২০১০ সালে ফিফা ঘোষণা দেয়, ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে কাতারে। প্রতিবাদে সরব হয় অনেক রাষ্ট্র। সেসবে তখন কান না দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে ফিফা। কাতারও আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপ কাছাকাছি চলে এলে আবারও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশ কাতার বিশ্বকাপ বর্জনের ডাক দিয়ে বসে। এমনকি খেলা চলাকালে বিভিন্নভাবে কাতারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উঁচিয়ে ধরতে চায় বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া অনেক দেশ। ফিফার চোখ রাঙানিতে খেলার মাঠে দেশগুলো তেমন কিছু করতে না পারলেও থেমে থাকেননি দর্শকেরা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়ে নানাভাবে কাতারের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ ঠিকই জানান দিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া ইরানে ‘সঠিকভাবে হিজাব না পরা’র অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যতে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের রেশও দেখা গেছে বিশ্বকাপের মাঠে। আরব ফুটবল সমর্থকেরা ম্যাচ চলাকালে দর্শক সারিতে উড়িয়েছেন ফিলিস্তিনের পতাকা। মাঠের বাইরেও ‘লং লিভ প্যালেস্টাইন’ আর ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগান ছিল তাঁদের মুখে।
বিশ্বকাপ ফুটবলে এমন আন্দোলন কিন্তু মোটেও নতুন কিছু নয়। আগে অনুষ্ঠিত ২১টি বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটিতে বিভিন্ন আন্দোলন আর প্রতিবাদের নজির রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বিক্ষোভ আর বিবাদের ঘটনাও। এমনই কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হলো এ লেখায়।
উরুগুয়ের বিশ্বকাপ বর্জন (১৯৩৪)
প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় ১৯৩০ সালে। আয়োজক দেশ ছিল উরুগুয়ে, চ্যাম্পিয়নও হয় তারা। কিন্তু পরের বিশ্বকাপ আসতেই বেঁকে বসে দেশটি, অংশগ্রহণে জানায় অস্বীকৃতি। প্রথম বিশ্বকাপে ইউরোপ থেকে অংশ নেয় মাত্র চারটি দেশ। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি উরুগুয়ে। এর প্রতিবাদস্বরূপ ইতালিতে আয়োজিত ১৯৩৪ বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি দেশটি। এখন পর্যন্ত উরুগুয়েই একমাত্র দেশ, যারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও বিশ্বকাপের পরের আসরে অংশ নেয়নি।
মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্ট (১৯৩৮)
ইতালির সাবেক স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির নাম শোনেনি এমন কেউ বোধ হয় নেই। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক আয়োজিত হয় জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। জার্মানির তৎকালীন স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার নিজের মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অলিম্পিককে সরাসরি ব্যবহার করেছেন। তা দেখে মুসোলিনি ভাবলেন ফুটবল বিশ্বকাপকে কাজে লাগানোর কথা। ফ্যাসিজম প্রচার করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৩৮ ফুটবল বিশ্বকাপে ইতালিকে পাঠান সম্পূর্ণ কালো জার্সি পরিয়ে। যা পরবর্তী সময়ে পরিচিতি পায় মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্ট নামে। দলটি কালো জার্সি গায়ে দিয়ে যত জায়গায় খেলতে যেত, সবখানেই মুখোমুখি হতো ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনকারীদের সামনে। তবে তা দমাতে পারেনি ইতালির ফুটবল দলকে, মুসোলিনি আর ফ্যাসিজমবিরোধী স্লোগানে মুখর স্টেডিয়ামের মধ্যেই ১৯৩৮ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ইতালি।
আফ্রিকার বিশ্বকাপ বর্জন (১৯৬৬)
ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে একবারই। ১৯৬৬ সালে। আয়োজনটাও ছিল তাদের দেশে। এসব কারণে বিশ্বকাপটি বেশ স্মরণীয়ও বটে। তবে বিশ্বকাপটি অন্য সব বিশ্বকাপ থেকে আলাদা অন্য আরেকটি কারণে। আফ্রিকার ৩১টি দল বর্জন করেছিল বিশ্বকাপের অষ্টম আসরটি। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও ছিল।
১৯৬৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য নতুন এক নিয়মের প্রচলন করে। নতুন নিয়মানুযায়ী, আফ্রিকা থেকে সরাসরি কোনো দল বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারবে না। আফ্রিকা থেকে বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ দলগুলোকে এশিয়ার বাছাইপর্ব থেকে উত্তীর্ণ দলগুলোর সঙ্গে প্লে-অফ খেলতে হবে। প্লে-অফ থেকে উত্তীর্ণ কয়েকটি দল খেলবে বিশ্বকাপ। স্বাভাবিকভাবেই আফ্রিকান দেশগুলো নিয়মটি খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। শুধু আফ্রিকা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া বিশ্বকাপ খেলার জন্য যথেষ্ট নয়, এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ ছিল সবাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব আফ্রিকান দেশ মিলে বর্জন করে ১৯৬৬-এর বিশ্বকাপ।
ভিদেলার বিশ্বকাপ (১৯৭৮)
১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল লাতিন আমেরিকার অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনায়। কিন্তু সে সময়টায় দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে বড়সড় ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ক্ষমতায় চলে আসেন স্বৈরশাসক হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা। দেশটির সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ভিদেলা আর তাঁর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল খুন, নির্যাতনের মতো অভিযোগ। এসব কারণে আওয়াজ ওঠে সেবারের বিশ্বকাপ বর্জনের। আর্জেন্টিনার বাইরে থেকে কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গঠন করেছিলেন একটি প্রবাসী সরকার। তাঁরা বিশ্বের সবার প্রতি আহ্বান জানান বিশ্বকাপটি বর্জন করার জন্য। যদিও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপটি ঠিকঠাকমতোই আয়োজিত হয়, কিন্তু প্রবাসী সরকারের এমন কর্মকাণ্ডে বিশ্বের সবার কাছে বার্তাটি পৌঁছে যায় যে আর্জেন্টিনা ভালো নেই।
সালতিলোতে বিবাদ (১৯৮৬)
বিশ্বকাপ ফুটবল, ১৯৮৬ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেক্সিকোতে। সালতিলো মূলত মেক্সিকোরই একটি শহরের নাম। বিশ্বকাপের সঙ্গে শহরটির জড়িয়ে পড়ার ভালোই কারণ ছিল। এখানে মূলত পর্তুগালের বেশ কয়েকটি দলের ক্যাম্প ছিল। সমস্যা দেখা দেয়, যখন পর্তুগালের খেলোয়াড়েরা সালতিলোর বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে অংশ নিলেও এর জন্য কেউ কোনো পারিশ্রমিক পাননি বলেও অভিযোগ জানান। কয়েকজন খেলোয়াড় তো সেখানকার দায়িত্বরত মানুষের গায়ে রীতিমতো হাতও তুলতে উদ্যত হন। সব মিলিয়ে বেশ জটিল একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে ঘটনা বেশি দূর গড়ায় না, কারণ গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যায় পর্তুগাল। এত উচ্চবাচ্য করার পরও বাজেভাবে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় দলটিকে। এ জন্য সাংবাদিকদেরও তোপের মুখে পড়তে হয় তাঁদের।
আয়োজকদের মধ্যে কোন্দল (২০০২)
বেশ কয়েকটি বিশ্বকাপ ফুটবল এক দেশ নয়, বরং কয়েকটি দেশ মিলে আয়োজন করে। যেমন ২০০২ বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া। বিপত্তি বাধে সেখানেই। কোরিয়ার দর্শকেরা কোরিয়ার সিউলে অবস্থিত জাপানিজ এম্বাসির সামনে আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, ফাইনালের টিকিটের মধ্যে আয়োজকদের নাম লিখতে হবে, ‘কোরিয়া-জাপান’ এভাবে। অর্থাৎ কোরিয়ার নাম আগে দিতে হবে। অন্যথায় জাপানের ইয়োকোহামা থেকে ফাইনাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করার হুমকি দেন তাঁরা। পরে অবশ্য আন্দোলনটি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়। আন্দোলনটি ছোট হলেও অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন, দুই দেশের মধ্যে না আবার শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
নুরেমবার্গের বিদ্রোহ (২০০৬)
বিশ্বকাপের ১৮তম আসর অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে, জার্মানিতে। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ৩২টি দেশের একটি হলো ইরান। প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই বিতর্কের মুখে পড়ে যায় দেশটি। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ আহমাদিনেজাদ। তিনি বিশ্বকাপের আগে মন্তব্য করেন, ইসরায়েলকে ইউরোপের অংশ করে ফেলা উচিত। পাশাপাশি নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের আসলেই হত্যা করেছিল কি না, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁর এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয় অনেক রাষ্ট্র। এরই জের ধরে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মানুষ একত্র হয়ে আহমাদিনেজাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। প্রতিবাদের একপর্যায়ে ইরানকে বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ করারও দাবি তোলা হয়। কিন্তু তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের হস্তক্ষেপে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
ফ্রান্সের অনুশীলন বর্জন (২০১০)
২০১০ বিশ্বকাপে ফ্রান্স ফুটবল দল কোচের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে বিশাল আলোচনার জন্ম দেয়। এর আগের বিশ্বকাপে দারুণ খেলে দলটি, কিংবদন্তি জিনেদিন জিদানের নৈপুণ্যে পৌঁছে যায় ফাইনালে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও বাহবা কুড়ায় ফ্রান্স। ২০১০ বিশ্বকাপেও তুমুল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল দলটি। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতেই বাধে বিপত্তি। দলের কোচ রেমন্ড ডমেনেকের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন ফ্রান্স দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিকোলাস এনেলকা। শাস্তিস্বরূপ ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন দল থেকে এনেলকাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে গ্রহণ করেন না দলের অন্য ফুটবলাররা, পরদিনের অনুশীলন বর্জন করেন সবাই মিলে। এসব ঝামেলার কারণে বিশ্বকাপেও যাচ্ছেতাই পারফর্ম করে ফরাসিরা, বাদ পড়ে যায় গ্রুপ পর্ব থেকেই।
বিশ্বকাপ আয়োজনে ব্রাজিলের অত্যধিক ব্যয় (২০১৪)
ব্রাজিল কখনোই তেমন ধনী কোনো রাষ্ট্র ছিল না। ফলে ১৯৫০ সালের পর ২০১৪ সালে আবারও বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় ব্রাজিল, অখুশি হন অনেক ব্রাজিলীয় নাগরিক। অনেকেই বিশ্বকাপ ব্রাজিল থেকে সরিয়ে অন্য কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এর ওপর যখন বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামসহ আরও নানা খাতে সরকার ব্যাপকভাবে টাকা খরচ করা শুরু করে, আন্দোলন ওঠে তুঙ্গে। যে শহরগুলোতে বিশ্বকাপের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়, সব জায়গাতেই হয় বিক্ষোভ। গ্রেপ্তার হন প্রায় ২৩৪ জন নাগরিক।
পুতিনবিরোধী আন্দোলন
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় রাশিয়া—২০১৮ সালে। বিশ্বকাপে যেহেতু পৃথিবীর বহু মানুষের নজর থাকে, একে রাশিয়ার অনেকে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ফ্রান্স বনাম ক্রোয়েশিয়া। একটি গানের দল সিদ্ধান্ত নেয়, খেলার মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য মাঠে ঢুকে রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাবে। এই ভেবেই ফাইনাল খেলার মাঝখানে দলটির চারজন দৌড়ে চলে আসেন মাঠে। একজন তো এমবাপ্পের সঙ্গে হাই ফাইভও করেন! তবে এর ফল খুব একটা সুখকর হয় না তাঁদের জন্য। শাস্তিস্বরূপ অল্প কিছুদিনের জন্য জেল খাটতে হয় প্রত্যেককেই।