অপরাজিত লেভারকুসেন, ম্যানসিটির টানা চার শিরোপা
জুন মাস আসতেই যেন বিশাদ ভর করে ফুটবলপ্রেমীদের মনে। সপ্তাহে সপ্তাহে লিগের খেলা নেই, অনলাইনে-অফলাইনে ফুটবল নিয়ে কোনো হইচই নেই। প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়কে আবারও মাঠে দেখার জন্য প্রায় ২ মাসের বিশাল বিরতি। যদিও এবারে নেই কোনো বিরতি, ইউরো-কোপা মিলিয়ে জমজমাট এক ফুটবলের মাস কাটাতে যাচ্ছে ফুটবলপ্রেমীরা। মাসভর্তি ইন্টারন্যাশনাল ফুটবলে ডুব দেওয়ার আগে একনজরে দেখে আসা যাক কেমন ছিল এবারের ইউরোপিয়ান লিগ মৌসুম।
বুন্দেসলিগা (জার্মানি): বায়ার লেভারকুসেন
এবারের ইউরোপিয়ান ফুটবল মৌসুমে সবচেয়ে বড় চমক দেখেছে জার্মানি। গত ১১ বছর ধরে যে বায়ার্ন ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে জার্মান ফুটবলে, সেই বায়ার্নই কিনা মৌসুম শেষ করেছে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় অবস্থানে থেকে। শীর্ষে থাকা বায়ার লেভারকুসেনের সঙ্গে তাদের পয়েন্টের পার্থক্য ১৮! গত এক যুগ ধরে যাদের আধিপত্যে টোকা পর্যন্ত দিতে পারেনি কেউ, সেই বায়ার্নকে টপকে নিজেদের ১২০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগার শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে বায়ার লেভারকুসেন। তা–ও সেটা যে সে শিরোপা নয়, একেবারে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের শিরোপা।
লেভারকুসেন রূপকথার সূচনা হয়েছিল গত বছর। মৌসুমের প্রথম ৮ ম্যাচ শেষে লেভারকুসেনের অবস্থান ছিল পয়েন্ট টেবিলের সবচেয়ে নিচে। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা লেভারকুসেন নিজেদের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় আনকোড়া জাবি আলোনসোকে। আলোনসোর ঝুলিতে অভিজ্ঞতা বলতে শুধু রিয়াল মাদ্রিদ অনূর্ধ্ব-১৪ আর রিয়াল সোসিয়াদাদের যুবদল। পেশাদার ফুটবলের ডাগ আউটে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাই ছিল না জাবির। সেই জাবি লেভারকুশেনের দায়িত্ব পেয়েই খোলনচালে বদলে ফেললেন দলকে। অবনমনের শঙ্কায় থাকা লেভারকুসেন মৌসুম শেষ করল ষষ্ঠ অবস্থানে থেকে।
প্রি-সিজনে দলকে নিয়ে আলাদাভাবে কাজ শুরু করলেন জাবি। আলপস পর্বতমালায় ট্রেনিং করা, পুরো দলকে নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈরী পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া—সবকিছুর পেছনেই জাবির লক্ষ্য ছিল একটাই, দলের সবার মধ্যে অপরাজেয় এক মনোভাব গড়ে তোলা। যার প্রমাণ পাওয়া গেল মৌসুমের তৃতীয় ম্যাচেই। পরাক্রমশালী বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ০-২ গোলে পিছিয়ে থেকেও লেভারকুসেন ম্যাচ শেষ করে ড্র নিয়ে। সেখান থেকে সূচনা, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জাবি আলোনসোর দলকে। ম্যাচের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, শেষ বাঁশি বাজার পর জাবি আলোনসো তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন মাথা উঁচু করে। এই মৌসুমে মোট ১৭টি ম্যাচে ৯০ মিনিটের পর গোলের দেখা পেয়েছে লেভারকুসেন। ইউরোপা লিগের নকআউট, জার্মান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা বুন্দেসলিগার ম্যাচ—যেকোনো পরিস্থিতিতেই লেভারকুসেন ছিল অটল। যার ফলাফল মিলেছে মৌসুম শেষ হওয়ার এক মাস আগেই। বায়ার্নের ১১ বছরের সাম্রাজ্য ভেঙে বুন্দেসলিগার শিরোপা এখন বায়ার লেভাকুসেনের ডেরায়। ৯০ পয়েন্ট নিয়ে বুন্দেসলিগার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জনকারী দলের নাম লেভারকুসেন।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ (ইংল্যান্ড): ম্যানচেস্টার সিটি
বুন্দেসলিগায় বায়ার্নের আধিপত্য ভাঙলেও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার সিটির সাম্রাজ্যে বাগড়া বসাতে পারেনি কেউ। টানা চতুর্থবারের মতো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। আট মৌসুম ধরে ম্যানচেস্টারের ডাগ-আউটে আছেন গার্দিওলা, এর মধ্যে ছয়বার উঁচিয়ে ধরেছেন প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। যদিও অন্যান্যবারের তুলনায় গার্দিওলাকে এবার কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে একটু বেশিই। মৌসুমের শুরুটা একদমই ভালো ছিল না সিটির, টানা ড্র-হারে পয়েন্ট টেবিলে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল তারা। সে তুলনায় বেশ ভালো অবস্থানে ছিল লিভারপুল ও আর্সেনাল। বিশেষ করে আর্সেনাল এতটাই শক্ত অবস্থানে ছিল যে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এই মৌসুমেই হয়তো গানার্সদের প্রিমিয়ার লিগ খরা কাটবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আর সেই ফর্ম ধরে রাখতে পারেনি মাইকেল আর্টেটার শিষ্যরা। মৌসুমের শেষ দিন পর্যন্ত সুযোগ ছিল তাঁদের কাছে। শেষ ম্যাচে সিটি হোঁচট খেলেই শিরোপা চলে যেত আর্সেনালের ঘরে। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই রয়েছে। নিজেদের নার্ভ ধরে রেখে টানা চতুর্থবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা নিজেদের করে নিল সিটিজেনরা। সেই সঙ্গে নাম লেখাল প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে।
১৯৯২ সালে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শুরু হওয়ার পর কেউ কখনো টানা চারবার প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারেনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তিনবার হ্যাটট্রিক করলেও টানা চারবার জেতা হয়নি তাদের। গার্দিওলাবাহিনী যেন সেই অপূর্ণতা পূরণ করল, টানা চারবার জিতে প্রমাণ করে দিল, লিগটা শুধু আমাদেরই। সিটি বর্তমান বিশ্বের সেরা দল কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ইংলিশ লিগ যে তাদেরই রাজত্ব, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই রাখেনি তারা।
লিগ ওয়ান (ফ্রান্স): পিএসজি
ম্যান সিটির মতো নিজেদের লিগে আধিপত্য ধরে রেখেছে পিএসজিও। টানা তৃতীয়বারের মতো ফ্রেঞ্চ লিগের উদ্যাপনে মেতেছেন প্যারিসবাসীরা। জিততে জিততে ক্লিশে হয়ে যাওয়া শিরোপাটা উদ্যাপনেও যেন বড্ড অপারগতা তাদের। তবে এবারের ফ্রেঞ্চ লিগের হেডলাইন পিএসজি নয়, বরং লিও। মৌসুমের শুরুতে মালিকানার পরিবর্তন, বার বার কোচের পরিবর্তন। সব মিলিয়ে এক হযবরল অবস্থার মধ্যে ছিল লিও। প্রথম ১৪ ম্যাচ শেষে ৭ পয়েন্ট নিয়ে তাদের অবস্থান ছিল পয়েন্ট টেবিলে সবার নিচে। দলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে খোদ দলের সমর্থক পর্যন্ত মাঠে নেমে এসে কথা শুনিয়ে গিয়েছেন দলকে। লিও আল্ট্রাসদের নেতা মাঠে এসে নিজেদের অতীত আর বর্তমানের তুলনা দিয়েছেন। এই যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স আর যাই হোক, লিও নামটার সঙ্গে যায় না, সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
এরপরই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে লিওর চিত্র। প্রথম ১৪ ম্যাচে ১ জয় পাওয়া দল, পরবর্তী ২০ ম্যাচে ম্যাচ হেরেছে মাত্র চারটি। শুধু তা–ই নয়, শেষ দিনের নাটকীয়তায় লিও শুধু লিগে নিজেদের অবস্থান শক্তই করেনি, পেয়েছে ইউরোপের লিগের টিকিটও। পিএসজির লিগজয় ছাপিয়ে তাই এই মৌসুমে ফ্রেঞ্চ লিগের হেডলাইনার লিও।
লা লিগা (স্পেন): রিয়াল মাদ্রিদ
এক বছর বিরতি দিয়ে আবারও লা লিগার শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। করিম বেনজেমার বিদায়ের পর নতুন কোন স্ট্রাইকার কেনেনি রিয়াল। বরং ধারে নিয়ে এসেছিল নিজেদেরই সাবেক খেলোয়াড় হোসেলুকে। মৌসুম শুরু হতে না হতেই চোটের কারণে ছিটকে গেলেন দলের মূল গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন দুই মূল ডিফেন্ডার এডার মিলিতাও আর ডেভিড আলাবা।
দলের হযবরল অবস্থায় ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলেন জুড বেলিংহাম। বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে যোগ দিতে না দিতেই হয়ে উঠলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভরসার পাত্র। ১৯ গোল নিয়ে এই মৌসুমের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা জুড। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো আর হোসেলু। চারজনের ওপর ভর করেই লা লিগার শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছে রিয়াল। এবার নিয়ে মোট ৩৬ বারের মতো লা লিগার শিরোপা উঁচিয়ে ধরল রিয়াল। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
সিরি আ (ইতালি): ইন্টার মিলান
ইউরোপের বাকি লিগগুলোতে যখন একক আধিপত্য দলগুলোর, তখন ইতালিয়ান লিগে চলছে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা। গত চার মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন চারটি দলের হাতে উঠেছে ইতালিয়ান লিগের শিরোপা। এই মৌসুমে চমক দেখিয়েছে সিমোন ইনজাঘির ইন্টার মিলান। মৌসুমজুড়ে পুরো লিগের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে নেরাজ্জুরিরা। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠার পর মাত্র একবারের জন্য দ্বিতীয় অবস্থানে নামতে হয়েছে তাদের। এই মৌসুমে তাদের দুটো হারই এসেছে সাসুলোর কাছ থেকে। মজার ব্যাপার হলো এই সাসুলোই অবনমিত হয়ে যাচ্ছে সিরি আ থেকে। সাসুলো না থাকলে হয়তো লেভারকুসেনের পাশাপাশি অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের তকমা লাগত ইন্টার মিলানের গায়েও।