ব্যাটসম্যান না বোলার—বিশ্বকাপে এবার কাদের আধিপত্য

ক্রিকেট বরাবরই গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ব্যাট-বলের খেলায় প্রতি পরতে লুকিয়ে থাকে রোমাঞ্চ। তাই বড় মঞ্চে মাঠে নামার আগে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন উঁকি দেয় সবার মনে। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে কার হতে চলেছে জয়? না, প্রশ্নটা দলগুলোর দিকে নয়, বরং ব্যাট ও বলের দিকে। প্রতি বিশ্বকাপেই অদেখা একটা লড়াই চলে ব্যাটসম্যান ও বোলারদের মধ্যে। বিশ্বকাপজুড়ে কাদের আধিপত্য বেশি থাকবে, তা নিয়ে চলে আলোচনা। কোনো বিশ্বকাপে পিচ থেকে ব্যাটসম্যানরা বেশি সুবিধা আদায় করেন, আবার কোনো বিশ্বকাপে বোলাররা।

গত কয়েক বিশ্বকাপের দিকে একটু ফিরে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে বিষয়টি। ২০১৯ বিশ্বকাপের ফরম্যাট ছিল এবারের মতোই। ৪৮ ম্যাচে ৩০০–এর ওপরে ইনিংস ছিল ২৭টি! ১০০–এর নিচে ইনিংস ছিল না একটিও। এমনকি ২০০ রানের নিচে ইনিংস ছিল মাত্র হাতে গোনা ১২টি। ২০ ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে সেঞ্চুরি এসেছে ৩১টি। ২২ হাজার ৪১২ রানের বিশ্বকাপে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য। ইংল্যান্ডের পিচে বোলাররা সুবিধা পাননি, তা বললে ভুল হবে। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তা যৎসামান্যই। বাকি সব বিশ্বকাপের চেয়ে বেশি রান রেট (৫.৫৯), বোলিং গড় (৩৩.৩১) ছিল এই বিশ্বকাপেই। এমনকি আধুনিক বিশ্বকাপের তুলনায় সবচেয়ে কম উইকেটও পড়েছিল এই বিশ্বকাপে, মাত্র ৬৭৩টি।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০১৫ বিশ্বকাপ তা-ও কিছুটা সমতা বজায় রাখতে পেরেছিল নিজেদের মধ্যে। রানের ফুলকি ছুটলেও বোলিংয়ে ছিল সমতা। প্রথমে গ্রুপ ও পরে নকআউট পর্বে হওয়া বিশ্বকাপে ম্যাচ হয়েছিল ৪৯টি। এর মধ্যে ৩০০–এর বেশি ইনিংস ছিল ২৮টি। তিনবার রান ছাড়িয়েছিল ৪০০-এর কোটা। ১০০–এর নিচে ইনিংস না থাকলেও ২০০-এর নিচে ইনিংস সংখ্যা ছিল ৩১টি! সেবারই প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পায় বিশ্বকাপ। একবার নয়, দুবার ভেঙেছে সেই রেকর্ড। তবে বোলিংয়েও ছিল একই রকম সমতা। ২৩ হাজার ৫৩১ রানের বিপরীতে উইকেট পড়েছে মোট ৭১৫টি। ৭ বার ৫ উইকেট পেয়েছেন বোলাররা। উইকেটপ্রতি রানও ছিল তুলনামূলক কম (৩২.৯১)।

২০১৫ বিশ্বকাপে ২টি সেঞ্চুরি করেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
ছবি: আইসিসি

আরও পেছনে ফেরা যাক, ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপের আসর। ২০১১ সালেও গ্রুপ পর্বের পর নকআউট পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপ। সেবার ৪৯ ম্যাচে ৩০০ রান ছুয়েছিল ১৭ বার। আর ১০০ রানের নিচে ইনিংস শেষ হয়েছিল পাঁচবার। যদিও পাঁচটি ইনিংসই ছিল বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মাটিতে। রানে পিছিয়ে থাকলেও উইকেটের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল ২০১১ বিশ্বকাপ। ২১ হাজার ৩৩৩ রানের বিনিময়ে বোলাররা তুলে নিয়েছিলেন ৭৩১টি উইকেট। সেঞ্চুরির সংখ্যাও বেশ কম, মাত্র ২৪টি।

প্রতিটি বিশ্বকাপের পরিসংখ্যানে একবার নজর বোলালেই বুঝতে পারবে, বিশ্বকাপ ঠিক কোন পথে হেঁটেছে। ২০০৭ সাল থেকেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ক্রিকেট–বিশ্ব। নতুন যুগের এই ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানের দামই সবচেয়ে বেশি, বোলারদের জায়গা সেখানে যৎসামান্যই। একটা সময় ছিল যখন ক্রিকেট মানেই আধিপত্য শুধু বোলারদের। বিখ্যাত বডি লাইন সিরিজ কিংবা বিশ্বকাপের প্রথম দিকের আসরগুলো; বোলারদের আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, ততই হারিয়ে যেতে শুরু করেছে বোলারদের আভিজাত্য। এর পেছনে অবশ্য দর্শকদের দায়ও আছে বৈকি। মাঠে নামলেই দর্শকদের প্রথম চাহিদা চার–ছক্কা। টি-টোয়েন্টির যুগে প্রতি ওভারে চার-ছক্কা না থাকলে ম্যাচটাই যেন কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। সবার চাহিদায় একটা বড় স্কোরবোর্ড আর সেটিকে পাল্লা দিয়ে প্রতিপক্ষের ম্যাচ ছিনিয়ে নেওয়া।

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি রোহিত শর্মার
ছবি: আইসিসি

দর্শকদের চাওয়া বুঝতে পেরে আইসিসিও বিশ্বকাপের পিচ ঠিক করে সেভাবেই। যাতে মুড়ি-মুড়কির মতো হবে চার-ছক্কা। আর দর্শকেরা ভাসতে পারবেন আনন্দ উল্লাসে। যে কারণে ২০১১ বিশ্বকাপকে বোলার এবং ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দেওয়া গেলেও গত দুবার আসরের জয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে হচ্ছে ব্যাটসম্যানদের। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত ছিল ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য। সময়–সময় তা ভেঙে বোলাররা নিজেদের আলাদা স্থান করে নিতে পেরেছেন বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। শেষ হাসি হেসেছেন ব্যাটসম্যানরাই।

কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ একটু ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। প্রথম কারণ, ভেন্যু। অস্ট্রেলিয়া–ইংল্যান্ড ছেড়ে বিশ্বকাপ আবারও ফিরেছে ভারতে। আর উপমহাদেশের উইকেট মানেই রহস্য। ইংল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়ার মতো পেস–অধ্যুষিত উইকেটের দেখা এখানে পাওয়া যায় না বললেই চলে। বরং এশিয়ার উইকেটের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে রোমাঞ্চ, লুকিয়ে থাকে অজানা এক রহস্য। পিচ এখানে এক গোলকধাঁধা, যার উত্তর জানা থাকলেও ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বোলারদের আধিপত্যও দেখা গিয়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপে
ছবি: আইসিসি

বোলারদের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হতে পারে কন্ডিশন। আগের তিন বিশ্বকাপ গ্রীষ্মে হলেও এবার বিশ্বকাপ নেমে এসেছে শরতে। শীতের আগমুহূর্তে বিশ্বকাপের আয়োজন চিন্তার কারণ হতে পারে অনেকের জন্যই। বিশেষ করে রাতের ম্যাচে খেলা দলগুলোর জন্য। কারণ, সূর্য ডোবার পরপরই শিশিরে আচ্ছাদিত হয়ে যাবে সম্পূর্ণ মাঠ, সেই ভেজা পিচে বল হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়। সমাধান সব ব্যাটসম্যানের কাছে না–ও থাকতে পারে।

সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইসিসির নতুন নির্দেশনা। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পিচগুলোর দায়িত্ব পুরোপুরি চলে যায় আইসিসির হাতে। সেই আইসিসি থেকে নির্দেশনা এসেছে, এবারের পিচগুলো যথাসম্ভব নিরপেক্ষ রাখার। শুধু ব্যাটসম্যানদের সুবিধা করে দেওয়া হবে এ রকম পিচ যাতে দেখা না যায়। গত দুই বিশ্বকাপে যেখানে সরাসরি নির্দেশনা ছিল ব্যাটিং পিচ বানানোর, সেখানে এ রকম পিচ বানানোর নির্দেশনা বোলারদের জন্য সুখবরই বটে।

কিন্তু বিশ্বকাপ মাঠে নামতেই বদলে গিয়েছে সব সমীকরণ। বিশ্বকাপের প্রথম দিন থেকেই ছিল ব্যাটসম্যানদের জয়জয়কার। প্রথম সপ্তাহে মাঠে গড়ানো প্রতিটি ম্যাচেই ছিল ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য। প্রথম ৭ দিনেই দেখা মিলেছে ১২ সেঞ্চুরির। পার হয়েছে ৪০০ রান, সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছেন খেলোয়াড়েরা। প্রথম সপ্তাহ মাঠে গড়ানো ম্যাচ দেখে যে কেউ ধরেই নিয়েছিলেন এবারে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঘুরে গিয়েছে সমীকরণ। গত ৭ দিনে দেখা মিলেছে মাত্র একটি সেঞ্চুরির; বাংলাদেশের বিপক্ষে সে সেঞ্চুরি অর্জন করে নিয়েছেন বিরাট কোহলি। তবে এই সপ্তাহে পিচ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন বোলাররা। আফগানিস্তান ও নেদারল্যান্ডস তো রূপকথা সৃষ্টি করেছে তাদের বোলারদের ওপর ভর করেই।

ভারতের রহস্য–পিচ রহস্য দেখানো শুরু করেছে মাত্র। বিশ্বকাপের বাকি সময়টা কে আধিপত্য দেখায়, তার উত্তর দেবে সময়।