বিশ্বকাপের গান

এ মাসের ২০ তারিখ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর। প্রথম ম্যাচে ইকুয়েডরের মুখোমুখি হবে স্বাগতিক দেশ কাতার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল উৎসব উপলক্ষে ইতিমধ্যে অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক বা থিম সং প্রকাশ করেছে ফিফা। বিশ্বকাপের থিম সং নিয়ে সব সময়ই আগ্রহ থাকে দর্শকদের। কবে আসবে থিম সং, কে বা কারা গাইবে—এ নিয়ে চলে নানা জল্পনাকল্পনা। সাধারণত প্রতি বিশ্বকাপের আগে একটি করে থিম সং প্রকাশ করে ফিফা। এবার প্রকাশিত হয়েছে তিনটি গান। বিশ্বকাপের আগে আরও একটি বা দুটি গান প্রকাশিত হবে—এমন গুঞ্জনও আছে।

বিশ্বকাপ নিয়ে মানুষের উন্মাদনা আরও বাড়াতেই থিম সং প্রকাশ করে ফিফা। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয়েছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় এ আয়োজন। তবে প্রথম বিশ্বকাপ থেকে অবশ্য ছিল না থিম সংয়ের প্রচলন। ১৯৬২ সালে চিলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অফিশিয়াল থিম সং প্রকাশ করে ফিফা। তারপর থেকে ফিফার অফিশিয়াল থিম সং আসতে থাকে প্রতিটি বিশ্বকাপের আগেই।

অন্য বিশ্বকাপগুলোর মতো এ বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের জন্যও গান প্রকাশ করেছে ফিফা। অন্য বিশ্বকাপগুলোতে ‘থিম সং’ বা ‘ওয়ার্ল্ড কাপ সং’ বললেও এবার ফিফা গান প্রকাশ করছে ‘অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক’ নামে। সাধারণত প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে একটি করে গান প্রকাশিত হলেও এবার প্রকাশিত হয়েছে তিনটি গান। এ বছরের ১ এপ্রিল প্রকাশিত হয় এই বিশ্বকাপের প্রথম অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক, যার নাম ‘হায়া হায়া (বেটার টুগেদার)’। গানটি তৈরির জন্য তিন ঘরানার তিনজন সংগীতশিল্পীকে এক ছাদের নিচে নিয়ে এসেছিল ফিফা। মার্কিন গায়ক ত্রিনিদাদ কার্দোনা, জাপানি গায়িকা আইশা এবং নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন গায়ক ডেভিড আদেদেজি মিলে তৈরি করেছেন গানটি। প্রকাশের পর থেকেই সমালোচক ও শ্রোতাদের কাছ থেকে গানটি পেয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ইতিমধ্যে ইউটিউব সব বিভিন্ন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে গানটির ভিউ ৩০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।

‘হায়া হায়া’ গানটি প্রকাশের চার মাস পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিফা প্রকাশ করে কাতার বিশ্বকাপের আরেকটি অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক ‘আরবো’। গানটি গেয়েছেন পুয়ের্তোরিকান শিল্পী ওজুনা এবং কঙ্গো বংশোদ্ভূত ফরাসি র‌্যাপার গিমস। প্রকাশের পর সমালোচক ও শ্রোতাদের কাছ থেকে বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে গানটি, অনেকেই গানটিকে বলছেন এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে ভালো গান।

দুটি অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক প্রকাশের পর সবাই ভেবেছিল আর বোধ হয় কোনো গান আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ফিফার চমক তখনো বাকি। গত ৭ অক্টোবর ফিফা প্রকাশ করে কাতার বিশ্বকাপের তৃতীয় অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক, ‘লাইট ইন দ্য স্কাই’। এই গানটির জন্য তারকাদের একপ্রকার মেলাই বসিয়েছে ফিফা। মরোক্কান বংশোদ্ভূত বলিউড অভিনেত্রী নোরা ফতেহী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বালকিস আহমেদ ফাতহী, ইরাকের রাহমা রিয়াদ এবং মরোক্কোর মানাল বেঞ্চলিখা—এই চারজন নারী শিল্পী মিলে তৈরি করেছেন গানটি। গানটিতে শুধু ইংরেজিই নয়, ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দি ও মরোক্কান ভাষাও, যা গানটিতে যোগ করেছে এক বাড়তি মাত্রা।

বিশ্বকাপের এখনো বাকি আরও প্রায় এক মাস। এই সময়ে যদি ফিফা আরও একটি বা দুটি অফিশিয়াল সাউন্ডট্র্যাক প্রকাশ করে, তাহলে এখন আর অবাক হবে না কেউই।

কাপ অব লাইফ—রিকি মার্টিন (বিশ্বকাপ ১৯৯৮)

কাপ অব লাইফ—রিকি মার্টিন (বিশ্বকাপ ১৯৯৮)১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ফ্রান্সে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে থিম সং মুক্তি দেয় ফিফা। পুয়ের্তোরিকান শিল্পী রিকি মার্টিনের গাওয়া গানটির নাম ‘কাপ অব লাইফ’। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে যায় গানটি। দারুণ ছন্দ আর তালের মিশেলে গাওয়া গানটির জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে যান রিকি মার্টিনও। ‘কাপ অব লাইফ’-এর জন্যই সে বছরের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে পারফর্ম করার আমন্ত্রণ পান এই পপ তারকা। চমৎকার এ গানের মাধ্যমেই মূলত বিশ্বকাপের থিম সং নিয়ে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এর পর থেকে প্রতি বিশ্বকাপের আগে থিম সংয়ের জন্য মানুষের অপেক্ষার শুরু।

ওয়াকা ওয়াকা, দিস টাইম ফর আফ্রিকা—শাকিরা এবং ফ্রেশলি গ্রাউন্ড (২০১০)

বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার প্রায় ৮০ বছর হয়ে গেলেও আয়োজক হতে পারেনি আফ্রিকার কোনো দেশ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আফ্রিকার মাটিতে বিশ্বকাপের আসর বসে ২০১০ সালে। আয়োজকেরা ভাবলেন, এবার এমন একটি গান তৈরি করতে হবে, যে গানে ফুটবলের পাশাপাশি উঠে আসবে আফ্রিকার ঐতিহ্য।

গানটির জন্য বেছে নেওয়া হলো বিখ্যাত পপসংগীতশিল্পী শাকিরাকে। কিন্তু শাকিরা কলম্বিয়ান। অনেকে সন্দিহান ছিলেন, আদৌ তিনি আফ্রিকার মানুষের কথা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন কি না । কিন্তু সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য সব প্রস্তুতিই নেন শাকিরা। গান তৈরির জন্য যুক্ত হন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যান্ড ফ্রেশলি গ্রাউন্ডের সঙ্গে। শাকিরা এবং ফ্রেশলি গ্রাউন্ড—ভিন্ন ঘরানার দুই শিল্পীর মিশেলে তৈরি হয় ২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলের থিম সং। তর্ক সাপেক্ষে যেটিকে বলা হয় এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান, ‘ওয়াকা ওয়াকা—দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। মুক্তি পাওয়ার প্রায় ১২ বছর হয়ে গেলেও এখনো তুমুল জনপ্রিয় গানটি। এ বছরের শুরুর দিকেই ইউটিউবে স্পর্শ করেছে তিন বিলিয়ন ভিউয়ের মাইলফলক।

উই আর ওয়ান, ওলে ওলা—পিটবুল, জেনিফার লোপেজ ও ক্লদিয়া লেইতে (২০১৪)

ফুটবলের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার সম্পর্কই আলাদা। এ মহাদেশের মানুষেরা শুধু ফুটবল খেলে তা নয়, ফুটবল উদ্‌যাপন করে, ফুটবলেই বাঁচে। সেই দক্ষিণ আমেরিকায় ২৬ বছর পর আবার ফেরে বিশ্বকাপ ফুটবল।

১৯৫০ সালের পর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ব্রাজিলে আবারও বেজে ওঠে বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০১০ বিশ্বকাপের থিম সংয়ের মতো আবারও বিশেষ কিছু করতে চাইল ফিফা। ফলে এ বিশ্বকাপের থিম সং তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় জনপ্রিয় মার্কিন র‌্যাপার পিটবুল, পপশিল্পী জেনিফার লোপেজ এবং ব্রাজিলিয়ান সংগীতশিল্পী ক্লদিয়া লেইতে। তিনজন যৌথভাবে তৈরি করেন ফুটবল বিশ্বকাপের অন্যতম জনপ্রিয় থিম সং, ‘উই আর ওয়ান, ওলে ওলা।’

বিশ্বকাপ ফুটবলের অন্যান্য গান

ফিফার অফিশিয়াল থিম সং ছাড়াও বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় অনেক শিল্পী, প্রতিষ্ঠানই মেতে ওঠে উৎসবে। নিজেদের উদ্যোগে বিশ্বকাপ নিয়ে গান প্রকাশ করেন তাঁরা। যেমন কেনান। ২০১০ বিশ্বকাপের সময় তাঁর গাওয়া ওয়েভিং ফ্ল্যাগ ছাড়িয়ে যায় ফিফার অফিশিয়াল থিম সংকেও। শাকিরা এবং ফ্রেশলি গ্রাউন্ডের গাওয়া ‘ওয়াকা ওয়াকা’ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও ‘ওয়েভিং ফ্ল্যাগ’ ছড়িয়ে পড়ে আরও বেশি।

সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান সংগীতশিল্পী কেনানের গাওয়া গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। দীর্ঘদিন ধরে সোমালিয়ায় সংঘটিত হয়ে আসা গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গানটি লেখেন কেনান। ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপের আগে কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘কোকাকোলা’ নিজেদের প্রচারণার জন্য বেছে নেয় গানটিকে। কোকাকোলার অনুরোধে গানটিকে নতুন করে রেকর্ড করেন কেনান। নতুন করে গানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পুরো তোলপাড় শুরু হয়ে বিশ্বে। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গানটি। ‌‘ওয়েভিং ফ্ল্যাগ’ এতই জনপ্রিয় হয় যে অনেকে এখনো এই গানটিকে ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপের থিম সং ভেবে ভুল করেন।

এ ছাড়া ২০১০ বিশ্বকাপের থিম সং গাওয়া শাকিরা ২০১৪ বিশ্বকাপ উপলক্ষে নিজেই ‘লা লা লা’ নামের একটি গান প্রকাশ করেন। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে যায় গানটি নিয়ে। ইউরোপসহ পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় গানটি। অর্জন করে সমালোচকদের প্রশংসাও। বিশেষ করে পিটবুল, জেনিফার লোপেজ ও ক্লদিয়া লেইতের গাওয়া ২০১৪ বিশ্বকাপের অফিশিয়াল থিম সংটির চেয়ে শাকিরার ‘লা লা লা’ গানটি বেশি ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভক্ত মনে করেন, মূল থিম সংয়ের চেয়ে শাকিরার গানেই ভালোভাবে ফুটে উঠেছে ব্রাজিলের ঐতিহ্য।