ফুটবলে ফাউল

সন হিউং-মিনের ফাউলের শিকার আন্দ্রে গোমেজ
ফুটবল আর ফাউল—এই দুটি শব্দ একটি অন্যটির পরিপূরক হয়ে আছে খেলার শুরু থেকে। ফুটবল ম্যাচ হবে আর ফাউল হবে না, এটা তো চিন্তা করাই অসম্ভব একটা ব্যাপার। ফুটবলের শুরু থেকে ফাউল থাকলেও কোন ফাউলের শাস্তি কেমন হবে, তা কিন্তু ঠিকঠাকভাবে বলা হয়নি অনেক দিন। ফলে ভয়ংকর সব ট্যাকল করেও পার পেয়ে যেতেন বেশির ভাগ ফুটবলার। অনেক দলের তো কৌশলই ছিল, ফাউল করে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে ম্যাচ জিতে নেওয়ার। এসব কিছু ঠেকানোর লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবলে ফাউল–সংক্রান্ত নিয়মনীতি চালু করে ইংলিশ ফুটবলের পরিচালনা পর্ষদ ‘এফএ’। কোন ধরনের ট্যাকল বৈধ আর কোনটি অবৈধ—এটি জানিয়ে দেয় তারা।

অবৈধ ট্যাকল এবং শাস্তি

ফুটবল খেলার আনুষ্ঠানিক নীতির ১২ নম্বর আইনে বলা আছে, মাঠের কোন আচরণকে ফাউল হিসেবে ধরা হবে আর কোনটাকে ফাউল ধরা হবে না। রেফারির কাছে যদি মনে হয় খেলোয়াড়ের কোনো ট্যাকল বা কাজের মাধ্যমে ওই নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে, তখন সেটিকে তিনি ফাউল বলে ঘোষণা করেন। প্রতিপক্ষকে লাথি মারা, গায়ের ওপর পড়ে যাওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা, ট্যাকল করার সময় বলের আগে শরীরে আঘাত করা, ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে বল ধরা—মোটা দাগে এগুলোকেই ফাউল বলা হয়ে থাকে। ফাউলের শাস্তিস্বরূপ রেফারি খেলোয়াড়দের হলুদ ও লাল কার্ড দেখিয়ে থাকেন। কোনো খেলোয়াড় এক ম্যাচে দুবার হলুদ কার্ড দেখলে বা একবার লাল কার্ড দেখলে সেই ম্যাচে আর খেলতে পারেন না।

ডিরেক্ট এবং ইনডিরেক্ট ফ্রি–কিক

যখন কোনো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের কাউকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাকল করে বসে, তখন রেফারি প্রতিপক্ষ দলকে একটি ডিরেক্ট ফ্রি–কিক নেওয়ার সুযোগ করে দেন। এই ফ্রি–কিক থেকে সরাসরি গোল করা যায়। তাই যেকোনো দলের জন্যই গোল দেওয়ার জন্য বেশ ভালো একটি সুযোগ এটি। বিশেষ করে কিকটি যদি প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের আশপাশে পাওয়া যায়।

অপর দিকে হালকা কোনো ফাউল করার শাস্তিস্বরূপ ইনডিরেক্ট ফ্রি–কিকের ঘোষণা দেওয়া হয়। ইনডিরেক্ট ফ্রি-কিক থেকে সরাসরি গোল দেওয়া যায় না, গোলপোস্ট বরাবর শট নেওয়ার আগে অন্তত বলে একবার কারও ছোঁয়া লাগিয়ে নিতে হয়।

লাল কার্ড ও হলুদ কার্ডের ইতিহাস

১৯৬৬ ফুটবল বিশ্বকাপের পর ইংরেজ রেফারি কেন আস্টন প্রথম ফুটবলে কার্ড নিয়ে আসার ধারণা দেন। রাস্তার ট্রাফিক লাইট দেখে তাঁর মাথায় কার্ড দেখানোর চিন্তাটি আসে। পরীক্ষামূলকভাবে ১৯৬৮ অলিম্পিক এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপে রেফারিদের হাতে লাল ও হলুদ কার্ড তুলে দেওয়া হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৮২ সাল থেকে খেলায় কার্ড রাখার নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়।

কোন ফাউলের ক্ষেত্রে হলুদ কার্ড দেওয়া হবে আর কোন ফাউলের ক্ষেত্রে লাল কার্ড দেওয়া হবে, সেটা নির্ভর করে ফাউলের ধরনের ওপর। কোন ধরনের ফাউলের ক্ষেত্রে হলুদ কার্ড এবং কোন ধরনের ফাউলের ক্ষেত্রে লাল কার্ড দেওয়া হতে পারে, তা নিচে সংক্ষেপে দেওয়া হলো—

হলুদ কার্ড

  • কথা কিংবা কাজের মাধ্যমে মাঠে রেফারির বিরোধিতা করা বা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়া।

  • ফুটবল খেলার বিভিন্ন নিয়ম ক্রমাগত লঙ্ঘন করা।

  • ইচ্ছাকৃতভাবে সময় নষ্ট করা, খেলা পুনরায় শুরু করতে দেরি করা।

  • প্রতিপক্ষকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাকল করা।

  • রেফারির অনুমতি ছাড়াই মাঠে প্রবেশ করা কিংবা মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

  • অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করা।

লাল কার্ড

  • খুবই গুরুতর কোনো ফাউল করা।

  • মাঠে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা, আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করা।

  • মাঠে কারও গায়ে থুতু দেওয়া।

  • ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে বল ধরে প্রতিপক্ষের গোল বা গোল দেওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করা।

  • এক ম্যাচে দুবার হলুদ কার্ড দেখা।

প্রায়ই দেখা যায় এমন কিছু ফাউলের উদাহরণ

আটকানো

প্রায়ই দেখা যায় নিজের শরীর দিয়ে খেলোয়াড়েরা প্রতিপক্ষকে আটকে দিচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, এটি একটি ফাউল।

ধরে রাখা

দৌড়াতে থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের জার্সি টেনে ধরে অনেক সময় গতি কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যা একটি ফাউল।

স্লাইডিং ট্যাকল

ডিফেন্ডারদের অন্যতম কার্যকর অস্ত্র হলো স্লাইডিং ট্যাকল। তবে ঠিকমতো প্রয়োগ করা না গেলে স্লাইডিং ট্যাকল মারাত্মক হতে পারে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের জন্য। ইংলিশ ফুটবল ক্লাব টটেনহামের খেলোয়াড় সন হিউং-মিন একবার স্লাইডিং ট্যাকল করতে গিয়ে পা ভেঙে দিয়েছিলেন এভারটনের ফুটবলার আন্দ্রে গোমেজের। ঠিকভাবে স্লাইডিং ট্যাকল করা না গেলে ফাউলের পাশাপাশি রেফারি হলুদ কার্ড দেখান। দেখাতে পারেন লাল কার্ডও।

পা মাড়িয়ে দেওয়া

ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিপক্ষের পা মাড়িয়ে দেওয়া খুবই পরিচিত একটি ফাউল। তবে রেফারিকে খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে, কারণ অনেক সময় পায়ে ছোঁয়া না লাগলেও খেলোয়াড়েরা ফাউল আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে মাঠে পড়ে যান।

হাই ট্যাকল

ট্যাকল করা ফুটবলে কোনো অফেন্স নয়। এমনকি ট্যাকল করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে মাটিতে ফেলে দিলেও ফাউল হয় না। যিনি ট্যাকল করছেন, তার পা যদি আগে বলকে স্পর্শ করে, তাহলে ট্যাকলটিকে বৈধ বলা যাবে। তবে কিছু ট্যাকলকে ফুটবলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, প্রতিপক্ষের মাথা সমান উচ্চতায় পা তুলে দিয়ে বল দখল করার চেষ্টা করা। এই ট্যাকলকে বলা হয়ে থাকে ‘হাই ট্যাকল’। বিপজ্জনক হওয়ায় হাই ট্যাকল নিষিদ্ধ। হাই ট্যাকল করলে ফাউল তো হবেই, অনেক সময় রেফারি হলুদ কার্ডও দেখাতে পারেন।