নিশির ডাকের মতো হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকছিল অবনমন। আজ না হয় কাল, হওয়ারই ছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, সেটা হয়তো আশা করেনি খোদ সাউদাম্পটনও। প্রিমিয়ার লিগের বাকি আরও ৭ ম্যাচ। এর আগেই অবনমন নিশ্চিত করেছে সেইন্টসরা। বাকি ৭ ম্যাচে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা তাদের জন্য। চাইলে পরের মৌসুমের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে পারে তারা।
সাউদাম্পটনের জন্য মৌসুমটা রোলাকোস্টার রাইডের থেকেও কম কিছু ছিল না। গত মৌসুম তারা শেষ করেছিল চতুর্থ অবস্থানে থেকে। সংগ্রহ ছিল মাত্র ৮৭ পয়েন্ট। সেখান থেকে প্লে-অফে টেক্কা দিয়ে ওয়েস্ট ব্রম, লিডসকে হারিয়ে প্রিমিয়ার লিগে নিশ্চিত করে নিজেদের জায়গা। কোচ রাসেল মার্টিনকে নিয়ে তাই তাদের আশা ছিল তুঙ্গে। চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ এক মৌসুম কাটানো সাউদাম্পটনের পেছনে তাই ঢালা হয়েছিল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
কিন্তু গত ৯ মাস সাউদাম্পটনের জন্য ছিল রীতিমতো বিভীষিকা। খরচের খাতায় যুক্ত হয়েছে ১২৮ মিলিয়ন ডলার। অর্জন? লবডঙ্কা! ফর্মের খোঁজে কী করেনি তারা? নতুন খেলোয়াড় দলে টেনেছে, প্রমোশন এনে দেওয়া কোচ বরখাস্ত হয়েছেন, চেয়ারম্যান পদ ছেড়েছেন, বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন। নতুন কোচ জুরিচ এসেছেন, মৌসুম গড়াতে না গড়াতে তিনিও বরখাস্ত। চেয়ারম্যান, কোচ, খেলোয়াড়, সবকিছুতে পরিবর্তন এনেও প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারল না সাউদাম্পটন। বরং তারা দাঁড়িয়ে আছে এক হতাশাজনক রেকর্ডের সামনে। স্পোর্টস রিপাবলিক দলের মালিকানা বুঝে নেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অবনমনের লজ্জা পেল সাউদাম্পটন। কিন্তু কেন?
লিগের ৩১ রাউন্ড শেষে সাউদাম্পটনের নামের পাশে আছে মাত্র ১০ পয়েন্ট। এই মৌসুমে সাউদাম্পটনের জয়ের সংখ্যা মোটে ২টি। তারা প্রথম পয়েন্ট পেয়েছিল পঞ্চম সপ্তাহে এসে। ইপসউইচ টাউনের সঙ্গে ড্র করে। এরপর এভারটনের সঙ্গে একটা জয় আর ব্রাইটনের সঙ্গে ড্র। টটেনহামের সঙ্গে ৫-০ গোলে হারার পর বড়দিনের মাত্র ১০ দিন আগে বরখাস্ত করা হয় রাসেল মার্টিনকে। রাসেল মার্টিন যে খুব একটা খারাপ করছিলেন, তা নয়। কিন্তু জয়টা আসছিল না। লিভারপুলের সঙ্গে ভালো খেলেও শেষ মুহূর্তে হার, ব্রাইটনের সঙ্গে এগিয়ে থেকে ড্র। বেশ কয়েকটি ক্লোজ ম্যাচ জয়ের কাছাকাছি গিয়েও হারতে হয়েছে তাদের। মার্টিনকে বিদায় করা ছাড়া উপায় খোলা ছিল না সাউদাম্পটনের।
নতুন কোচ হিসেবে যোগ দেন রোমা থেকে সদ্য বরখাস্ত হওয়া ইভান জুরিচ। অন্তর্বর্তীকালীন কোচের অধীনে ড্র দেখে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন নতুন কোচের অধীনে হয়তো ফর্মে ফিরবে সেইন্টরা। কিন্তু কিসের কী? দলকে সঙ্গে নিয়ে ডুবেছেন তিনিও। বরং মার্টিনের সময়ে যে স্টাইলিশ খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল সমর্থকদের, আশা দেখিয়েছিলেন ভালো কিছু করার, তার ছিটেফোঁটা ছিল না জুরিচের খেলায়। ব্রেন্টফোর্ড ও চেলসির কাছে যথাক্রমে ৫ আর ৪ গোল হজমই তার প্রমাণ। জুরিচের অধীনে একমাত্র জয় এসেছে তাদের ঠিক ওপরে থাকা ইপসউইচ টাউনের বিপক্ষে। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে একটা ড্র। ১৪ ম্যাচে মাত্র ৪ পয়েন্ট নিয়েই বরখাস্ত হলেন ক্রোয়াট কোচ। আবারও ঘুরেফিরে সেই টটেনহামের কাছে এসেই ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল জুরিচের। ৩-১ গোলে হেরে নিশ্চিত হলো অবনমন। সঙ্গে এল বরখাস্তের খবর।
সাউদাম্পটনের অবনমন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল মৌসুমের একেবারে শুরুতেই। প্রিমিয়ার লিগ জেতার আশা তাদের কখনোই ছিল না। বরং টিকে থাকাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের শিকার তারা। লিগ শুরুর আগেই প্রায় ২০ জন নতুন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ায় সেইন্টসরা। এর মধ্যে অ্যারন রামসডেলের মতো পরীক্ষিত গোলরক্ষক যেমন ছিল, তেমনই ছিল রয়্যান ফ্রেসার, অ্যাডাম লালানার মতো অভিজ্ঞ মিডফিল্ডারদের। কিন্তু এতজন খেলোয়াড়কে একত্রে কেনা এবং তাঁদের দেখভাল করার জন্য রাসেল মার্টিন যথেষ্ট ছিলেন না। তবুও প্রমোশন এনে দেওয়া কোচের ওপর ভরসা ছিল তাদের। কিন্তু এত বদলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি সাউদাম্পটন।
তবুও টায়লার ডিবলিং, টেইলর হারউড-বেলিস, ম্যাতিউস ফের্নান্দেসের মতো তরুণ তুর্কিদের নিয়ে গড়া দলটাকে নিয়ে আশা করেছিলেন অনেকে। অন্তত অবনমনের শঙ্কা কাটাতে সম্ভব হবে তাদের নিয়ে। বরং তাদের নিয়ে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের অন্যতম বাজে পারফরম্যান্সের সাক্ষী হলো সেইন্টসরা। এর সবচেয়ে বড় দায় দলের ভেতরকার রাজনীতি। এত খেলোয়াড় কেনার পক্ষপাতী ছিলেন না দলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর। বরং তিনি চেয়েছিলেন রাসেল মার্টিনের প্রয়োজন অনুযায়ী খেলোয়াড় আনতে। কিন্তু চেয়ারম্যান চেয়েছিলেন দলে আমূল পরিবর্তন। ফলে শুরু থেকেই কম্বিনেশোনের অভাব ছিল স্পষ্ট। ১৬ ম্যাচ শেষে ৫ পয়েন্ট অর্জন করা রাসেল মার্টিনকে বরখাস্ত করা ছাড়া উপায় খোলা ছিল না তাদের।
নতুন কোচ ইভান জুরিচও খুব একটা ভালো চয়েজ ছিলেন না। পুরোপুরি ভিন্ন স্টাইলের কোচকে আনার সিদ্ধান্তটা যে খুব একটা ভালো ছিল না, তা বোঝা গিয়েছে দিন গড়াতেই। মাত্র ১০৭ দিন ছিলেন দায়িত্বে। ১৪ ম্যাচে তাঁর অর্জন ১ জয় আর ১ ড্র। গত জানুয়ারিতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাদের অবনমন। বাকি ছিল শুধু কাগজে-কলমে মেলানো। সেটাও নিশ্চিত হলো এপ্রিলে এসে।
৩১ ম্যাচ শেষে তাদের সংগ্রহ মাত্র ১০ পয়েন্ট। আগামী ৭ ম্যাচ কোনো পয়েন্ট না পেলে প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে বাজে দল হিসেবে রেকর্ড গড়বে তারা। বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে সবচেয়ে কম পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করার রেকর্ড ডার্বি কান্ট্রির। ২০০৭-০৮ মৌসুমে তারা লিগ শেষ করেছিল ১১ পয়েন্ট নিয়ে। সে রেকর্ডের ভাগীদার হয়েছে কি না, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও ৭ সপ্তাহ। তবে আরেকটি রেকর্ডে ঠিকই তাদের নাম জড়িয়ে গিয়েছে। সপ্তাহের ইতিহাসে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুততম অবনমনের ইতিহাস এখন তাদের। ২০০৮ সালে ডার্বি কান্ট্রি ও ২০১৯ সালে হাডার্সফিল্ড অবনমন নিশ্চিত করেছিল ৬ সপ্তাহ আগে। যদিও দিনের হিসাবে তাদের অবস্থান চতুর্থ।
আগামী ৭ ম্যাচের জন্য দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন সাইমন রাস্ক। দ্বিতীয়বারের মতো দলকে সামলানোর গুরুদায়িত্ব তার কাঁধে। তাঁকে সাহায্য করবেন দলের বর্তমান খেলোয়াড় অ্যাডাম লালানা। বাকি সাত ম্যাচে তাদের লড়াই লজ্জা এড়ানোর। নতুন কোচ আর দল ছাড়া পরবর্তী মৌসুমের জন্য দলের পরিকল্পনাও শুরু করতে পারছে না তারা। এখন পর্যন্ত সাউদাম্পটনের লক্ষ্য এটাই।