শেষ হয়েছে ফুটবলের শীতকালীন দলবদলের মৌসুম। এবারের দলবদল নিয়ে বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ ছিল একটু বেশি। কারণ, বাংলাদেশি তারকা হামজা চৌধুরীকে নিয়ে বেশ টানাহেঁচড়া হয়েছে ইংলিশ লিগে। অবশেষে লেস্টার সিটি ছেড়ে শেফিল্ড ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন এই তারকা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হলো তাঁর?
শীতকালীন মৌসুমে সবচেয়ে বড় দলবদল কি তবে এটাই? অন্তত বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের চোখে তো অবশ্যই। হামজা চৌধুরীর কল্যাণে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে নিয়মিত উড়ছে বাংলাদেশি পতাকা। সেই হামজা চৌধুরী যখন দলবদল করেন, তখন সেটা হয়ে উঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। প্রিমিয়ার লিগজয়ী দল লেস্টার সিটি ছেড়ে ধারে যোগ দিয়েছেন শেফিল্ডে ইউনাইটেডে। যারা এই মৌসুমে খেলছে ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ চ্যাম্পিয়নশিপে। নিজের বেড়ে ওঠা, প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ সারির ক্লাব ছেড়ে দ্বিতীয় সারির ক্লাবে যোগ দেওয়া কি উচিত হলো হামজার?
লেস্টারের সঙ্গে হামজার সম্পর্ক একেবারে ছোটবেলা থেকেই। ফুটবলে হাতেখড়ি থেকে শুধু করে বয়সভিত্তিক দল, শিরোপা থেকে শুরু করে অধিনায়কত্ব; ফুটবল ক্যারিয়ারে ঠিক যা যা অর্জন, সবটাই হামজা অর্জন করেছেন লেস্টারের নীল জার্সি গায়ে চড়িয়ে। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে লেস্টারের মূল দলের অংশ তিনি। তবে লেস্টারের ঘরের খেলোয়াড় হলেও হামজা চমক দেখিয়েছেন ঘরের বাইরে। বার্টন আলবিয়নের জার্সিতে দুই মৌসুম অসাধারণ পারফর্ম করার পর জায়গা নিশ্চিত করেন লেস্টার দলে। কয়েক মৌসুমের ব্যবধানে আবারও পাঠানো হয় ধারে, এবার গন্তব্য ওয়াটফোর্ড। হামজার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম ছিল সেটি। চ্যাম্পিয়নশিপ টেবিলে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় উত্থান এই সময়েই। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ইংলিশ কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডারের। মৌসুম শেষে চুক্তি না বাড়ানোয় ওয়াটফোর্ডে আর থাকা হয়নি তাঁর। কিন্তু লেস্টারে ফিরে এবার আর বেঞ্চে নয়। সরাসরি জায়গা করে নিয়েছেন মূল একাদশে। ইতালিয়ান কোচ এনজো মারেসকার অধীনে রীতিমতো তারকা হয়ে উঠেছিলেন হামজা। নিয়মিত হয়ে উঠেছিলেন একাদশে, উইলফ্রেড এনদিদির সঙ্গে মিলে লেস্টারের মাঝমাঠে তুলে দিয়েছিলেন দেয়াল। চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর সকলেই ভেবেছিল, ঘরের ছেলে বুঝি ঘরের একাদশে থিতু হবেন।
কিন্তু সে আশায় বাগড়া দিল চেলসি। শিরোপা জিতিয়ে দলকে প্রিমিয়ার লিগে তুলে বিদায় নিলেন কোচ এনজো মারেসকা। আর দলে ব্রাত্য হয়ে পরলেন হামজা। নতুন কোচ স্টিভ কুপার আসার পর দলে তাঁর জায়গা হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। টটেনহাম থেকে যোগ দেওয়া অলিভার স্কিপ ও উইলফ্রেড এনদিদি জুটির ওপর ছিল কোচের ভরসা। মৌসুমের শুরু থেকেই হামজার জায়গা তাই বেঞ্চে। একদিকে দলের অতি জঘন্য পারফরম্যান্স, অন্যদিকে বেঞ্চ গরম করা—দুয়ে মিলে নিজেকে প্রমাণ করার কোনো সুযোগই পাচ্ছিলেন না তিনি। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে বরখাস্ত হলেন স্টিভ কুপার, যোগ দিলেন রুড ফন নিস্টলরয়। তাতেও ভাগ্য বদলাল না। এরই মধ্যে পেয়ে গেলেন বাংলাদেশে খেলার অনুমতি। মুহূর্তেই খেলার নতুন মোড় দেখা শুরু করলেন হামজা।
একজন খেলোয়াড়ের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিয়মিত ম্যাচ খেলা। বিশেষ করে হামজা এখন যে বয়সে আছেন, এই সময়টাকে ধরা হয় খেলোয়াড়দের সেরা সময়। এই সময়ে খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেরা ফর্মে থাকেন, এত বছর ধরে শিখে আসা স্কিল কাজে লাগান। এই বয়সটা যদি বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়, তবে তা খেলোয়াড়ের নিজের জন্যই খারাপ। তবুও এমন যদি হতো যে দল ভালো করছে, তাই সুযোগ পাচ্ছেন না। ব্যাপারটি তেমনও নয়। টানা হারের পরও মূল একাদশে সুযোগ মিলছে না তাঁর। একাদশে ছিলেন মাত্র ৩ ম্যাচে। ৩ ম্যাচে নেমেছেন বেঞ্চ থেকে। অর্ধেক মৌসুম শেষ সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৬ ম্যাচে! এমনিতেই নতুন একটা চ্যালেঞ্জ মাথায় ওপরে, এমন সময় যদি বেঞ্চেই বসে থাকতে হয়; তাহলে কেমন দেখায়? সব মিলিয়ে সিদ্ধান্তটা বেশ সহজই ছিল হামজার জন্য।
তবে হামজার জন্য সিদ্ধান্তটা আরও সহজ করে দেন ক্রিস ওয়াইল্ডার। ওয়াটফোর্ডে যার অধীনে পাখা মেলেছিলেন হামজা, তিনিই এবার সামলাচ্ছেন শেফিল্ড ইউনাইটেডের ডাগআউট। প্রিয় কোচের একটা ফোন কল যথেষ্ট ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এক কথায় রাজি হয়ে যান হামজা। শীতকালীন দলবদলের একদম শেষ সময়ে এসে শেফিল্ড ইউনাইটেডে যোগ দেন হামজা। তবে পাকাপাকিভাবে না। ছয় মাসের জন্য ধারে যোগ দেবেন হামজা। তবে শেফিল্ড চাইলে ছয় মাস শেষে তাকে কিনেও নিতে পারবে। ফলে সুযোগটা হামজার কাছেই থাকছে।
শেফিল্ড হামজাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশি ব্লেড হিসেবে। আর বাংলাদেশি ব্লেড যে কতটা ভয়ানক, তার প্রমাণ মিলেছে প্রথম ম্যাচেই। প্রিয় শিষ্যকে দলে পেয়ে অভিষেক করাতে দেরি করেননি কোচ ওয়াইল্ডার। আর হামজা তার প্রমাণ দিয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে। কোনো গোল করেননি, অ্যাসিস্টও করেননি। পুরো ৯০ মিনিটে জিতেছেন তিনটি ট্যাকেল, ১টি অ্যারিয়াল ট্যাকেল। একমাত্র গোলের পর প্রতিপক্ষের আক্রমণ আটকে রেখেছিলেন কার্যত একাই। নতুন পরিবেশে গিয়ে শুরুটাই করেছেন জয় আর একটা ক্লিন শিট দিয়ে। অর্ধেক মৌসুম ধরে লেস্টারে যে সুযোগটা খুঁজছিলেন, সেটাই পেলেন শেফিল্ডে। আর যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন লেস্টারকে, কী মিস করছিল তারা।
এই জয় দিয়ে শেফিল্ডও পৌঁছে গিয়েছে ভালো অবস্থানে। ৩০ ম্যাচ শেষে ৬১ পয়েন্ট নিয়ে তারা আছে লিগের তৃতীয় অবস্থানে। শীর্ষ দুইয়ে থেকে লিগ শেষ করতে পারলে পরের মৌসুমে আবারও প্রিমিয়ার লিগ খেলার সুযোগ আসবে হামজার। অন্যদিকে অবনমনের সারিতে ঘুরপাক খাওয়া লেস্টার হোঁচট খেলে তারা নেমে আসবে চ্যাম্পিয়নশিপে। বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিতে খেলার কঠিন চ্যালেঞ্জ হামজার সামনে। তার আগে দলকে নিয়ে একটা ভালো অবস্থানে থাকা, নিয়মিত খেলার মধ্যে থেকে নিজেকে উদ্বুদ্ধ রাখা; সবমিলিয়ে শেফিল্ডে যোগ দেওয়া হামজার জন্য একটা স্টেপ-আপই বটে!