একজন খেলোয়াড়কে নতুন দলে স্বাগত জানানো হয় কীভাবে? কেউ নিজেদের স্টেডিয়ামে হাজারো মানুষের সামনে জার্সি চড়িয়ে দেন গায়ে। কেউ আবার উদ্যাপন করে শহরজুড়ে। পুরো শহর একত্র হয়ে স্বাগত জানায় নতুন খেলোয়াড়কে। রিয়াল মাদ্রিদ দুটোই করেছে, শহরজুড়ে উন্মাদনা কিংবা মাঠভর্তি দর্শক—সবটাই মাদ্রিদের বড্ড চেনা। তাই রিয়াল একটু ভিন্ন পথেই হাঁটল এবার। জুড বেলিংহামকে রিয়াল পরিচয় করিয়ে দিল গানের সঙ্গে, কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’-এর ‘হেই জুড’ গানের লাইন যখন টুইট করল রিয়াল, তখন আর বুঝতে বাকি থাকল না জুড আসছেন। বহু প্রতীক্ষার পর রিয়ালে আসছেন নতুন কোনো তারকা।
রিয়াল মাদ্রিদের জন্য জুড বেলিংহাম ছিলেন ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। গত কয়েক মৌসুম ধরেই দলবদলে সুবিধা করতে পারছে না রিয়াল। এমবাপ্পের জন্য লড়াই করে পারেনি, হলান্ডও অনেকটা হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছেন। বলতে গেলে দলবদলের মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় ছিনিয়ে আনার যে শক্তি ছিল, তার অনেকটাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। রিয়ালের জন্য জুড বেলিংহাম তাই ছিলেন প্রথম পছন্দ।
তাঁকে পাওয়ার জন্য টাকার বস্তা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল লিভারপুল আর ম্যানচেস্টার সিটি। বেলিংহামের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ, নিয়মিতই যোগাযোগ রক্ষা করতেন সিটি কোচ পেপ গার্দিওলাও। এমনকি সিটি খেলোয়াড় আরলিং হলান্ডকে দিয়ে নিয়মিতই চেষ্টা চালাতেন, যাতে কোনোভাবে বেলিংহামকে দলে ভেড়ানো যায়। কিন্তু রিয়াল ছিল লক্ষ্যে অটুট, বেলিংহামের নতুন জার্সি মেরুন কিংবা আকাশি নয়, হবে সাদা।
আর সে কারণেই সব চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরও প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছে রিয়াল। নিজেদের নতুন জার্সি উদ্বোধন করেছে, এরপর এসেছে ঘোষণা—‘বেলিংহাম আসছেন’। স্বর্ণালি সাদা জার্সি গায়ে চড়িয়েই বেলিংহাম ঘোষণা দিলেন, তিনি এসেছেন থাকতে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে।
স্বপ্ন পূরণই তো। বেলিংহাম বড় হয়েছেন জিনেদিন জিদানকে নায়ক ভেবে। সাদা জার্সিতে মাঠ মাতাতেন জিনেদিন জিদান, হালকা ছোঁয়ায় নাস্তানাবুদ করতেন প্রতিপক্ষকে; টিভি পর্দায় তা দেখেই বেলিংহাম স্বপ্ন দেখতেন। একদিন জিদানের মতো খেলবেন, জিদানের জার্সি গায়ে মাঠে নামবেন, মাতাবেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। তাঁর আর জিদানের মধ্যে পার্থক্য থাকবে শুধু জার্সির ওপরের নামটা।
সে লক্ষ্যেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন বেলিংহাম। খেলার ধরন থেকে শুরু করে পজিশন, সবটাই জিদানের মতো। বাকি ছিল জার্সিটা। সেটাও পূরণ হয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ আর হেসুস ভালেহোর সৌজন্যে। গত মৌসুমে জিদানের ‘৫’ নম্বর জার্সিটা ছিল ভালেহোর গায়ে। বিনা বাক্য ব্যয়ে সেই জার্সি বেলিংহামকে দিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছোটবেলার স্বপ্নটা পূরণ হলো ১৯ বছর বয়সে এসে।
স্বপ্ন পূরণ তো অনেকেরই হয়, কিন্তু স্বপ্ন জয় করতে পারেন কজন? এই যেমন এডেন হ্যাজার্ডের কথাই ধরো। রিয়াল মাদ্রিদে খেলার স্বপ্ন পূরণ করেছেন, অথচ স্বপ্নটা আর জয় করা হয়ে ওঠেনি। চোট, স্বাস্থ্যের অবনতি, বাজে ফর্ম মিলিয়ে চুক্তি শেষ করার আগেই রিয়াল মাদ্রিদকে বিদায় বলেছেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের সবচেয়ে দামি ভুল হয়ে রইলেন তিনি। জুড বেলিংহামের দামটাও কিন্তু সে রকমই চড়া। ১০৩ মিলিয়ন ইউরো, টাকার মূল্যে যা দাঁড়ায় প্রায় ১২১৬ কোটি টাকা! এই টাকার পুরোটা যদি উসুল করতে না পারেন, তবে রিয়ালের স্বপ্নটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে জুডের জন্য।
ইতিহাসও খুব একটা পক্ষে নেই তাঁর। ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের স্পেন মাতানোর ইতিহাস হাতে গোনা বললেও ভুল হবে। রিয়াল মাদ্রিদে তো আরও নয়। হাতে গুনে মাত্র ৬ জন ইংলিশ খেলোয়াড় গায়ে জড়িয়েছেন রিয়ালের জার্সি। এক ডেভিড বেকহাম বাদে কারও ইতিহাসই সুখকর নয়। শুধু রিয়াল মাদ্রিদ কেন, ইংল্যান্ডের বাইরে ইংলিশ খেলোয়াড়দের ইতিহাসও খুব একটা ভালো নয়। জুডের সামনে সুযোগ ছিল লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘরে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটিকে ‘না’ বলে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন স্পেনে। লক্ষ্য একটাই, স্বপ্নপূরণ।
স্কুলে থাকতে ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ প্রশ্নে বেলিংহাম গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, বড় হয়ে ফুটবলার হতে চাই। বড় তাঁকে হতে হয়নি, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অভিষেক হয়েছিল তাঁর। বার্মিংহাম সিটির আশা-ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন ১৭ ছোঁয়ার আগেই। এমনও দিন গেছে, পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে সোজা ছুটেছেন মাঠে। দলকে জিতিয়ে পরদিন আবারও বসেছেন পরীক্ষায়। বার্মিংহাম ছিল তাঁর প্রথম ভালোবাসা, ফুটবলের চেয়েও বহুগুণে ভালোবাসতেন তিনি এই ক্লাবটাকে। তাই তো যখন দেনার দায়ে জর্জরিত ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়; এগিয়ে আসেন জুড। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তাঁকে কিনে নেয় বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। তাঁর দলবদল থেকে যুক্ত হওয়া ৩০ মিলিয়ন ইউরো দিয়েই নিজেদের ক্লাব বাঁচিয়ে রাখে বার্মিংহাম। আর আজীবনের মতো তুলে রাখে তাদের ২২ নম্বর জার্সিটি।
স্বপ্ন ডানা মেলেছে ডর্টমুন্ডে যোগ দিয়ে। ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে চড়েছে, গোল করেছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। বুন্দেসলিগার সেরা তরুণ তারকা, ডর্টমুন্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা আর একটুর জন্য বায়ার্নকে হারিয়ে শিরোপা না জিততে পারার আক্ষেপ; হলুদ জার্সিতে সবটাই দেখেছেন তিনি।
রিয়াল মাদ্রিদে তাঁর দায়িত্বটা আরও বড়। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তাঁর হাতে সঁপে দেওয়া হচ্ছে মাদ্রিদের মাঝমাঠের চাবি। রিয়ালের বিখ্যাত ‘কেসিএম’ ত্রয়ী ভেঙে গিয়েছে গত মৌসুমেই। ম্যানচেস্টারের উদ্দেশে দল ছেড়েছেন কাসেমিরো, ক্রুস-মদ্রিচও তাঁদের শেষবেলায়। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের বিশেষ অনুরোধে আরও এক বছর রিয়ালে থাকছেন দুই মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো। পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর বয়স এখন আর নেই তাঁদের। দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের হাতে রিয়ালের মাঝমাঠের বাটন তুলে দিয়ে যাওয়া। বেলিংহামের কাজ এখন সেটাই। মদ্রিচের কাছ থেকে মাঝমাঠের প্রতিটি খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়া, সে দায়িত্ব পালন করতেই ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা তাঁর পেছনে ঢেলেছে রিয়াল।
বার্মিংহাম কিংবা বরুশিয়া থেকে মাদ্রিদ বহুগুণে আলাদা। বার্মিংহাম কিংবা বরুশিয়া, কোথাও তাঁর প্রত্যাশার পারদ এতটা ওপরে ছিল না। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ তেমন নয়, এখানে সবাই আসে স্বপ্ন নিয়ে। সে স্বপ্ন পূরণে সামান্য হোঁচট খেলে দ্রুতই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। বেলিংহাম সবটাই জানেন, বোঝেন। এখন দেখার বিষয় স্বপ্ন কত পথ পাড়ি দিতে পারে।