চশমা পরা ক্রিকেটারদের কথা
চোখে চশমা থাকলে পাড়ার ক্রিকেটে সুযোগ হয় না অনেকেরই। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক ক্রিকেটারই চোখে চশমা পরে খেলেন নিয়মিত। এমন কয়েকজন খেলোয়াড়ের কথাই বলব আজ। চশমা পরো বা না পরো, লেখা পড়তে পারো নিশ্চিন্তে।
২০১৯ সালের অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেস্টের কথা মনে আছে? দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামেন জ্যাক লিচ। উইকেটে আছেন বেন স্টোকস। জিততে হলে এখনো দরকার ৭৩ রান। উইকেটের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন লিচ। প্রায় প্রতি ওভারে শেষ বলটা খেলতে হয় তাঁকে। আগুনের গোলার মতো একেকটা বল ছুটে আসে। কিছুক্ষণ পরপর নিজের চশমটা খুলে পরিষ্কার করেন জ্যাক লিচ। আবার দাঁড়িয়ে যান আগুনের গোলা সামলাতে। প্রতিটা বল সফলভাবে মোকাবিলার পর উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন দর্শকেরা। হাত তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে হেডিংলির গ্যালারি। ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩৫৯ রান তাড়া করে ওই ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। জয়ের নায়ক ১৩৫ রান করা বেন স্টোকস। কিন্তু সেদিন নায়ক বনে গিয়েছিলেন জ্যাক লিচও। শেষ পর্যন্ত ১৭টি বল খেলে করেছিলেন মাত্র ১ রান। কিন্তু ওই এক রান করে তাঁর মতো এতটা জনপ্রিয়তা হয়তো পায়নি কেউ। লিচের সেই এক রানের ইনিংসের জন্য একটা চশমা কোম্পানি তাঁকে আজীবন ফ্রি চশমা সার্ভিস দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। বুঝতেই পারছ, ওই ১৭ বল খেলে এক রান করার গুরুত্ব কতটা। এখনো নিয়মিত চশমা পরে খেলে যাচ্ছেন জ্যাক লিচ। এখন পর্যন্ত ৩২ টেস্টে ৩ ইকোনমিতে ১১০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। একটি হাফ সেঞ্চুরিসহ রান করেছেন ৪২৬। চশমা চোখেই হয়তো নিজের ক্যারিয়ার আরও লম্বা করতে চাইবেন এই ব্রিটিশ ক্রিকেটার।
চশমা পরা ক্রিকেটারদের তালিকা করতে বললে হয়তো প্রথমে আসবে ড্যানিয়েল ভেট্টরির কথা। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় নিউজিল্যান্ডের এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারের। টানা ১৮ বছর জাতীয় দলে খেলেছেন এই কিংবদন্তি। ৩০০ টেস্ট উইকেটের সঙ্গে ৩ হাজার রান করা অষ্টম অলরাউন্ডার তিনি। এই ফরম্যাটে প্রায় সাড়ে চার হাজার রানের সঙ্গে আছে ৩৬২টি উইকেট। ৬ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ক্যারিয়ারে ২০ বার পাঁচ উইকেট আর ৩ বার ১০ উইকেট নেওয়ার নজির আছে। ৩০০-এর বেশি উইকেট আছে এক দিনের ক্রিকেটেও। টেস্টে সবচেয়ে বেশি বল করা খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি নবম। ২০১৫ সালে এক দিনের ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান ভেট্টরি। মাত্র ৩ বছর বয়স থেকে তিনি চশমা পরতে শুরু করেন।
ভারী রিমের চশমা পরে একজন ক্রিকেটার বিশ্বকাপের ট্রফি ওপরে তুলে উল্লাস করছেন—ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু ছবির মধ্যে এটি একটি। ছবির ব্যক্তিটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড। দুই–দুইবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি অন্যতম। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চা লম্বা এই ক্রিকেটার ছিলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আর ডানহাতি মিডিয়াম পেসার। টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রায় ৪৭ গড়ে রান করেছেন সাড়ে সাত হাজার। এক দিনের ক্রিকেটেও গড় প্রায় ৪০। সেই সময়ে এ রকম ব্যাটিং গড় নিশ্চয়ই প্রশংসার দবিদার। পুরোটা ক্যারিয়ার তিনি চশমা পরেই খেলেছিলেন। তাঁর ওই ছবির সঙ্গে সঙ্গে চশমাটাও হয়ে গেছে বিখ্যাত।
ভারতীয় ওপেনার বিরেন্দর শেবাগকে হয়তো তোমরা অনেকেই চেনো। ক্যারিয়ারে প্রচণ্ড মারমুখী ছিলেন তিনি। যতক্ষণ মাঠে থাকতেন, ততক্ষণ বোলারদের ত্রাস হয়েই থাকতেন। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় শেবাগের। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটেই ৮ হাজারের বেশি রান করেছেন। এই দুই ফরম্যাটে সর্বোচ্চ রান যথাক্রমে ৩১৯ ও ২১৯। শেবাগের সর্বোচ্চ রান নিয়ে আরও একটি মজার ঘটনা আছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও লিস্ট এ ক্রিকেটেও তাঁর সর্বোচ্চ রান যথাক্রমে ৩১৯ ও ২১৯। কাকতালীয় ব্যাপারই বটে। টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছিলেন শেবাগ। টেস্টে সবচেয়ে বেশি দুইবার ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও তাঁর দখলে। এক দিনের ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ২১৯ রানের রেকর্ডও আছে শেবাগের। তবে এত্ত সব রেকর্ড শেবাগ করেছেন চশমা ছাড়াই। তবে আইপিএল ক্যারিয়ারের শেষের দিকে চশমা পরতে হয়েছিল তাঁকে। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে বেশ কিছু ম্যাচে চশমা পরেই খেলেছেন শেবাগ।
পাকিস্তানের বর্তমান দলের তিন ফরম্যাটেই নিয়মিত মুখ ইমাম-উল হক। নিশ্চয়ই তাঁকে নিয়মিত চশমা পরে ব্যাটিং করতে দেখেছ। ২০১৭ সালে এক দিনের ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। ৫০ গড়ে রান করেছেন প্রায় আড়াই হাজার। টেস্টের গড়টাও মন্দ নয়। প্রায় ৪০। এক দিনের ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেন ইমাম। দ্বিতীয় দ্রুততম এক হাজার রানের রেকর্ডও তাঁর। তবে এখানেই শেষ নয় ইমামের ক্যারিয়ার। চশমা চোখেই নিশ্চয়ই আরও বড় করবেন নিজের ক্যারিয়ায়ের ইনিংসটা।
নিউজিল্যান্ডের আরেক ক্রিকেটার মিচেল স্যান্টনার। খালি চোখে বল করলেও ব্যাটিং করেন চশমা পরেই। যে বছর ভেট্টরি অবসর নেন, সে বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় স্যান্টনারের। মূলত ভেট্টরির অবসরের কারণেই কপাল খুলে যায় স্যান্টনারের। ভেট্টরির শূন্য স্থানটাই ভরাট করেছেন স্যান্টনার। অভিষেকের পর থেকে অনেকটা নীরবে–নিভৃতে খেলে যাচ্ছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্চ শোনা যায় না ক্রিকেট মহলে। ওডিআই ক্রিকেটে তাঁর বলিং ইকোনমি ৪.৮৩। এখন পর্যন্ত নিজের ঝোলায় ভরেছেন ৮৮টি উইকেট।
চশমা চোখে মাঠ মাতিয়েছেন আরও এক ভারতীয় ক্রিকেটার। ১৯৯০ সালে অভিষেকের পর থেকে ব্যাটারদের ত্রাস হয়েই ছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত। টেস্টে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৬১৯। এক দিনের ক্রিকেটে ৩৩৭টি। ওডিআইয়ে ১২ রানে ৬ উইকেট ও টি-২০-তে ৫ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ৩৫ বার। তবে বোলার হিসাবে এত্ত এত্ত ভালো রেকর্ড থাকলেও আছে একটুখানি মন খারাপ করা রেকর্ডও। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে বেশি রান দিয়েছেন। আবার টেস্ট ক্রিকেটে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটিও তাঁর। চশমা পরে এত সব রেকর্ড করা ক্রিকেটারকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছ! হ্যাঁ, অনিল কুম্বলের কথাই বলছি এতক্ষণ। ভারতের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন তিনি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক হয় চার্লস কভেন্ট্রির। ব্যাট হাতে চশমা পরে মাঠে নামলেন। সেঞ্চুরি করলেন। সেখানেই থামলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁর রান গিয়ে দাঁড়াল ১৯৪*। বেশ কিছুদিন সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড হিসেবে ছিল কভেন্ট্রির ইনিংসটি। কিছুদিন আগে ঈশান কিষানের করা ২১০ রানের ঝোড়ো ইনিংসে দ্বিতীয় স্থানে চলে গেছেন কভেন্ট্রি। ঈশান কিষানের দুটি রেকর্ডের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম। অবশ্য কভেন্ট্রি যেভাবে শুরু করেছিলেন, শেষটা সেভাবে হয়নি। ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন ২০১৫ সালে। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে মোট আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৫৪টি। সর্বোচ্চ ৩৯টি এক দিনের ম্যাচ খেলে প্রায় ২৪ গড়ে করেছেন ৮৩২ রান। ক্যারিয়ারে তাঁর ওই একটিই শতক।
চশমা চোখে নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটার টিম প্রিঙ্গেল বল করছেন নিয়মিত। ২০২২ সালে এক দিনের ম্যাচ ও টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় তাঁর। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আলো ছড়িয়েছেন। এখন পর্যন্ত ক্রিকেটার এই সংক্ষিপ্ত ভার্সনে ১৩ ম্যাচে প্রায় ৫ ইকোনমিতে নিয়েছেন ৭ উইকেট। এখনো হয়তো আহামরি কিছু করতে পারেননি তিনি। তবে ভবিষ্যৎ তাঁর সামনে এখনো পড়ে আছে।
এ ছাড়া আরও অনেকেই ক্রিকেট খেলেছেন চশমা পরে। তাঁদের মধ্যে পার্সি ফেন্ডার অন্যতম। তিনি চশমা পরতেন শখ করে। চশমা ছাড়াই তিনি দিব্যি দেখতে পারতেন। কিন্তু খেলেছেন ওই চশমা পরেই। আমাদের এলাকার ভাষায় হয়তো এটাকেই বলে ফুটানি। যাহোক, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র ৩৫ মিনিটে তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন।
এডি বারলো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার। একসময় বাংলাদেশ দলকে কোচিং করিয়েছেন। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি চশমা পরেই খেলতেন। বিশ্ব একাদশের হয়ে ৫ বলে ৪ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড আছে তাঁর। বিল বয়েস হয়তো একমাত্র চশমাধারী পেসার। চশমা চোখেই যেন একেকটা আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতেন। তিনি বাউন্সার করে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে আউট করেছিলেন। ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল স্মিথও খেলেছেন চশমা চোখে। ক্যারিয়ারে প্রায় ৫০টি টেস্ট খেলেছেন। তিনি দেশের হয়ে রাগবিও খেলেছেন। তবে তখন চশমা খুলেই খেলতে হয়েছিল।
পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান জহির আব্বাসও মাঠে নামতেন চশমা পরে। পাকিস্তানের হয়ে ৭৮ টেস্টে প্রায় ৫ হাজার রান করেছেন।
তাই কেউ যদি বলে চশমা পর কাউকে খেলায় নেব না, তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ো, ক্রিকেটে চশমা কোনো বাধা নয়।