স্পেন, ইতালি আর ক্রোয়েশিয়া এক গ্রুপে থাকার কারণে গ্রুপ বি–কে যদি ধরা হয় ‘গ্রুপ অব ডেথ’, তাহলে গ্রুপ ই-কে বলা উচিত অনিশ্চয়তার গ্রুপ। কারণ, এই গ্রুপে চার দল বেলজিয়াম, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া আর ইউক্রেন—কে কেমন করবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা বেশ মুশকিল। হয়তো অভিজ্ঞতা আর দলের শক্তিমত্তায় বেলজিয়ামকে তুমি এগিয়ে রাখতে চাইবে, কিন্তু জেনে রাখা ভালো, এই বেলজিয়াম কিন্তু একেবারে নতুন একটা দল। তাদের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটেছে। নতুন কোচ দোমিনিক তেদেস্কোর হাত ধরে আবার নতুন যুগের সূচনা করতে চাচ্ছে তারা। ওই দিকে বাকি তিনটি দল দলগত শক্তিমত্তায় একদম কাছাকাছি। তাই বেলজিয়াম যদি ইউরোতে ফর্মহীনতার মতো সমস্যায় ভোগে, তাহলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে অঘটন।
বেলজিয়ামের ৩৮ বছর বয়সী ইতালিয়ান কোচ দোমেনিক তেদেস্কো খেলোয়াড় হিসেবে পেশাগত জীবনে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। তাই ক্যারিয়ারে আগেভাগে অবসর নিয়ে নিতে হয় তাঁকে। কিন্তু কোচের ভূমিকায় আসার পর তিনি তাঁর ফুটবল দর্শনকে দারুণভাবে প্রয়োগ করতে পারছেন। আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলাতে পছন্দ করেন। সব সময় চান প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে। তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে বিশ্লেষণে বিশ্বাসী। মস্কোভা আর আরবি লাইপজিগের হয়ে সাফল্যের পর এ জন্যই তরুণ এই কোচের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন বেলজিয়ামকে সাজানোর ভার। সেখানে তেদেস্কো একেবারেই হতাশ করেননি।
বেলজিয়ামের হয়ে ১৪ ম্যাচে জিতেছেন ১০টিতে। বাকি ৪টিতে ড্র, কোনো হার নেই। গ্রুপ পর্বে তারা করেছে মোট ২২ গোল, আর গোল হজম করেছে মাত্র ৪টিতে। তাই বলা যায়, নতুন এই কোচের অধীনে অপরাজিত থেকে ইউরো খেলতে এসেছে এই বেলজিয়াম দল। তবে এই জয়যাত্রা চললেও দলের মধ্যে একটা ঝামেলা আগে থেকেই হয়ে আসছে। কোচের সঙ্গে তুমুল কলহে জড়িয়ে বর্তমান সময়ের সেরা গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ইউরো খেলছেন না। তাই গোলরক্ষক পজিশনে যাঁরা আছেন, তারা খুব একটা নির্ভরযোগ্য নন।
পাঁচবার ইউরো খেললেও রোমানিয়ার গ্রুপ পর্ব পার করতে পেরেছে মাত্র একবার। গত দুই বিশ্বকাপ আর শেষ ইউরোতে তারা দর্শক হিসেবে থাকলেও এবার পুনরায় বড় মঞ্চে ফিরেছে তারা। নতুন প্রজন্মের মুখদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এই দল। তা ছাড়া তাদের বর্তমান ফর্মও মন্দ না।
আগেই বলেছি, বেলজিয়ামের সেই স্বর্ণযুগ চলে গেছে। অনেকেই অবসর নিলেও হাতেগোনা কয়েকজন অবশ্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ভার্টোংহেন। বয়স এখন ৩৭ বছর, তবুও নতুনভাবে গঠিত এই দলের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। হয়তো নিয়মিত মাঠে আর নামেন না। কিন্তু দলের নতুনদের তাঁর অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ বিশেষভাবে প্রয়োজন। তবে রক্ষণের মূল দায়িত্ব থাকবে ওয়েস ফাউটের কাঁধে। তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধতে পারেন ডেবাস্ত অথবা অ্যাক্সেল উইটসেল। ফুলব্যাকের দায়িত্বে থাকবেন পুরোনো সৈনিক কাস্তানিয়ে আর মুনিয়ে।
ইউরো বাছাইপর্বে গোল তেমন না হজম করলেও, আপতদৃষ্টিতে বেলজিয়ামের রক্ষণভাগকে খুব একটা মজবুত বলা যায় না। তাই এই দিক থেকে তাদের মাঝমাঠ আরও বেশি ভরসা জোগায়। আছেন ৩২ বছর বয়সী কেভিন ডি ব্রুইনা। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণের ব্যাটনটা থাকবে তাঁর হাতেই থাকবে। আছেন তিয়েলেমান্স। আর আমাদু ওনানা এবং আরথুর ভারম্রিয়েন নতুন করে ভরসা জোগাচ্ছেন। তেদেস্কো সাধারণত ৪-২-৩-২ ছকে ডাবল পিভট ও একজন প্রথাগত ক্রিয়েটিভ প্লে-মেকার নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। দলে বিশ্বের সেরা প্লেমেকার হিসেবে ডি ব্রুইনা যেহেতু আছেন, তাই এখানে তাঁর দুশ্চিন্তা খানিকটা কমে যাবে। তবে তাদের প্রধান শক্তিমত্তা কিন্তু আক্রমণভাগে। সমালোচকদের আলোচনার টেবিলে বেলজিয়ামের আক্রমণভাগ সেভাবে আলোচনার বিষয়বস্তু হয় না বলেই তাদের নিয়ে জানাশোনা কম অনেকের।
তেদেস্কো সাধারণত দুজন গতিসম্পন্ন উইংগার নিয়ে তাঁর একাদশ সাজান। কাটব্যাক করে দ্রুত গতিতে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকতে পারেন এই উইংগাররা। পাশাপাশি ক্রস, ফিনিশিং আর ড্রিবলিংও বেশ ভালো তাঁদের। এখানে আক্রমণের ডান পাশে থাকতে পারেন ইয়োহান বাকাইয়াকো। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে পিএসভির হয়ে মোট ১২ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট করেছেন। অন্য পাশে দেখা যেতে পারে ম্যানচেস্টার সিটির জেরেমি ডোকুকে। তবে তেদেস্কোর তুরুপের তাস হিসেবে থাকবেন আর্সেনালের লেয়ান্ড্রো ট্রোসার্ড। এবার প্রিমিয়ার লিগে ৩৪ ম্যাচে করেছেন ১২ গোল, চ্যাম্পিয়নস লিগেও ৯ ম্যাচে ৪ গোল আছে তাঁর। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, আক্রমণভাগে যেকোনো পজিশনে যেকোনো ভূমিকায় তিনি দারুণ কার্যকর।
আক্রমণে স্ট্রাইকারের ভূমিকায় এখনো মূল ভরসা রোমেলু লুকাকু। তবে ইউরোতে এবার নিজের জাত চেনাতে পারেন লেইপজিগের স্ট্রাইকার লুইস ওপেনদা। চলতি মৌসুমে ৪৫ ম্যাচে ২৪ গোল করে ইউরোপে সব পাদপ্রদীপের আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন তিনি।
দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড় নিয়ে ইউরোতে আসা ইউক্রেন এবার অন্যরকম একটা গল্প লিখলেও লিখতে পারে। গত ইউরোতে তাদের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার কথা তোমাদের মনে থাকার কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ার পাশাপাশি সেই প্রভাবটা ফুটবল দলের ওপরও টের পাওয়া যাচ্ছিল। এ জন্য শুরুটা ভালো করলেও বারবার সুর কেটে যাচ্ছিল তাদের। ইউরো বাছাইপর্বে তারা পেয়েছিল ইংল্যান্ড আর ইতালিকে। ৮ ম্যাচের ৪টিতে পয়েন্ট খুইয়ে তাদের পার করতে হয়েছে প্লে-অফ। সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া প্রীতি ম্যাচে জার্মানির সঙ্গে ড্র করলেও তারা হেরেছে পোল্যান্ডের কাছে। বোঝাই যাচ্ছে, নিজেদের দলগত ফর্ম ওঠানামা করছে। কিন্তু তারা এবার তাদের সমর্থকদের বিশেষ কিছু উপহার দিতে বদ্ধ পরিকর।
এবারের ইউরোতে সবার দৃষ্টি থাকবে তাদের ২৫ বছর বয়সী গোলরক্ষক আদ্রেই লুলিনের দিকে। রিয়াল মাদ্রিদের তৃতীয় পছন্দের গোলরক্ষক হওয়া সত্ত্বেও, সুযোগ পেয়ে ফসকে ফেলেননি তিনি। লস ব্লাঙ্কোসদের লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পেছনে বিশাল অবদান রয়েছে তাঁর। দলে আছেন এভারটনের মাইকোলেঙ্কো আর আর্সেনালের জিনশেঙ্কো। শাখতারের তরুণ মিডফিল্ডার সুদাকোভ ছাড়াও ইউক্রেনের অন্যতম বড় চমক হবে জিরোনার স্ট্রাইকার আরতেম দোমভিক। লা লিগায় স্বপ্নের মতো একটা মৌসুম কেটেছে তাঁর। ৩৬ ম্যাচ খেলে ২৪ গোল করায় ইতোমধ্যে তাঁর দিকে নজর পড়েছে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর। এ ছাড়াও আছেন চেলসির উইংগার মিখাইলো মুদ্রিক।
পাঁচবার ইউরো খেললেও রোমানিয়ার গ্রুপ পর্ব পার করতে পেরেছে মাত্র একবার। গত দুই বিশ্বকাপ আর শেষ ইউরোতে তারা দর্শক হিসেবে থাকলেও এবার পুনরায় বড় মঞ্চে ফিরেছে তারা। নতুন প্রজন্মের মুখদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এই দল। তা ছাড়া তাদের বর্তমান ফর্মও মন্দ না। কারণ, শক্তিমত্তায় নিজেদের থেকে ঢের পিছিয়ে থাকা সুইজারল্যান্ডকে হটিয়ে ইউরো বাছাই পর্বে মোট ২২ পয়েন্ট নিয়ে ইউরোতে এসেছে তারা। আর এই ২২ পয়েন্ট পাওয়ার যুদ্ধে একটি ম্যাচও হারেনি রোমানিয়া।
যদিও বাছাইপর্ব শেষে প্রীতি ম্যাচগুলোতে তাদের ফর্ম চলে যাওয়ার একটা আভাষ পাওয়া গেছে। লিখটারস্টেইন, বুলগেরিয়ার মতো দলের বিপক্ষে তারা করেছে ড্র আর কলম্বিয়ার কাছে তো হেরেই গেল ৩ গোলে। বর্তমান এই দলে তেমন পরিচিত বা তারকা ফুটবলার না থাকলেও তাঁদের অনেকেই খেলেন ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের বিভিন্ন দলে। আক্রমণের চাইতে রক্ষণেই মনোযোগ বেশি রোমানিয়ার। নিজেদের শেষ ১০ ম্যাচে তারা ৬টি ক্লিনশিট রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর ২২ বছর বয়সী টটেনহ্যাম হটস্পারের ডিফেন্ডার রাদু দ্রাগুসিন তাদের রক্ষণের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম।
ইউরো বাছাইপর্বে এবার চমক দেখিয়েছিল স্লোভাকিয়াও। ১০ ম্যাচের মাত্র দুটোতে হেরেছে তারা, যদিও এই দুটো ম্যাচই পর্তুগালের বিপক্ষে। বাছাইপর্ব শেষে প্রীতিম্যাচও তাদের খারাপ কাটেনি। অস্ট্রিয়া আর নরওয়ের সঙ্গে জয় না পেলেও তারা জিতেছে সান মারিনো আর ওয়েলসের বিপক্ষে।
স্লোভাকিয়ার দলে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম ডিফেন্সে মিলান স্ক্রিনিয়ার আর মধ্যমাঠে স্তানিস্লাভ লোবোতকা। কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি হয়তো জোগাবে তাদের ইতিহাস। এই গ্রুপে তারাই একমাত্র দল, যাদের ইউরো জেতার ইতিহাস রয়েছে। যদিও ইতিহাস ঘাটলে তোমরা ইউরো জয়ের তালিকায় স্লোভাকিয়ার নাম খুঁজে পাবে না। কারণ, ১৯৭৬ সালে দেশটির নাম ছিল চেকোস্লোভাকিয়া।
হেড টু হেডে বেলজিয়ামের সঙ্গে স্লোভাকিয়ার কখনোই দেখা হয়নি ইউরোতে। ২০১৩ সালে একমাত্র প্রীতিম্যাচে সেদিন বেলজিয়ামই জিতেছিল। ইউক্রেনের সঙ্গে নেশন্স লিগ আর ইউরো মিলিয়ে তাদের দেখা হয়েছে মোট চারবার। সেখানে ইউক্রেন জিতেছে দুবার এবং স্লোভাকিয়া একবার। রোমানিয়ার বিপক্ষে ইউরোতে তাদের ইতিহাস তেমন সুবিধার না। ১৯৯৯–এর ইউরো বাছাইপর্বে রোমানিয়া তাদের হারিয়েছিল ৫–১ গোলে।
রোমানিয়া আর ইউক্রেনের সঙ্গেও ইউরোতে আগে কখনো দেখা হয়নি বেলজিয়ামের। তাই এই তিন দলের হেড টু হেড পরিসংখ্যান দিয়ে কোনো পরিসমাপ্তিতে আসা সম্ভব নয়। বড় টুর্নামেন্টে ইউক্রেনও কোনো দিন রোমানিয়ার বিপক্ষে খেলেনি। তবে তাদের মোট তিনটি প্রীতি ম্যাচের ফলাফল ইউক্রেনকেই এগিয়ে রাখবে।
গ্রুপ ডি এর ম্যাচগুলো
রাউন্ড এক
রোমানিয়া বনাম ইউক্রেন — ১৭ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
বেলজিয়াম বনাম স্লোভাকিয়া — ১০ জুন (রাত ১০টা)
রাউন্ড দুই
স্লোভাকিয়া বনাম ইউক্রেন — ২১ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
বেলজিয়াম বনাম রোমানিয়া — ২৩ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড তিন
ইউক্রেন বনাম বেলজিয়াম — ২৬ জুন (রাত ১০টা)
স্লোভাকিয়া বনাম রোমানিয়া — ২৬ জুন (রাত ১০টা)