শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মোস্তাফিজ যখন ক্রিজে আসেন, জয় থেকে বাংলাদেশ তখনো ৫১ রান দূরে।
একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে মোস্তাফিজের সঙ্গী মেহেদী হাসান মিরাজ। ১৮৭ রানের ছোট টার্গেটকেও তখন মনে হচ্ছিল পাহাড়সম। আর জয়ের সুবাস পেতে থাকা ভারত শিবির ফেলছে স্বস্তির নিশ্বাস। দরকার মাত্র ১ উইকেট, তাহলেই তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয় তুলে নেবে ভারত।
কিন্তু রোহিত শর্মার দল হয়তো ভুলেই গিয়েছিল, ২০১৫ সাল থেকে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য এক দল!
২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। শিরোপা জিততে না পারলেও ওই টুর্নামেন্টের পর বাংলাদেশকে নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রত্যাশা বেড়ে যায় অনেকখানি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ঘোষণা দেন, এটা মাত্র শুরু, সামনে আরও ভালো খেলবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
কিন্তু পরবর্তী দুই বছর হতাশই করেন সাকিব-মুশফিকরা। বলার মতো কোনো অর্জন তো ছিলই না, উল্টো ২০১৪ সালের প্রথম ১১ মাস কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। আত্মবিশ্বাসের তলানিতে থাকা এক দলের দায়িত্ব তখন তুলে দেওয়া হয় সদ্য চোটমুক্ত হওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজার হাতে।
বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার শুরু তখন থেকেই। জিম্বাবুয়েকে ৫ ম্যাচ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে ২০১৫ বিশ্বকাপে যায় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো খেলে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। এর পরপরই বাংলাদেশে আসে পাকিস্তান, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা। মূলত এখান থেকেই ঘরের মাটিতে দাপট শুরু হয় বাংলাদেশের।
১৯৯৯ সালের পর ক্রিকেটের কোনো সংস্করণেই হারাতে না–পারা পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ করে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে জয় পায় ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। শুধু ২০১৬-১৭ সালের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারা বাদে এখন পর্যন্ত ঘরের মাটিতে একটি ওয়ানডে সিরিজেও হারেনি বাংলাদেশ। নিজ দেশে এতটাই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ টাইগাররা।
কিন্তু এবারের দলকে দেখে মনে হচ্ছিল না খুব একটা ছন্দে আছে বাংলাদেশ। চোটের কারণে সিরিজ থেকে ছিটকে গেছেন নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবাল। একই কারণে দলে নেই দারুণ ছন্দে থাকা তাসকিন আহমেদও। মোস্তাফিজ ছাড়া দলের বাকি দুই পেসার ইবাদত আর হাসান মাহমুদ ওয়ানডেতে একেবারেই নতুন। নিজের সেরা সময় ফেলে এসেছেন দলের একসময়ের মূল ব্যাটিং স্তম্ভ মাহমুদউল্লাহ। লিটন দাসের নেতৃত্বে এই দল ভারতের বিপক্ষে আদৌ ভালো করতে পারবে কি না, এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন অনেকেই। মাত্র ১৮৭ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বাংলাদেশ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ার পর সেই সন্দেহই সত্য হবে বলে মনে হচ্ছিল। ঘরের মাটিতে অপরাজিত থাকার রূপকথার বোধ হয় এখানেই সমাপ্তি।
মিরাজের মনে ছিল ভিন্ন কিছু। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের যোগ্য উত্তরসূরি ভাবা হয় যাঁকে, সেই মিরাজ বল হাতে নিয়মিত ভালো করলেও ব্যাটিংয়ে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেননি সেভাবে। ব্যাট হাতেও তিনি কতটা দক্ষ, সেটা প্রমাণ করার জন্য বোধ হয় মনে মনে ছিলেন এমনই এক মঞ্চের অপেক্ষায়। মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে দশম উইকেটে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় গড়েন ৫১ রানের জুটি, যার ওপর ভর করে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে পায় এক ঐতিহাসিক জয়। তিন ম্যাচ সিরিজে এগিয়ে যায় ১-০ ব্যবধানে।
দ্বিতীয় ম্যাচেও দেখা যায় একই দৃশ্য। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে আবারও ব্যাটিং বিপর্যয়ে লিটন দাসের দল। ৬৯ রানেই নেই দলের ৬ উইকেট। আরেকটি ১০০ রানের নিচে অলআউট হওয়ার লজ্জা যখন বাংলাদেশকে চোখ রাঙাছিল, তখনই ত্রাতা হিসেবে আবারও আবির্ভাব মেহেদী হাসান মিরাজের। অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে এবার সপ্তম উইকেটে গড়েন ১৪৮ রানের জুটি। ৭৭ রানে মাহমুদউল্লাহ প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেও আরেক পাশ থেকে ব্যাট চালিয়ে যান মিরাজ, মাত্র ৮৩ বলে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। বলতে হবে নাসুম আহমেদের কথা। তাঁর ১১ বলে ১৮ রানের ঝোড়ো ইনিংস মিরাজকে সাহায্য করে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে। মিরাজ, মাহমুদউল্লাহ আর নাসুমের ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ পায় ২৭১ রানের বড় সংগ্রহ। এমন দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানো অনুপ্রেরণা দেয় দলের বোলারদের। এবাদত, সাকিব, মিরাজরা মিলে চেপে ধরেন ভারতকে। শেষ পর্যন্ত লড়ে গেলেও আর পেরে ওঠেনি ভারত। ৫০ ওভার শেষে ২৬৬ রানেই থেমে যায় তাদের ইনিংস। আর ২০১৫ সালের পর আবারও ঘরের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জিতে নেয় টাইগাররা।
তৃতীয় ম্যাচে ভারত জয় পেলেও অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম সিরিজই ২-১ ব্যবধানে জিতে নেন লিটন দাস। ব্যাটে–বলে পুরো সিরিজে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সিরিজসেরা হন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। পাশাপাশি বোধ হয় এ ঘোষণাও দিয়ে রাখলেন, সাকিব–পরবর্তী যুগে ভয় নেই বাংলাদেশের!
ওয়ানডের পর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও ভালো কিছু করার সম্ভাবনা দেখায় বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও সিরিজের শেষ টেস্টটি জেতার একদমই দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন সাকিবরা। কিন্তু নিজেদের গড়পড়তা ফিল্ডিংয়ের কারণে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট জয় থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। সিরিজটি হারলেও বেশ কিছু ইতিবাচক ব্যাপার ঘটেছে বাংলাদেশের জন্য। টেস্ট দলে প্রথমবারের মতো ডাক পাওয়া জাকির হাসান অভিষেক ম্যাচেই পেয়েছেন সেঞ্চুরি। বেশ কিছুদিন পর দলে ফিরে ভালো খেলেছেন সাবেক অধিনায়ক মুমিনুল হকও। বল হাতে নিজেদের ফর্ম ধরে রেখেছেন সাকিব, মিরাজরা।
তবে ব্যক্তিগত সাফল্যে এ বছর সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন লিটন দাস। যে সম্ভাবনা দেখিয়ে তিনি দলে এসেছিলেন, ধারাবাহিকতার অভাবে তা পূরণ করতে পারছিলেন না। এ বছর প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছেন বর্তমানে দলের সেরা এই ব্যাটসম্যান, সমালোচনা ছাপিয়ে ফিরে এসেছেন ধারাবাহিক হয়ে। সব সংস্করণ মিলিয়ে এ বছর ১৯২১ রান করেছেন তিনি, ভেঙে দিয়েছেন মুশফিকুর রহিমের এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ রান করা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের রেকর্ড। এটি এখন শুধুই লিটনের। এই রান সংগ্রহের পথে করেছেন ৩টি সেঞ্চুরি আর ১৩টি হাফ সেঞ্চুরি। আগামী বছরও তিনি এই ছন্দ ধরে রাখবেন, এমনই আশা সবার। পাশাপাশি তাসকিন আহমেদের প্রত্যাবর্তন, পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হিসেবে মেহেদী হাসান মিরাজের আত্মপ্রকাশ—এ সবই দলকে দেবে দারুণ আত্মবিশ্বাস।
২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পরও খুব বেশি ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ, দলের বাকিদের ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে না–পারা। এবার যদি সাকিবের সঙ্গে লিটন, মিরাজ, তাসকিনরা নিজেদের ছন্দ ধরে রাখতে পারেন, ২০২৩ বিশ্বকাপে অন্য এক বাংলাদেশকেই হয়তো দেখবে ক্রিকেট–বিশ্ব।