এবারের ফিফা বিশ্বকাপ যেভাবে এগোচ্ছে, একে অঘটনের বিশ্বকাপও বলা যেতে পারে। প্রথম সপ্তাহেই হেরে বসেছে ফেবারিট আর্জেন্টিনা আর জার্মানি। ফর্মের তুঙ্গে থাকা আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছে সৌদি আরব। গতকাল জার্মানি আর জাপানের খেলাতেও ঘটেছে অঘটন। প্রথমার্ধে ১ গোলে পিছিয়ে থেকেও ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে দারুণভাবে ফিরে আসে জাপান, ম্যাচের ৭৫ এবং ৮৩ মিনিটে ২ গোল করে জন্ম দেয় বিশ্বকাপের দ্বিতীয় অঘটনের। ছোট দলগুলোর বিপক্ষে বড় দলগুলো হোঁচট খাচ্ছে—এমনই একটা বিশ্বকাপে আজ রাত একটায় সার্বিয়ার মুখোমুখি হবে লাতিন আমেরিকা থেকে সর্বশেষ বিশ্বকাপ পাওয়া দল ব্রাজিল।
ব্রাজিল নিজেদের পঞ্চম এবং সর্বশেষ বিশ্বকাপটি জেতে ২০০২ সালে। দেখতে দেখতে চলে গেছে আরও চারটি বিশ্বকাপ। একটিতেও জয়ী হতে পারেনি তারা। ব্রাজিলের সর্বশেষ সাফল্য ২০১৪ সালের সেমিফাইনাল। যে ম্যাচে তারা ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল জার্মানির কাছে। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে তুলনামূলক পরিণত একটি দল নিয়েই গিয়েছিল ব্রাজিল। নেইমার, কুতিনহো, জেসুস, কাসেমিরোদের নিয়ে গড়া ব্রাজিল দল দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সমর্থকেরা। কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠেছিল ব্রাজিল। তবে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল ব্রাজিল। হলুদ কার্ডের খপ্পরে পড়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যান মিডফিল্ডের প্রাণ কাসেমিরো। তাঁর বদলি হিসেবে নামেন ফার্নান্দিনহো। ম্যাচের শুরুতেই আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসেন তিনি। চাপে পড়ে যায় ব্রাজিল। কেভিন ডি ব্রুইনার অসাধারণ গোল ২-০ তে পিছিয়ে পড়ে নেইমারের দল। সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দেয় বেলজিয়ামের গোলকিপার থিবো কোর্তোয়ার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স। সব মিলিয়ে আবারও কপাল পোড়ে ব্রাজিলের। বেলজিয়ামের কাছে ২-১ গোলে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় নেইমারদের।
এবার তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে গড়া দল নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছে ব্রাজিল। কোচ তিতের নেতৃত্বে ব্রাজিলের সাম্প্রতিক ফর্মই বলে দেয় দলটি কতটা শক্তিশালী। তারকার ছড়াছড়ি ব্রাজিলের এই দলে। গত বিশ্বকাপের প্রথম একাদশে নিয়মিত খেলেছেন, এমন খেলোয়াড় আছেন ৯ জন। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো, রাফিনিয়া, এদের মিলিতাও, রিচার্লিসনের মতো তারকারা। সবাই কয়েক মৌসুমজুড়ে ইউরোপের বড় দলগুলোর হয়ে দেখিয়েছেন দারুণ নৈপুণ্য। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র আর রদ্রিগো তো বয়স ২২ পেরোনোর আগেই জায়গা করে নিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ দলে। জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগাসহ অনেক শিরোপা।
এত এত তারকার ছড়াছড়ি হলেও, এর মধ্যে একটা ‘কিন্তু’ আছে। গত বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিলেন না, কিন্তু এ বিশ্বকাপে আছেন—ব্রাজিল দলে এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১৬। আর তাঁদের মধ্যে সাতজনই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। এতেই বোঝা যায়, গত কয়েক বছরে আক্রমণে যত খেলোয়াড় পেয়েছে ব্রাজিল, সে তুলনায় মাঝমাঠ আর রক্ষণভাগে তেমন কোনো খেলোয়াড় পায়নি। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, রাইট ব্যাক আর লেফট ব্যাক পজিশনে সেলেকাওদের দলে আসেনি নতুন কেউ। মার্সেলো চলে যাওয়ার পর লেফট ব্যাক পজিশনে রেনান লোদিকে খেলিয়েছিলেন তিতে। তাতে লাভ তো হয়নি, উল্টো লোদির এক ভুলে হারতে হয়েছে কোপা আমেরিকার ফাইনাল। নতুন কাউকে না পেয়ে তিতে ফিরে গিয়েছেন জুভেন্টাস খেলা অ্যালেক্স সান্দ্রোর কাছে। দলে আরেক লেফট ব্যাক অ্যালেক্স তেলেস থাকলেও দুর্বল সাম্প্রতিক ফর্মের জন্য একাদশে হয়তো থাকা হবে না তাঁর। রাইট ব্যাক পজিশনের অবস্থা আরও করুণ, কাউকে না পেয়ে ডাকতে হয়েছে ৩৯ বছর বয়সী দানি আলভেজকে। ডিফেন্সে নতুন হিসেবে এসেছেন এদের মিলিতাও আর ব্রেমের। দারুণ পারফরম্যান্সে এদের মিলিতাও ইতিমধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা। খারাপ করছেন না ব্রেমেরও। কিন্তু এই দুজনই সেন্টার ব্যাক হওয়ায় একাদশে থাকার সম্ভাবনা কম তাদেরও। কারণ, এ দুই জায়গায় মার্কিনিওস আর থিয়াগো সিলভার জায়গা মোটামুটি নিশ্চিত।
পাশাপাশি সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে মিডফিল্ডেও। অনেক সম্ভাবনা দেখিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন আর্থুর মেলো। ফুটবলবোদ্ধারা ভেবেছিলেন, ভবিষ্যতে হয়তো ব্রাজিলের মাঝমাঠের নেতৃত্ব দেবেন আর্থুর মেলো। সেই সম্ভাবনা অবশ্য বাস্তবে রূপ নেয়নি এখনো। টানা ফর্মহীনতার কারণে তাঁকে দল থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন তিতে। বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কাসেমিরো আর ফাবিনহো দলে থাকলেও, দুজনেরই পজিশন এক। ফলে একসঙ্গে তাদের একাদশে দেখার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পাকেতা, ফ্রেড, ব্রুনো, এভারটন—সবাই সম্ভাবনাময় হলেও বড় ম্যাচে কেমন করবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকেরই। তাই ব্রাজিল দলকে ভুগতে হতে পারে মিডফিল্ড আর ডিফেন্সে।
তবে ফুলব্যাক আর মিডফিল্ড পজিশনে ব্রাজিল যতটা দুর্বল, তার চেয়েও শক্তিশালী গোলকিপার, ব্রাজিলের আক্রমণভাগ। বিশ্বের অন্যতম দুই সেরা গোলকিপার অ্যালিসন ও এদেরসনের সঙ্গে আছেন প্রতিভাবান ওয়েভারটন। ৩৮ বছর বয়সেও থিয়াগো সিলভা এখনো চেলসির হয়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছেন। ফর্মে আছেন মার্কিনিওসও। তাই সেন্টার ব্যাক নিয়ে নিশ্চিন্তেই থাকতে পারে ব্রাজিল। আক্রমণভাগে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নেইমার। চলতি মৌসুমে দারুণ ছন্দে আছেন তিনি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ফরাসি ক্লাব পিএসজির হয়ে ২০ ম্যাচে করেছেন ১৫ গোল। পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন ১২টি। সঙ্গে আছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। রিয়াল মাদ্রিদ দলে এডেন হ্যাজার্ডের মতো খেলোয়াড়কে সরিয়ে লেফট উইং জায়গাটা নিজের করে নিয়েছেন ভিনি। রিয়ালের হয়ে গত মৌসুমে ৫২ ম্যাচে গোল করেছেন ২২টি, পাশাপাশি ২০টি অ্যাসিস্টও করেছেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে রদ্রিগোও ছিলেন উজ্জ্বল। রাইট উইংয়ে দারুণ কার্যকর তিনি। গত বিশ্বকাপে কোনো গোল করতে না পারলেও গ্যাব্রিয়েল জেসুস এই মৌসুমে আর্সেনালে এসে খুঁজে পেয়েছেন ছন্দ। রিচার্লিসন, রাফিনিয়া, আন্তনি—ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন তাঁরাও। ফলে বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে ব্রাজিল গোলবন্যায় মেতে উঠলে অবাক হবে না কেউই।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আজ ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ সার্বিয়া। গত বিশ্বকাপেও একই গ্রুপে ছিল এই দুই দল। গ্রুপ পর্যায়ের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে ম্যাচটি ব্রাজিল জিতেছিল ২-০ গোলে। কোনো অঘটন না ঘটলে, আজও জয় পাওয়ার কথা নেইমার-রাফিনিয়া- অ্যালিসনদের। তবে ছেড়ে কথা বলবে না সার্বিয়াও। দুসান তাদিচ, ভ্লাহোভিচ, সার্গেই মিলিনকোভিচ স্যাভিচ, মিত্রোভিচদের নিয়ে গড়া দলটি চাইবে বড় অঘটন ঘটিয়ে জয় দিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ শুরু করতে। যেভাবে অঘটন হচ্ছে এই বিশ্বকাপে, ভয়ে পড়ে গেছেন ব্রাজিল সমর্থকেরাও।
আজ অঘটন হচ্ছে কি না, সেটা বোঝা যাবে ম্যাচ শুরু হলেই। কিন্তু জমজমাট এক ম্যাচ যে অপেক্ষা করছে, তা বলাই বাহুল্য।
সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের সম্ভাব্য একাদশ: অ্যালিসন, দানিলো, থিয়াগো সিলভা, মার্কিনিওস, অ্যালেক্স সান্দ্রো, কাসেমিরো, পাকেতা, নেইমার, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রাফিনিয়া, রিচার্লিসন।