‘ইতিহাসে প্রথমবার’ কথাটার মধ্যে একটা ভারিক্কি চাল আছে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস প্রায় দেড় শ বছরের, অথচ নিয়মিতই দেখা মেলে ‘ইতিহাসে প্রথমবার’ বলার মতো রেকর্ডের। এই যেমন দিল্লিতে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দেখা মিলল গতকাল। নিজেদের ৯১ বছরের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজেদের মাটিতে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হলো ভারত। আর সেই লজ্জা দিল গত তিন সিরিজ ধরে টেস্ট না জেতা নিউজিল্যান্ড।
হোয়াইটওয়াশের শঙ্কা মাথায় নিয়ে ভারতের প্লেনে উঠেছিল কিউইরা। থাকবে না-ই কেন? শ্রীলঙ্কা সিরিজে কিউইদের ভরাডুবি ছিল দেখার মতো। এর আগে নিজেদের মাটিতে ধবলধোলাই হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই থেকে কিউইরা বাদ পড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। ভারত সিরিজটা হতে চলেছিল সেই প্রলেপে নতুন আরেকটা ক্ষত। ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে বসেছিল কেইন উইলিয়ামসনের ইনজুরি। এমনিতেই দলের হযবরল অবস্থা, তার ওপর দলের সেরা ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ফেলা; নিউজিল্যান্ডের জন্য হার ছিল অবশ্যম্ভাবী।
তৃতীয় টেস্ট আসতে আসতে ঘুরে গিয়েছে পাশার দান। ভারতের লক্ষ্য তখন অন্তত একটা জয় নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিমানে ওঠা। আর নিউজিল্যান্ডের চোখে ভারতের মাটিতে ভারতকে ধবলধোলাই করার স্বপ্ন।
পুরোনো রেকর্ডও বলছিল একই কথা। ভারতের মাটিতে শেষ যেবার জিতেছিল কিউইরা, তখন ভারতের হয়ে খেলতেন রবি শাস্ত্রী, কপিল দেবরা। ১৯৮৮ সালে শেষবার ভারতের মাটি থেকে জয় নিয়ে ফেরত গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। সেবারই শেষ। ৩ দশক পেরিয়ে গিয়েছে, ভারতের মাটিতে ৭ বার খেলতে এসেছে কিউইরা। একবারও ফিরতে পারেনি জয় নিয়ে। নিউজিল্যান্ডের কথা বাদ দিই, ঘরের মাটিতে যেন হারতেই ভুলে গিয়েছিল ভারত। গত ১০ বছরে ভারত নিজেদের মাটিতে টেস্ট হেরেছে হাতে গুনে মাত্র চারটি। শেষ সিরিজ হারও এসেছিল সেই ২০১২ সালে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
কিন্তু সব সমীকরণ বদলে দিতেই যেন আগমন হয়েছিল কিউই দলের। বাংলাদেশকে হারিয়ে ফর্মের তুঙ্গে ছিল ভারত, আশা ছিল অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে নিউজিল্যান্ডকে দিয়ে একটা ড্রেস রিহার্সেল হয়ে যাবে তাদের। কিন্তু এই ড্রেস রিহার্সেল যে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের অগ্নিপরীক্ষা হবে, সেটা কে-ই বা ভেবেছিল?
নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম দিনই ভারত দেখল মুদ্রার অপর পিঠ। ম্যাচের প্রথম ঘণ্টাতেই বাড়ির পথ দেখলেন ভারতীয় ব্যাটাররা। কিউইদের স্পিন–তাণ্ডবে রোহিত-কোহলির বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ আটকে গেল মাত্র ৪৬ রানে। যশস্বী জয়সোয়াল আর ঋষভ পন্ত বাদে দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারেননি কেউই। সরফরাজ, ঋষভ আর কোহলির ব্যাটে ভর করে দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচে ফিরেছিল বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। ফলাফল? ৩৬ বছর পর প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পেল নিউজিল্যান্ড। টম ল্যাথামের হাত ধরে যে নতুন নিউজিল্যান্ডের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে, তার উদাহরণ ছিল প্রথম টেস্ট।
প্রথম টেস্টটা যে ফ্লুক ছিল না, তার প্রমাণ ছিল দ্বিতীয় টেস্ট। নিউজিল্যান্ডের জয়কে অনেকে চমক হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। ভেবেছিল টার্নিং উইকেটে ভারতের সামনে নস্যি ব্ল্যাকক্যাপসরা। কিন্তু প্রথম ম্যাচেরই পুনরাবৃত্তি যেন দেখল বিশ্ব। টম লাথাম, রাচিন রবীন্দ্র, ডেভন কনওয়েরা ঠিকই মানিয়ে নিয়েছেন পিচের সঙ্গে। কিন্তু পারলেন না কোহলি-রোহিতরা। প্রথম টেস্টের মতো দ্বিতীয় টেস্টেও ব্যাটিং বিপর্যয়। ভারতের পুরো ব্যাটিং লাইনআপ আটকা পড়ে গিয়েছিল মিচেল স্যান্টনার আর এজাজ প্যাটেলের ঘূর্ণিতে। আর সেই ঘূর্ণিতে ১২ বছর পর নিজেদের মাটিতে সিরিজের হারের ক্ষত লাগল ভারতের গায়ে।
তৃতীয় টেস্ট আসতে আসতে ঘুরে গিয়েছে পাশার দান। ভারতের লক্ষ্য তখন অন্তত একটা জয় নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিমানে ওঠা। আর নিউজিল্যান্ডের চোখে ভারতের মাটিতে ভারতকে ধবলধোলাই করার স্বপ্ন। ভারতের ৯১ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে কখনো নিজেদের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ হয়নি তারা। শেষ হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২ ম্যাচের সিরিজ ২-০ তে হেরেছিল ভারত। তবে ৩ ম্যাচের টেস্ট না হলে সেটাকে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ ধরা হয় না। সে হিসাবে রেকর্ডটা ছিল আজীবনের! সেটাও আর রইল কোথায়?
মিচেল স্যান্টনারের চোটে দলে সুযোগ পেলেন ইশ সোধি। ভারত বরাবরের মতোই পূর্ণশক্তিতে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই প্রথম দুই টেস্টের পুনরাবৃত্তি। নিউজিল্যান্ডের ভয়ানক বোলিং আর ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়। সেখানে একাকী সেনা হয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক ঋষভ পন্ত। তাঁর ওপরে ভর করেই লিড নিয়েছিল প্রথম ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডকে কম রানে আটকে দেওয়া, ভারত একটু একটু করে স্বপ্ন দেখছিল হোয়াইটওয়াশের শঙ্কা এড়ানোর। কিন্তু আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, ১৪৭ রানের টার্গেটে ব্যাট হাতে দাঁড়াতে পারেননি কেউ। এক ঋষভ পন্তই ছিলেন সেনানী হয়ে। তাঁর আউটের সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল ভারতের ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন। ২৫ রানের হার দিয়ে প্রথমবারের মতো ঘরের মাটিতে হোয়াইটওয়াশের স্বাদ পেল ভারত।
ভারতের মাটিতে ভারতের কৌশলেই ভারতকে আটকে দিয়েছে নিউজিল্যান্ড। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নিউজিল্যান্ডের স্পিনারদের। সিরিজে এজাজ প্যাটেল নিয়েছেন ১৫ উইকেট, তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন ফিলিপস-স্যান্টানাররা। মিচেল স্যান্টনার নিয়েছেন ১৩টি আর গ্লেন ফিলিপস নিয়েছেন ৮ উইকেট। তবে সবচেয়ে বড় অবদান এসেছে ব্যাটারদের কাছ থেকে। টম লাথাম, রাচিন রবীন্দ্র আর সিরিজ–সেরা উইল ইয়াং; ভারতের দুর্ধর্ষ স্পিন বোলিং লাইনআপকে সামলেছেন দারুণভাবে। কে বলবে ১৬ বছর ধরে উপমহাদেশে সিরিজ না জেতা নিউজিল্যান্ড শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের কাছে টেস্ট হেরে, হারিয়ে দিয়েছে ভারতকে। তা–ও ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধবলধোলাই করে। টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য বোধ হয় এখানেই। এখানে প্রতিদিনই এমন কিছু ঘটে, যা ঘটেনি আগে কখনো।