রিয়াল মাদ্রিদ এভাবেই জেতে
অনেক বছর আগে ইংলিশ ফুটবল-পণ্ডিত গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, ‘ফুটবল বেশ সহজ একটি খেলা। একটা বলের পেছনে ২২ জন দৌড়ায়, আর দিন শেষে জেতে জার্মানি।’ ক্লাব ফুটবলে এলে শুধু দলের নামটা পাল্টে যায়। জার্মানির জায়গা দখল করে রিয়াল মাদ্রিদ। সেই সুরে মিলিয়ে বলতে হয়, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলে ৩২ দল, দিন শেষে জেতে সেই রিয়াল মাদ্রিদ।’
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ৬৯ আসরের মধ্যে ১৫ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ। তাদের ধারেকাছে যে দলটা আছে, তাদের ট্রফিসংখ্যা রিয়ালের অর্ধেকেরও কম। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগছে? তবে আরও শোনো। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধিপত্যও রিয়াল মাদ্রিদের। মোট ৩৬ বার লিগ শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে লস ব্লাঙ্কোসরা। ইতালিয়ান লিগে এক জুভেন্টাস ছাড়া নিজেদের লিগের ওপর এমন কর্তৃত্ব নেই কারও। কেবিনেটের শত শত শিরোপার মধ্যেও এবারের লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাটা একটু হলেও আলাদা রিয়াল মাদ্রিদ-ভক্তদের জন্য। এ জন্য ফিরে যেতে হবে ঠিক এক বছর আগে, মৌসুমের একদম শুরুতে।
অম্লমধুর একটা মৌসুম শেষ হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের। প্রাপ্তি বলতে শুধু কোপা দেল রে আর করিম বেনজেমার ব্যালন ডি’অর। কোচ কার্লো আনচেলত্তি যখন নতুন মৌসুমের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত, তখনই খবর এল, করিম বেনজেমা আর থাকছেন না। তাঁর বদলে ধারে দলে ভিড়ছেন ৩৩ বছর বয়সী স্ট্রাইকার হোসেলু। আগের মৌসুমেই যাঁর দল হয়েছে অবনমিত। সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো দলবদল ছিল ইংলিশ মিডফিল্ডার জুড বেলিংহাম। ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। বেছে নেন নিজের আইডল জিনেদিন জিদানের ‘৫’ নম্বর জার্সি। শেষ মুহূর্তে দলে যোগ দেন তুর্কির তরুণ আর্দা গুলার।
দলের ডিফেন্সের মূল তিন স্তম্ভকে হারিয়ে তত দিনে দিশাহারা রিয়াল মাদ্রিদ। মৌসুমের শুরুতেই ফুটবল-পণ্ডিতেরা রিয়াল মাদ্রিদকে সরিয়ে রাখলেন সমীকরণের বাইরে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল, দলটার নাম রিয়াল মাদ্রিদ। হেরে যাওয়ার আগে হারা যাদের রক্তে নেই।
চলনসই একটা দল নিয়ে যেই না মৌসুম শুরু করতে যাবে রিয়াল, অমনি ঘনিয়ে এল দুর্যোগ। মৌসুম শুরুর আগেই ছিটকে গেলেন গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া। লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় পুরো মৌসুমের জন্য নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করলেন বেঞ্চে। দুই সপ্তাহের মধ্যে কর্তোয়ার সঙ্গে যোগ দিলেন দুই ডিফেন্ডার এডার মিলিতাও আর ডেভিড আলাবা। তড়িঘড়ি করে চেলসি থেকে ধারে গোলরক্ষক কেপা আরিজাবাগালাকে দলে ভেড়াল রিয়াল।
দলের ডিফেন্সের মূল তিন স্তম্ভকে হারিয়ে তত দিনে দিশাহারা রিয়াল মাদ্রিদ। মৌসুমের শুরুতেই ফুটবল-পণ্ডিতেরা রিয়াল মাদ্রিদকে সরিয়ে রাখলেন সমীকরণের বাইরে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল, দলটার নাম রিয়াল মাদ্রিদ। হেরে যাওয়ার আগে হারা যাদের রক্তে নেই। মৌসুম শুরু হতে না হতেই ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন জুড বেলিংহাম। রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্রাইকার-সংকটের দিনে তিনিই হয়ে উঠলেন ত্রাতা। গোল, অ্যাসিস্টের বন্যা বইয়ে মৌসুমের প্রথম অর্ধেক রিয়াল মাদ্রিদকে একা হাতে টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। অতঃপর চোট কাটিয়ে যোগ দিলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। সদ্য ৭ নম্বর জার্সি গায়ে চড়েছে তাঁর। নিজেকে প্রমাণ করার একটা তাগিদ তো ছিলই। কেন এত এত রথী-মহারথী ছেড়ে তার গায়েই চড়েছে রাউল-রোনালদোর ‘৭’, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ যেন এই মৌসুমটাই।
কিন্তু এত কিছুর পরও কোথাও যেন একটা সুর কাটা ছিল। রিয়াল মাদ্রিদ খেলছিল বটে, কিন্তু নিজেদের ছন্দে নয়। শেষ মুহূর্তেই গোলে ম্যাচ জেতা রিয়াল মাদ্রিদের বহু পুরোনো স্বভাব, কিন্তু পুরো ম্যাচে ম্লান হয়ে থাকা নয়। মৌসুমের মাঝপথে তাই কোচ কার্লো আনচেলত্তির ট্যাকটিস নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিল, এই মৌসুমে খেই হারানো রিয়াল মাদ্রিদের জন্য সময়ের ব্যাপারমাত্র। খেই হারাল তো হারাল, একেবারে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছেই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ আর বার্সেলোনাকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতলেও, কোপা দেল রের কোয়ার্টার ফাইনালে আর পেরে ওঠেনি আনচেলত্তির বাহিনী। নগরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরে প্রতি মৌসুমের মতো কোপা দেল রের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হলো মাঝপথেই। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে এই হার যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করল আনচেলত্তির কাছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ডেভিড আনচেলত্তির মনে।
মৌসুমজুড়ে রিয়াল মাদ্রিদের এই আধিপত্যের পেছনের নায়ক ছিলেন কার্লো আনচেলত্তির ছেলে ডেভিড আনচেলত্তি। বাবার পথ ধরে ফুটবলে পা রেখেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, মাঠের ফুটবল তাঁকে দিয়ে হবে না, বরং মাঠের বাইরের ফুটবলের জন্যই তিনি বেশি ফিট। ২২ বছর বয়সে খেলা ছেড়ে যোগ দিয়েছেন কোচিংয়ে। উয়েফা ‘এ লেভেল কোচিং’ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাস করা কোচের নাম ডেভিড আনচেলত্তি। লাইসেন্স পাওয়ার আগে থেকেই ছিলেন বাবার ছায়াসঙ্গী। লাইসেন্স পাওয়ার পর বাকি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। ১২ বছর ধরে কাছ থেকে বাবাকে দেখছেন ডেভিড। একদিকে কার্লোর শরীর আর মস্তিষ্কে পড়তে শুরু করেছে বার্ধক্যের ছাপ, অন্যদিকে ক্রমান্বয়ে খুলতে শুরু করেছে ডেভিডের মাথা। এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ছিল ডেভিডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান।
কোয়ার্টার ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে ভিনিসিয়ুসের বদলে ভাজকুয়েজকে নামানো, অতিরিক্ত ডিভেন্সিভ খেলে ম্যাচকে এক্সট্রা টাইম থেকে টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়া। সেমিফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জুড বেলিংহামকে তুলে হোসেলুকে নামানো—সবটাই ডেভিড আনচেলত্তির মাথা থেকে আসা। আর প্রতিটি সিদ্ধান্তই বদলে দিয়েছে রিয়ালের খেলার মোড়। ম্যান সিটির বিপক্ষে টাইব্রেকারে লিড এনে দিয়েছেন ভাজকুয়েজ। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৮১ মিনিটে মাঠে নেমেই হোসেলু বদলে দিয়েছেন খেলার মোড়। জীবনে একবারও শিরোপার স্বাদ না পাওয়া হোসেলু ৩ মিনিটে ২ গোল করে রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। এমনটা হয়তো দলটার নাম রিয়াল মাদ্রিদ বলেই সম্ভব।
রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে এমন আধিপত্য বিস্তার করে লিগ আর ইউরোপ জয় করতে দেখা যায়নি আগে কখনো। মৌসুমের একদম শুরুতে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে হার বাদে স্বপ্নের মতো একটা মৌসুম কেটেছে রিয়ালের। ৯৫ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করলেও লিগ নিশ্চিত হয়েছে চার সপ্তাহ আগেই। আর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে তো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এর আগেও লিগ-চ্যাম্পিয়নস লিগ ডাবল জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু এভাবে আধিপত্য বিস্তার করে জিততে দেখেনি কেউই।
বছর তিনেক আগেও কার্লো আনচেলত্তি ছিলেন এভারটনের কোচ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মাঝসারিতে যাদের নিয়মিত আনাগোনা। সেখান থেকে তিন বছরের ব্যবধানে দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। রোনালদো-পরবর্তী রিয়াল মাদ্রিদ জয়ধ্বনি করে যাচ্ছে কোনো তথাকথিত সুপারস্টার ছাড়াই। একসময় নিয়মিত মাঠে দুয়ো পাওয়া ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। মৌসুমের শুরুতে নিজেদের ডিফেন্সের মূল স্তম্ভকে হারিয়েও মৌসুম শেষে সবচেয়ে সফল দল তারাই। দলের নামটা রিয়াল মাদ্রিদ বলেই হয়তো সম্ভব।