৩ বছর বয়সী নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকারের কাছ থেকে এসেছে ১৮ গোল। আলোনসো নিজের স্ট্রাইকারদের কাছ থেকে ঠিক যা চাচ্ছিলেন, সেটাই আদায় করে নিয়েছেন কড়ায়-গন্ডায়।
প্রি-সিজন খেলতে পুরো দল নিয়ে জাবি আলোনসো পাড়ি জমান আল্পস পর্বতমালায়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পাহাড়ি বৈরী পরিবেশে শুরু হয় লেভারকুসেনের ক্যাম্প। কোচের কর্মকাণ্ডে অবাক হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু আলোনসো লক্ষ্যে ছিলেন অটুট, খেলোয়াড়দের প্রয়োজন খুব ভালো করেই জানতেন তিনি। আল্পস পর্বতমালার সেই কঠিন পরিশ্রমের ভিত ছিল হার না মানা মানসিকতা। ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতায় যেখানে শ্বাস নেওয়াই দায়, সেখানে গিয়ে এক সপ্তাহ কাটানো পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল লেভারকুসেনের খেলোয়াড়দের। হারার আগে হার না মানা মানসিকতার সূচনা সেখান থেকেই।
পরের গল্পটা রূপকথার পাতা থেকে তুলে আনা আর দশটা গল্পের মতোই। প্রথম দুই ম্যাচে জয়, অতঃপর তৃতীয় ম্যাচে মুখোমুখি বায়ার্ন। বুন্দেসলিগার সবচেয়ে সফল দলের সামনেও বিন্দুমাত্র টলেনি আলোনসোর শিষ্যরা। ৯৪ মিনিটে গোল করে বায়ার্নের মাটি থেকে ১ পয়েন্ট ছিনিয়ে এনেছে তারা। এখান থেকেই শুরু। মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পরাজয়ের গ্লানি ছুঁতে পারেনি লেভারকুসেনকে। ম্যাচের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, শেষ বাঁশি বাজার পর জাবি আলোনসো তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন মাথা উঁচু করে। এই মৌসুমেই মোট ১৫ ম্যাচে ৯০ মিনিটের পর গোলের দেখা পেয়েছে লেভারকুসেন। ইউরোপা লিগের নকআউট, জার্মান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা বুন্দেসলিগার সাধারণ একটা ম্যাচ—যেকোনো পরিস্থিতিতেই লেভারকুসেন ছিল অটল। মৌসুমের শেষ প্রান্তে এসেও জাবি আলোনসো তাঁর শিষ্যদের নিয়ে তাই অপরাজিত।
জাবি আলোনসো অন্য ধাঁচে গড়ে ওঠা একজন ফুটবলার। ধরাবাঁধা কৌশল তাঁকে কখনোই টানেনি। মাঠে তাঁর বিস্তার ছিল নিজের খেয়ালে। স্প্যানিশ মিডফিল্ড যখন তিকিতাকায় ব্যস্ত, তখন এক লং পাসে তিনি খুঁজে নিতেন ফরোয়ার্ড ফার্নান্দো তোরেসকে। ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে নিষিদ্ধ হয়েও গোল উদ্যাপন করতে গ্যালারি থেকে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আলোনসো। কিন্তু জার্মানদের মতো যান্ত্রিক দেশকে বদলে দেওয়া কি সম্ভব? আলোনসো সেটাকেও সম্ভব করেছেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে পুরো বাংলাদেশ যখন নববর্ষের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন হাজার মাইল দূরে লেভারকুসেনের বে অ্যারেনায় সমর্থকেরা ব্যানার, টিফো, ফ্লেয়ার নিয়ে অপেক্ষায় উদ্যাপনের।
এমন উদ্যাপনের প্রস্তুতি গত তিন দশকে বহুবার নিয়েছে লেভারকুসেনবাসী। কখনো হাতের নাগালে ছিল লিগ শিরোপা, কখনো জার্মান লিগ। ২০০১-০২ মৌসুমে তো হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিল ইউরোপিয়ান ট্রেবল। প্রতিবারই ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাদের। কখনো ১ পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ হারিয়ে, কখনোবা জিনেদিন জিদানের অবিশ্বাস্য গোলের কাছে। জার্মান ফুটবলে রানার্সআপ আর লেভারকুসেন শব্দ দুটো যেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু এবারের গল্পটা ভিন্ন, বহু বছর পর আবারও শিরোপার দ্বারপ্রান্তে লেভারকুসেন। ডাগআউটে ‘সিরিয়াল উইনার’ জাবি আলোনসো আর মাঠে হারার আগে হার না মানা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক লেভারকুসেন।
এর অনেক আগেই অবশ্য ম্যাচের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেছে। ফ্লোরিয়ান উইর্টজের শট জালে জড়াতেই বিশাল বোর্ডে ভেসে উঠল স্কোর—লেভারকুসেন ৫: ভেরডার ব্রেমেন ০। রেফারির বাঁশিকে তোয়াক্কা না করেই দর্শক নেমে এল মাঠে। লাল-কালো পতাকা, ব্যানার আর ফ্লেয়ারে বে অ্যারেনার প্রতিটি প্রান্ত হয়ে উঠল জীবন্ত। খেলোয়াড়েরা হয়ে উঠলেন মহানায়ক, জাবি আলোনসো তাঁদের রাজা। লেভারকুসেন কাব্য যেন মিইয়ে দিল শেক্সপিয়ারের মহাকাব্যকেও।
কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে এল, ‘নেভার সে নেভারকুসেন এভার এভার এগেইন।’ ১২০ বছর ধরে জার্মানির প্রতিটি প্রান্তে টিককিরি শুনতে হয়েছে ‘প্লাস্টিক ক্লাব’ হিসেবে। যাদের ইতিহাসজুড়ে শুধু স্বপ্নভঙ্গের গল্প লেখা। সেই ‘নেভারকুসেন’ আজ চ্যাম্পিয়ন। প্রতিবার তীরে এসে তরি ডোবানোর মন্ত্রে দীক্ষিত সৈন্যরা ঘুরিয়ে দিয়েছে রথের চাকা, ভেঙে দিয়েছে বায়ার্নের আধিপত্য। দীর্ঘ এক যুগ পর বাভারিয়ান ছাড়া কারও হাতে উঠছে বুন্দেসলিগার প্লেট, সেটাও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। রাইন নদীর তীরে এক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির হাতে গড়ে ওঠা ক্লাবটা আজ জার্মানির অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। যেথায় হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো হাজির হয়েছিলেন এক স্প্যানিশ জাদুকর। ‘নেভারকুসেন’কে ‘নেভারলুজেন’ তকমা দেওয়া এক রাজা।