গত এক দশকে ব্যালন ডি’অরকে বলা হতো শুধু দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যকার একটা প্রতিযোগিতা। ‘কে জিতবে এবারের ব্যালন ডি’অর?’ এই প্রশ্নের জবাবে সবার মুখে শোনা যেত দুটো নাম—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর লিওনেল মেসি। ব্যাপারটা অনেকটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে একবার রোনালদো তো আরেকবার মেসি—এভাবেই চলছিল ব্যালন ডি’অর পুরস্কার।
এমনটা মনে না হওয়ারও কোনো কারণ ছিল না। ২০১০ সালটাকে নিজের করে নিয়েছিলেন ডাচ মিডফিল্ডার ওয়েসলি স্নাইডার। ইন্টার মিলানের হয়ে সেবার ট্রেবল জেতেন স্নাইডার, পাশাপাশি ৫ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট করে নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের ফাইনালে। সবাই যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে এবারের ব্যালন ডি’অর উঠছে স্নাইডারের হাতেই, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইউরোপসেরার পুরস্কার জিতে নিলেন লিওনেল মেসি। ক্লাব ও দেশের হয়ে ৬০টি গোল করেছিলেন মেসি, বার্সার হয়ে জিতেছিলেন লা লিগা শিরোপা। একই ব্যাপার ঘটে ২০১৩ সালেও। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ট্রেবল জিতেছিলেন ফরাসি উইংগার ফ্র্যাংক রিবেরি। কিন্তু ব্যালন ডি’অর জিতে যান রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
কিন্তু এবার আর তা হয়নি। ১৮ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে বসে ব্যালন ডি’অরের ৬৬তম আসর। আগে থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন সবাই, এবারের ব্যালন ডি’অর উঠছে না মেসি কিংবা রোনালদোর হাতে। মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারের র্যাংকিংয়ে রোনালদো এবার নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০তম খেলোয়াড় হিসেবে। ২০০৫ সালের পর এই প্রথমবার ব্যালন ডি’অরের প্রথম ৩০ জনের তালিকায় স্থান হয়নি লিওনেল মেসির।
এবারের ব্যালন ডি’অর কে জিতবেন, তা জানা ছিল সবারই। শুধু বাকি ছিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। ২০২১-২২ মৌসুমের অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য ব্যালন ডি’অর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করতে মঞ্চে উঠলেন জিনেদিন জিদান। খাম খুলে বিজয়ীর নামটি ঘোষণা করলেন ফরাসি কিংবদন্তি—করিম বেনজেমা। বিজয়ী হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি স্ট্রাইকারের নাম শুনে করতালি দিলেন হলে উপস্থিত সবাই। স্বস্তির নিশ্বাসই ফেললেন অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী—যাক, অবশেষে করিম বেনজেমার হাতে ব্যালন ডি’অরটা উঠল!
২০০৯ সালে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার পর কখনোই সেভাবে আলোচনায় আসতে পারেননি বেনজেমা। ক্যারিয়ারের সোনালি সময়টা কাটিয়েছেন রোনালদোর ছায়া হয়ে। গোল কম দেওয়া থেকে শুরু করে সহজ গোল মিস করার জন্য ভক্তদের দুয়ো শুনেছেন অসংখ্যবার। কিন্তু দমে যাননি, দলও ভরসা রেখেছে তাঁর ওপর। রোনালদো যে মৌসুমে রিয়াল ছেড়ে পাড়ি জমান জুভেন্টাসে, সেই মৌসুম থেকেই ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে শুরু করেন বেনজেমা। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ মৌসুমে শুধু লা লিগায় যথাক্রমে ২১ এবং ২৩ গোল করেন বেনজেমা। অথচ এর আগের দুই মৌসুম, অর্থাৎ ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮–তে বেনজেমা করেন যথাক্রমে মাত্র ১১ এবং ৫ গোল। রোনালদো যাওয়ার পরই বেনজেমার পারফরম্যান্সেই সবাই বুঝতে পারেন, সক্ষমতার কোনো কমতি ছিল না তাঁর। দরকার ছিল শুধু সুযোগের।
সবচেয়ে পরিণত রূপে বেনজেমাকে দেখা যায় গত মৌসুমে। মূলত এ জন্যই তাঁর ব্যালন ডি’অর জয়। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এ মৌসুমে মোট ৪৬ ম্যাচে ৪৪ গোল করে রিয়াল মাদ্রিদকে স্প্যানিশ লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই স্ট্রাইকার। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদ শেষ ১৬, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমি ফাইনাল—তিনবারই পিছিয়ে পড়েও বেনজেমার ঝলকেই অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী রাউন্ডে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। বিশেষ করে পিএসজির বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগ এবং চেলসির বিপক্ষে প্রথম লেগ—এই দুই ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন বেনজেমা। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারের সেরা চ্যাম্পিয়নস লিগ কাটান তিনি। ১২ ম্যাচে করেন ১৫ গোল। পাশাপাশি লা লিগায় ২৭ গোল এবং ১২ অ্যাসিস্ট করেন মাত্র ৩২ ম্যাচে।
এমন দানবীয় পারফরম্যান্সের পরপরই এবারের ব্যালন ডি’অর যে করিম বেনজেমার হাতে উঠছে, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। পারফরম্যান্সের বিচারে তাঁর ধারেকাছেও ছিলেন না কেউ, নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী সাদিও মানে নিজ দেশের হয়ে আফ্রিকান নেশন লিগের শিরোপা জিতলেও ক্লাবপর্যায়ে কোনো সাফল্য পাননি। তৃতীয় স্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির বেলজিয়ান মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনার পারফরম্যান্সও বেনজেমাকে টপকে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই ব্যালন ডি’অর জিতেছেন করিম বেনজেমা।
ক্যারিয়ারের কঠিন সময় পার করেছেন অনেকবারই। কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি বেনজেমা। ব্যালন ডি’অর ট্রফি হাতে তিনি জানান, এটি ছিল তাঁর শৈশবের স্বপ্ন, ‘ব্যালন ডি’অর জিততে পেরে আমি খুবই গর্বিত। ছোটবেলা থেকেই ব্যালন ডি’অর জেতার স্বপ্ন দেখতাম আমি। কখনো হাল ছাড়িনি। পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব।’
৩৪ বছর বয়সে এসে প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতলেন ফ্রান্সের লিওনে জন্ম নেওয়া বেনজেমা। ব্যালন ডি’অরের ৬৬ বছরের ইতিহাসে স্যার স্ট্যানলি ম্যাথিউসের পর সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে এই পুরস্কার জেতেন তিনি। বেনজেমা জানান, নিজের ৩০তম জন্মদিনের পর থেকে ব্যালন ডি’অর জেতার জন্য মনোযোগী হয়েছেন। অথচ এই বয়সে ফুটবলাররা তাঁদের সেরা সময় পেছনে ফেলে আসেন। বেনজেমার ব্যালন ডি’অর জেতার এই গল্প শুধু ফুটবলারই নয়, সবার জন্যই অনুপ্রেরণার।