অলিম্পিকের ইতিহাসে কানাকড়ির কড়িমাত্র মূল্য থাকার কথা ছিল না। তবু তিনি অলিম্পিকের ইতিহাসে অমর। তিনি খ্যাতিমান এমন এক কারণে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তিনি যে ম্যারাথন দৌড় শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ করতে তাঁর সময় লেগেছিল অর্ধশতাব্দী মানে ৫০ বছরের বেশি।
জাপানের নাগরিক শিজো কানাকড়ি অনেক কারণে বিখ্যাত। প্রথমত, তিনি জাপানে ম্যারাথন দৌড়কে জনপ্রিয় করে তোলেন। এ কারণে তাঁকে জাপানের ম্যারাথন দৌড়ের জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া তিনি প্রথম জাপানি দৌড়বিদ, যিনি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৯১১ সালে তিনি জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক ম্যারাথনের ট্রায়ালের দৌড় প্রতিযোগিতা জেতেন ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে। সেটা ছিল সে সময়ের বিশ্ব রেকর্ড। কাজেই ১৯১২ সালে তিনি যখন অলিম্পিক ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এসে হাজির হন, তখন তিনি ছিলেন এই ইভেন্টে পদকের অন্যতম দাবিদার।
ছোটবেলায় কানাকড়িকে চার মাইল পথ দৌড়ে স্কুলে যেত হতো। ১৯১১ সালে কানাকড়ি যখন অলিম্পিক ম্যারাথন দৌড়ের যোগ্যতা অর্জন করেন , তখন অনেকে ভেবেছিলেন তিনি হয়তো অলিম্পিক থেকে একটা পদক নিয়ে আসবেন। কিন্তু অলিম্পিকে বিজয়ীরা যখন বিজয়রেখা পার হচ্ছেন, তখন কানাকড়ির দেখা নেই। একে একে যাঁরা দৌড় শেষ করলেন, তাঁদের দলে কানাকড়ির টিকিটি দেখা গেল না। ঘটনাচক্রে সুইডেনেই আর কানাকড়িকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এর ফলে সুইডিশ অলিম্পিক কমিটি কানাকড়িকে নিখোঁজ ঘোষণা করে ও দৌড় শেষ না করার জন্য এক বিশেষ পুরস্কার প্রদান করে। সেটা ছিল বড়সড় একটা কাঠের চামচ। কিন্তু কানাকড়ি তো নেই! তাই সেই পুরস্কারটি এক রাশিয়ানকে দেওয়া হয়, যদি সে কানাকড়িকে খুঁজে পায়, তাহলে উপহারটি যেন তাঁকে পৌঁছে দেয়। সুইডেনে এটা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়। দেশটি এক নিখোঁজ এক বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে কানাকড়ির নাম তালিকায় রেখে দেয়।
১৯৬৭ সালে সুইডেনের এক সাংবাদিক আবিষ্কার করেন যে কানাকড়ি জাপানের এক স্কুলের শিক্ষক। সেখানে তিনি ছাত্রদের ভূগোল পড়ান। যখন সাংবাদিক কানাকড়িকে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, তখন ব্যথিত কানাকড়ি জানান, তিনি সেদিন সেই দৌড় শেষ করতে পারেননি, মাঝপথে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিয়ে সুইডেনের এক ব্যক্তির বাগানে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি ওই ব্যক্তির দেওয়া পার্টিতে কমলার রস পান করে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠে লজ্জিত কানাকড়ি কাউকে কিছু না বলেই গোপনে সুইডেন ত্যাগ করেন।
সেবার সেই অলিম্পিক ম্যারাথন তীব্র দাবদাহের মধ্যে শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এক ডজনের বেশি প্রতিযোগিতার মাঝপথে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেন। আর একজন প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতার মাঝখানে মৃত্যুবরণ করেন, যেটা অলিম্পিক গেমে প্রথম কারও মৃত্যুবরণের ঘটনা।
অন্যদিকে সুইডেনে যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কানাকড়িকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এরপর এক দীর্ঘ কষ্টদায়ক যাত্রায় তিনি আরও পরিশ্রান্ত হয়ে সুইডেনে এসে হাজির হন। এরপর সেখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পারা কানাকড়ি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিলেন না। এ কারণে তিনি সেবার অলিম্পিক ম্যারাথন দৌড় শেষ করতে ব্যর্থ হন। এই লজ্জায় তিনি কাউকে কিছু না বলে সুইডেন ত্যাগ করেন।
১৯৬৭ সালে সুইডেনের এক টেলিভিশন চ্যানেল কানাকড়িকে সেই ম্যারাথন দৌড় শেষ করার প্রস্তাব দিলে কানাকড়ি রাজি হয়ে যান। ২০ মার্চ ১৯৬৭ সালে তিনি সেই দৌড় শেষ করেন, যা তিনি ১৯১২ সালে শুরু করেছিলেন। আর এই দৌড় শেষ করতে কানাকড়ির সময় লেগেছিল ৫৪ বছর ৮ মাস ৬ দিন ৫ ঘণ্টা ৩২ মিনিট ২০.৩ সেকেন্ড মাত্র।
দৌড় শেষ করার পর কানাকড়ি বলেছিলেন, ‘আমি এই দৌড় শেষ করেছি। কারণ, এটি শেষ করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। শেষ করতে অনেক লম্বা সময় লেগে গেছে। যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমি ছিলাম একা। এখন আমার গিন্নি আছেন, আছেন আমার ৬ সন্তান, আর ১০ জন নাতি–নাতনি।’
হ্যাঁ, এ জন্য তিনি কোনো অলিম্পিক পদক না পেলেও গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করতে পেরেছেন এ কারণে যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় নিয়ে ম্যারাথন রেস শেষ করা দৌড়বিদ। যে রেকর্ড আর কেউ কোনো দিন ভাঙতে পারবে বলে মনে হয় না।