যেভাবে এগিয়ে গেল সৌদি আরবের ফুটবল

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোলের পর সৌদি আরবের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস

সৌদি আরব প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে ১৯৯৪ সালে। এশিয়া থেকে আসা দলগুলো বড় মঞ্চে কখনোই তেমন সাফল্য পায়নি। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার দলগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠা স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। ফলে সৌদি আরবকে নিয়ে তেমন আশা ছিল না কারোরই। কিন্তু প্রথমবার এসেই চমকে দিয়েছিল সৌদি আরব। প্রথমে মরোক্কোকে হারায় দলটি। পরের ম্যাচে ১-০–তে হারিয়ে স্তব্ধ করে দেয় বেলজিয়ামকে। প্রথমবার এসেই সৌদি আরব চলে যায় বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে।

সেটাই শেষ। তারপর থেকে সৌদি আরবের কাছে বিশ্বকাপ এক হতাশার নাম। ১৯৯৪ সালের পর অনুষ্ঠিত ৫টি বিশ্বকাপের ৪টিতেই জায়গা করে নেয় সৌদি আরব। কিন্তু সব মিলিয়ে জিততে পারে মাত্র একটি ম্যাচ। এর মধ্যে ২০০২ সালে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জার্মানির কাছে দলটি বিধ্বস্ত হয় ৮-০ গোলে। সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে রাশিয়ার বিপক্ষে ৫-০ গোলের সেই পরাজয় তাদের তাড়া করে বেরিয়েছে বহুদিন। সৌদি আরবের জন্য ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠেছিল যে আরবের এই দলটি বিশ্বকাপে আসবে, খেলবে এবং বাদ পড়ে যাবে গ্রুপ পর্ব থেকেই।

কিন্তু এবার সৌদি আরব ফুটবল দলের মাথায় ছিল ভিন্ন কিছু। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এসেছিল হট ফেবারিটের তকমা নিয়ে। ২০০৬ থেকেই বিশ্বকাপে ইউরোপের জয়জয়কার থাকলেও এবার তেমন শক্তিশালী বলা যাচ্ছিল না কোনো দলকেই। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স দলে ইনজুরির থাবা। দল থেকে ছিটকে গেছেন বেনজেমা, পগবা, কান্তে, এনকুনকুর মতো তারকারা। বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড—এ দলগুলোর কেউই তেমন ছন্দে নেই। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি তো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই পেরোতে পারেনি। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ আবারও ইউরোপে যাবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন খোদ ইউরোপীয়রাই।

অপর দিকে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে আসে আর্জেন্টিনা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে ১৯৯৩ সালের পর কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতে আলবিসেলেস্তারা। কিছুদিন পর লা ফিনালিসিমায় ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে বিধ্বস্ত করে ৩-০ গোলে। বিশ্বকাপে যেখানে বেশির ভাগ দলই চোটসমস্যায় জর্জরিত, সেখানে ছন্দে থাকা এক দল হিসেবেই কাতার পৌঁছান মেসি, ডি মারিয়ারা। অনেক ফুটবল–পণ্ডিত ধরেই নিয়েছিলেন—আর্জেন্টিনাই হচ্ছে এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

আর্জেন্টিনার এই জয়রথের পেছনে স্বাভাবিকভাবেই বড় ম্লান লাগছিল সৌদি আরবকে। কিন্তু গত চার বছরে সৌদি আরব দলে যে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, সেদিকে নজর ছিল না কারোরই। এমনকি আর্জেন্টিনারও।

রাশিয়ার বিপক্ষে বাজে হারের মধ্য দিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ শুরু হলেও পরের ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে বেশ ভালোই খেলেছিল সৌদি আরব। ম্যাচটি ১-০ গোলে হারলেও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায় দলটি। শেষ ম্যাচে তো মোহামেদ সালাহর মিসরের বিপক্ষে জয়ই তুলে নেয় তারা। দলে উন্নতির ছাপ ছিল স্পষ্ট। সেই উন্নতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়া বিশ্বকাপের পর থেকেই কাজ শুরু করে সৌদি আরবের ফুটবল ফেডারেশন। দলটির দায়িত্ব তারা তুলে দেয় হার্ভি রেনার নামের এক ফরাসির হাতে। সাধারণ দর্শকদের কাছে হার্ভি রেনার নামটি অপরিচিত হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে বেশ পরিচিতি আছে তাঁর। ছোট ছোট দলের দায়িত্ব নিয়ে বড় বড় সাফল্য অর্জন করার জন্য তিনি যে সিদ্ধহস্ত! দুটি ভিন্ন দলের হয়ে আফকন (আফ্রিকান কাপ অব নেশনস) জেতা একমাত্র কোচ হার্ভি রেনার! ২০১২ সালে জাম্বিয়ার দায়িত্ব নিয়ে দলটিকে প্রথমবারের মতো করেন আফ্রিকার সেরা। এর কয়েক বছর পর, ২০১৫ সালে আইভরিকোস্টের কোচ হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। আফকন জেতান আইভরিকোস্টকেও। আইভরিকোস্টে নিজের সফল ক্যারিয়ার শেষে ফ্রেঞ্চ ক্লাব লিলের কোচ হনরেনার। খুব একটা সাফল্য না পাওয়া লিলে ছেড়ে যোগ দেন মরক্কোর ফুটবল দলে। তাঁর অধীনে দ্রুত উন্নতি করে মরক্কো। ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়ে যায় ২০১৮ বিশ্বকাপে।

এমন একজন কোচের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে অর্ধেক কাজটা আগেই সেরে রাখে সৌদি আরবিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। হতাশ করেন না রেনারও। মধ্যপ্রাচ্যের দলটিতে নিয়ে আসেন ইউরোপীয় ফুটবলের ছোঁয়া। ছোট ছোট পাসে বল নিজেদের দখলে রেখে আক্রমণ আর বল হারালে ভয়ংকর প্রেসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে বল পুনরুদ্ধার করা—হার্ভি রেনার খেলেন এমন কৌশলেই। শারীরিকভাবে এশিয়ান ফুটবলাররা তেমন ফিট থাকতে পারেন না বলে এ অঞ্চলের কোনো দলই সঠিকভাবে এমন কৌশল প্রয়োগ করতে পারে না। এ জন্য সবার আগে রেনার জোর দেন খেলোয়াড়দের ফিটনেসের দিকে। ৫৪ বছর বয়সী রেনার নিজেও এখনো ফিট। তাঁকে দেখে অনুপ্রেরণা নেন সৌদি আরবের ফুটবলাররা, ঘাম ঝরাতে থাকেন জিমে। কাজটাও সহজ হয়ে যায় রেনারের।

সৌদি আরবের কোচ হার্ভি রেনার

সৌদি আরবের খেলোয়াড়দের পরিশ্রমের প্রতিফলন দেখা যায় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে। মনে হচ্ছিল, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সৌদি আরব না, খেলছে ইউরোপের কোনো দল। হার্ভি রেনার দলকে যে কৌশলে খেলান, তাতে ডিফেন্স থাকে মাঠের বেশ ওপরে। হাই ডিফেন্স লাইন বলে পরিচিত এই কৌশল প্রেসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে খুব দ্রুত বল কেড়ে নেওয়ার জন্য খেলিয়ে থাকেন কোচরা। একটু এদিক–সেদিক হলে এই কৌশলে গোল হজম করার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি, কিন্তু সঠিকভাবে খেলতে পারলে আবার এলোমেলো হয়ে যাবে প্রতিপক্ষের পুরো খেলা। ‘হাই রিস্ক, হাই রিটার্ন’—কৌশলটির মূলমন্ত্রই এমন। গতকাল মাঠে সৌদি আরবের ফুটবলাররা এর প্রয়োগও করেন নিখুঁতভাবে। কৌশলের সঠিক প্রয়োগের সঙ্গে যোগ হয় মধ্যপ্রাচ্যের পরিচিত আবহাওয়া—দুইয়ে মিলে তারা চেপে ধরে আর্জেন্টিনাকে। মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে একমুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি দলটি, একের পর এক প্রেসিংয়ের মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন ডি পল, পারেদেসদের। ফলে কোনো আক্রমণই ভালোভাবে করতে পারেনি লিওনেল মেসির দল। আর যে আক্রমণগুলো থেকে গোল হয়েছে, তার সব কটিই হয়েছে অফসাইড।

অপর দিকে প্রথমার্ধে পেনাল্টি হজম করলেও আস্তে আস্তে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে সৌদি আরব। পিছিয়ে থেকে বিরতিতে গেলেও কারও মধ্যে আত্মবিশ্বাসে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে একের পর এক আক্রমণই বড় প্রমাণ। এর পুরস্কারও দ্রুতই পায় দলটি। ৪৮ থেকে ৫১—মাত্র পাঁচ মিনিটের সৌদি–ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় আর্জেন্টিনার ডিফেন্স। ০-১ থেকে চোখের পলকেই ২-১ গোলে এগিয়ে যায় সৌদি আরব। আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি আর্জেন্টিনা। মিডফিল্ডে সৃজনশীলতার অভাব তো ছিলই, এর সঙ্গে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সৌদি আরবের গোলকিপার মোহম্মদ আল ওয়াইস। বছরের পর বছর মনে রাখার মতোই এক ম্যাচ খেলেছেন গতকাল। পুরো ম্যাচে সেভ করেছেন মোট পাঁচবার। সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দুবার ধরেছেন বল, যার একটি হেড ছিল স্বয়ং মেসির। বিপজ্জনক জায়গা থেকে ক্লিয়ার করেছেন দুবার, একবার তো ডি–বক্সের বাইরে দৌড়ে এসে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার লাউতারো মার্তিনেজকে স্লাইড করে সরিয়ে দিয়েছেন বল। এত সুচারুভাবে গোল সামলাতে পারা অনেক বড় বড় গোলকিপারদের জন্যও স্বপ্নের মতো ব্যাপার। গতকাল তাই করে দেখিয়েছেন মোহম্মদ আল ওয়াইস। ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও উঠেছে তাঁর হাতে।

গোলপোস্টের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মোহম্মদ আল ওয়াইস

গ্রুপ সির আরেক ম্যাচে গতকাল পোল্যান্ড ড্র করে মেক্সিকোর সঙ্গে। পরের দুই ম্যাচের একটিতে জিতলেই সৌদি আরব চলে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ১৯৯৪ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে পা রাখবে তারা। হার্ভি রেনারের দলটি যদি নিজেদের ফর্ম বজায় রাখতে পারে, তাহলে দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলে অবাক হবে না কেউই।