বাংলা ভাষায় একটা অদ্ভুত শব্দ আছে, অঘটনঘটনপটীয়সী। যার অর্থ, অসম্ভব কাণ্ড ঘটাতে ওস্তাদ যিনি। এক দিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপকে এই শব্দে বিশেষায়িত করলেও ভুল কিছু হবে না। ক্রিকেট বিশ্বকাপ মানেই যেন ঐতিহ্যগতভাবে অঘটনের কেন্দ্রবিন্দু। এমনি এমনি তো আর ক্রিকেটকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয় না। এবারের বিশ্বকাপে সেই অঘটনের সূচনা করল আফগানিস্তান। বিশ্বকাপের ১১তম দিনে এসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ৬৯ রানে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের জন্ম দিল আফগানরা। বিশ্বকাপের তৃতীয় আসরে এসে এটি তাদের দ্বিতীয় জয়, আর সেই জয়টাও বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে।
বিশ্বকাপে পিচের অবস্থা দেখে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এবার হয়তো খুব একটা চমক দেখা যাবে না। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে বড় দলগুলোর সঙ্গে ছোট দলগুলোর পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বড় দলগুলোর সামনে বালুর বাঁধের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো। সঙ্গে বিশ্বকাপজুড়েই ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য থাকার কারণে ছোট দলদের অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে এসেছিল। কিন্তু নামটা বিশ্বকাপ বলে কথা, বিশ্বকাপের আসর বসবে আর দু–একটা অঘটন ঘটবে না, এমনটা তো হয় না।
প্রথমে ব্যাট করে ২৮৪ রান তুলেছিল আফগানিস্তান। ইংল্যান্ডের পরাক্রমশালী ব্যাটিং লাইনআপের কাছে তা এক মামুলি টার্গেট। ওপেনার দুজন দাঁড়িয়ে গেলে ১০ উইকেটে জিতলেও অবাক হতেন না কেউ। কিন্তু সেই ইংল্যান্ড কিনা আফগানিস্তানের সামনে গুঁড়িয়ে গেল মাত্র ২১৫ রানে। ৬৯ রানের বিশাল জয় নিয়ে এখন আফগানিস্তানের অবস্থান পয়েন্ট টেবিলে ছয়ে। ইংল্যান্ডের জন্য অবশ্য এমন অঘটন নতুন কিছু নয়। পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যাবে, বড় টুর্নামেন্টে প্রায়ই হোঁচট খায় ইংল্যান্ড। বরং ইংল্যান্ডের জন্য এটাই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। নইলে কি আর ক্রিকেট এবং ফুটবল দুই খেলাতেই বিশাল পরাশক্তি হয়েও তাদের ট্রফি ক্যাবিনেটে বিশ্বকাপের সংখ্যা মাত্র ১!
ইংল্যান্ডের এই হোঁচট খাওয়ার গল্প আজকে থেকে নয়। গত চার বিশ্বকাপ ধরে মূল পর্বে হোঁচট খাওয়া যেন তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ২০১১ বিশ্বকাপ দিয়েই শুরু করা যাক। সেবার উপমহাদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ বসায় এমনিতেই ব্যাকফুটে ছিল ইংলিশরা। ভারতের সঙ্গে টাই করে বিশ্বকাপের উত্তেজনাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল তারা। এর পর থেকেই শুরু হয় হোঁচট খাওয়া। প্রতিবেশী এবং রাজনীতির মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে বসে ইংলিশরা। প্রথমে ব্যাট করে ৩২৭ রানের বিশাল লক্ষ্য ছুড়ে দেয় আইরিশদের দিকে। বিশাল রানের চাপে সহজেই গুঁড়িয়ে যাবে, এমনটাই হয়তো ভাবনা ছিল অনেকের। কিন্তু আইরিশদের মনে সেদিন ছিল অন্য লক্ষ্য। একাই ইংল্যান্ডের যমদূত হয়ে উঠেছিলেন কেভিন ও’ব্রায়ান। ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে শুধু বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডই গড়েননি, একই সঙ্গে ইংল্যান্ডকে ছুড়ে ফেলেছেন ম্যাচ থেকে (২০২৩ বিশ্বকাপে কেভিন ও’ব্রায়ানের রেকর্ড ভেঙেছেন এইডেন মার্করাম। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৪৯ বলে সেঞ্চুরি হাঁকান দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাটসম্যান)। আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে শুরু হয় ইংল্যান্ডের হোঁচট খাওয়া।
মূল ধাক্কাটা আসে স্বাগতিক বাংলাদেশের কাছ থেকে। স্বাগতিকদের কাছ থেকে এমন ধাক্কা আশা করেনি কেউই। ইংল্যান্ডের দেওয়া ২২৭ রানের টার্গেটে যেভাবে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়ছিল, তাতে জয়ের আশা করাটাই ছিল ভুল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ২১ আর শফিউল ইসলামের ২৪ রানের ইনিংস বাংলাদেশকে পৌঁছে দেয় জয়ের বন্দরে। এক বিশ্বকাপে দুই ম্যাচে হোঁচট খেয়ে সমীকরণ থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়ে থ্রি লায়ন্সরা। তবু রান রেটের ব্যবধানে সেবারে পরবর্তী রাউন্ড খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল ইংলিশদের।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংলিশদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না। স্বাগতিকদের কাছে হেরে এমনিতেই ব্যাকফুটে ছিল ইংলিশরা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল অলিখিত ফাইনাল। অ্যাডিলেড ওভালের সেই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচ। চার বছর আগের নায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরি আর মুশফিকুর রহিমের ৮৯ রানে ভর করে টাইগার বাহিনী ইংল্যান্ডকে দিল ২৭৬ রানের টার্গেট। ২০১৫ সালের ইংল্যান্ড তো আর আজকের ইংল্যান্ড না, ধীরে-সুস্থে বুঝে-শুনে ক্লাসিক্যাল ক্রিকেট খেলা সেই ইংল্যান্ড শুরুতেই চলে গেল ব্যাকফুটে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো ইংলিশদের হয়ে প্রতিরোধের বাঁধ বেঁধেছিলেন ওপেনার ইয়ান বেল আর উইকেটকিপার জস বাটলার। ষাটোর্ধ ইনিংস শুধু পরাজয়ের ব্যবধানই কমিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ১৬ রান, বাংলাদেশের ২ উইকেট। রুবেল হোসেনের সেই ওভার কোনো বাংলাদেশি সমর্থকের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। প্রথম বলে স্টুয়ার্ট ব্রড আর এক বল বিরতি দিয়ে জেমস অ্যান্ডারসন; ইংল্যান্ডের সেরা দুই পেসারের স্টাম্প গুঁড়িয়ে ফেললেন নিমেষেই। ‘ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দিবো’ হুঙ্কার দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা রুবেল সত্যি সত্যিই সেদিন ভেঙে দিয়েছিলেন ইংলিশদের মনোভাব।
বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিশ্বকাপকে বিদায় বলতে হয় ইংলিশদের। সেই লজ্জাজনক পরাজয়ের রেশ ধরে নিজেদের পুরোপুরি পাল্টে ফেলে থ্রি লায়ন্সরা। নতুন উদ্যমে, নতুন দর্শনে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু করে ইংলিশরা। লক্ষ্য একটাই, নিজেদের মাটিতে ফেবারিট নয়, বিশ্বজয় করতে নামতে চায় তারা। কিন্তু যত কিছুই ঘটুক না কেন, অঘটন শব্দটা তো এত সহজে ইংল্যান্ডের পিছু ছাড়তে রাজি নয়।
২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের কপালে দুর্দশা নিয়ে এসেছিল শ্রীলঙ্কা। নামের দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ছোট দল বলার সামর্থ্য নেই কারও। কিন্তু সেই নামেই সুবিচার বেশ কয়েক বছর ধরেই করতে ব্যর্থ তারা। তবে শ্রীলঙ্কার জয়কে অঘটন বলার কারণ শ্রীলঙ্কা দল নয়, বরং ইংল্যান্ডের হারের ধরন। নিজেদের মাটিতে প্রতি ম্যাচেই রানের পাহাড় গড়েছে ইংলিশরা। ৩০০+ স্কোর তো মামুলি ব্যাপার, বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪০০ ছোঁয়ারও সুযোগ ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার দেওয়া ২৩৩ রানের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে তারা। বেন স্টোকস আর জো রুট বাদে কেউই দাঁড়াতে পারেনি লঙ্কান বোলিংয়ের সামনে। নিজেদের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছে বিধ্বস্ত হয়ে আরেক অঘটনের জন্ম দেয় ইংলিশরা। যদিও সে অঘটন কোনো বাধা হতে পারেনি ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ের পথে।
২০২৩ বিশ্বকাপে এসে আবারও সেই চিরাচরিত রূপে ফিরল থ্রি লায়ন্সরা। এবারে প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান! এই ম্যাচের আগে ৩ বিশ্বকাপে যাদের ঝুলিতে জয় ছিল মাত্র একটি। সেটাও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল। প্রথমে ব্যাট করে ছুড়ে দেওয়া ২৮৬ রানের টার্গেট ইংল্যান্ডের জন্য নস্যি ব্যাপার। হেসেখেলে ৪০০ পার করা দলের জন্য এ আর এমন কী? কিন্তু রশিদ-মুজিবের বোলিং লাইনআপের সামনে নিমিষেই খেই হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। মাত্র ২১৫ রানে আটকে যায় তারা। ২০২৩ বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের জন্ম নিল আফগানদের হাত ধরেই।
বিশ্বকাপের মঞ্চে ‘দুর্ভাগা’ বললে যেমন উঠে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার নাম, তেমনই ‘অঘটন’ শব্দটার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে ইংল্যান্ড। প্রতি বিশ্বকাপেই কোনো না কোনো অঘটনের শিকার হয় থ্রি লায়ন্সরা। সেটা শুধু এক দিনের বিশ্বকাপ নয়, টি-২০ বিশ্বকাপের সেরা অঘটনগুলোর দিকে ফিরে তাকালেও একটা নামের দেখা মিলবেই, ইংল্যান্ড! ২০০৯ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস, ২০২২ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড; বড় মঞ্চে তাদের বিপক্ষে যমদূত হয়ে আসে শক্তিমত্তায় অনেক পেছনে থাকার দলগুলোই।
সুনির্দিষ্ট করে কেন ছোট দলের বিপক্ষেই হোঁচট খায় ইংল্যান্ড, তার কোনো কারণ দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট, তাদের বড় দল মেন্টালিটি অনেকাংশেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ম্যাচগুলোতে। সঙ্গে তাদের ক্রিকেট ঐতিহ্যের প্রতি ‘সম্মান’! নিজেদের খেলোয়াড়দের ওপরে তুলতে ইংলিশ মিডিয়ার জুড়ি মেলা ভার। সেটা যেকোনো খেলাই হোক না কেন। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইংলিশদের খেলার ধরন কিংবা নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড় মানে তেমন অসাধারণ কিছু না হলেও তাঁদের মাথায় তুলে রাখে মিডিয়া। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁরাই ম্যাচে ভরাডুবি ডেকে আনেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, নিজেদের ট্যাক্টিসের প্রতি ইংলিশদের অগাধ ভরসা। ২০১১ বা ২০১৫ বিশ্বকাপে নিজেদের ক্ল্যাসিক্যাল টেক্সট বুক ক্রিকেট খেলার মনোভাব পাল্টাতে পারেনি বলেই বাংলাদেশের কাছে ধরাশায়ী হতে হয়ছিল তাদের। ২০১৯ আর ২৩ বিশ্বকাপে তার পুরো উল্টো। আক্রমণাত্মক ক্রিকেটকে নিজেদের নতুন পরিচয় হিসেবে দাঁড় করালেও সময়ভেদে সেই ক্রিকেট থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে ব্যর্থ তারা। আফগানদের বিপক্ষে উইকেটে টিকে থাকলেই নিয়মিত রান আসত। কিন্তু আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে গিয়েই জেতা ম্যাচ হাতছাড়া করেছে থ্রি লায়ন্সরা।
তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, বিশ্বকাপের মঞ্চে এমন অঘটন কে না দেখতে চায়? বিশ্বকাপের মূল মজাই তো এই অঘটনে!